চার মার্বেলের পৃথিবী

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পাঁচ-ছয় বছরের আমি
টাইফয়েডের আঁচে পুড়ে যাওয়া শরীর,
মাসের পর মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে
ভুলে গেছি কেমন করে হাঁটতে হয়।
তখন বাবার হাত, মায়ের চোখ,
আর দুটো বাঁশের মাঝে বাঁধা এক দড়ি—
সে-ই আমার পৃথিবীর প্রথম শিক্ষক।
দড়ি ধরে আমি শিখেছিলাম—
জীবনের ভারসাম্য কেমন করে রাখা যায়।
প্রথমে টলমল পা দুখানা, পরে দৃঢ়—
যেন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের গল্প,
যেখানে অসুখ মানে শুধু জ্বর নয়,
বরং বারবার পড়ে গিয়ে
আবার ওঠে দাঁড়ানোর শিক্ষা।
অসুস্থ শরীরের ভেতর আমার ছিল এক অমূল্য ধন—
চারটে রঙিন খেলার মার্বেল
নীল, সবুজ, লাল, হলুদ—
চারটে ছোট্ট গ্রহ,
যেন আমার হাতের মুঠোয় ঘুরছে এক মহাবিশ্ব।
রঙিন টিনের কৌটায় লুকিয়ে রাখতাম তাদের,
ঢাকনা খুললেই আকাশ চোখের সামনে মেলে ধরত স্বপ্নের দরজা।
সেই মার্বেলের শব্দে জন্ম নিত আমার নীরব উৎসব।

টুকটুক করে ঘুরে বেড়াত তারা,
আর আমি কল্পনা করতাম—
একদিন পুরো কৌটা ভরে যাবে মুঠি মুঠি মার্বেলে,
আমি হব পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী,
সবচেয়ে সুখী মানুষ।
আজ বুঝি,
প্রেমের প্রথম স্পর্শও হয়তো ওখানেই ধরা দিয়েছিল—
চারটে কাচের গোলার ঝলকানিতে,
রঙের ঘূর্ণনে,
শৈশবের ব্যথা ভুলিয়ে দেওয়া এক অদ্ভুত টানে।
সেখানে শরীরের যন্ত্রণা থেমে যেত,
আর শুরু হতো এক অন্য রকম ভালোবাসার অনুভূতি।
কত বছর... কেটে গেছে; এখনো মনে হয়,
জীবনের আসল রূপক তো সেইখানেই:
দড়ি ধরে হাঁটা শেখা মানে
বারবার ভেঙে পড়েও টিকে থাকার নাম।
আর মার্বেলের ভেতর ঘুরে বেড়ানো আলো মানে—
আমাদের সবচেয়ে ক্ষুদ্র সম্পদই
আসলে সবচেয়ে বড় স্বপ্নের বীজ।
জীবনে দিন যায়, রাত যায়,
কত কিছু আসে যায়,
দিন শেষে মানুষের হাতে থাকে
শুধু ওই চারটি মার্বেলই—
সৎবিশ্বাস, সৎকর্ম, ভালোবাসা আর স্বপ্নভেজা আশা।
বাকি যা কিছু—
কেবলই ভঙ্গুর কৌটার ঢাকনা—
একদিন খুলে গিয়ে হারিয়ে যায়।