দূরের তুরস্ক, কাছের তুরস্ক-১

ছবি: লেখক

থাকি ইংল্যান্ডে। ছেলে বলল, জিসিএসসি (এসএসসি) পরীক্ষার পর সে কোথাও বেড়াতে যেতে চায়। বাংলাদেশ হলে ভালো, নাহলে মরক্কো। ছেলেকে বললাম, ‘জুলাই মাসে বাংলাদেশ ও মরক্কোতে প্রচণ্ড গরম থাকে। অন্য কোথাও দেখো।’ সেই সঙ্গে এ-ও বললাম, ‘চলো, পর্তুগাল যাই।’ কিন্তু ছেলে যেতে চায় না। বলল, ‘তুরস্কে চলো। গরম কিছুটা কম, মুসলিম দেশ।’
‘তুরস্কের কোথায় যাবে?’
ইস্তাম্বুল যাওয়া যায়, কিন্তু দুই-তিন দিন পর সেখানে আর কিছু দেখার থাকে না। তার এক বন্ধু বলেছে।
তাহলে?
সিদ্ধান্ত হলো, তুরস্কের পর্যটননগরী আন্তালিয়ায় যাব, এক সপ্তাহের জন্য। সমস্যা বাধল সময় নিয়ে। ছেলে আর স্ত্রী চায়, তুরস্কে ঈদ করতে। কোরবানির ঈদ। আমি চাই না। কিন্তু কী আর করা। তাদের দুই ভোট, আমার এক ভোট। আমি সংখ্যালঘু। পরাজিত হলাম।

শুরু হলো অনলাইনে সার্চ করা। কোথায় কীভাবে ভালো হোটেল পাওয়া যায়। কম খরচে। গেলবার স্পেনের লানজারুটি দ্বীপে গিয়েছিলাম স্পেশাল অফারে। এবারও তারা একটা অফার দিল—আন্তালিয়ার সিডে এলাকায় মালিসা গার্ডেন অ্যাপার্টমেন্টে সাত দিনের প্যাকেজ। তিনজনের আসা-যাওয়া, থাকা, স্বাস্থ্য বিমাসহ খরচ পড়বে প্রায় ওক হাজার পাউন্ড। মানে প্রায় ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা। খাওয়া ও হোটেল ট্রান্সফার আমাদের। অফারটা নিলাম। তখন মার্চ মাস। আপনি যত আগে বুকিং দেবেন, খরচ তত কম। শেষ মুহূর্তে যাঁরা বুকিং দেন, তাঁদের গুনতে হয় অনেক বেশি টাকা।

শুরু হলো দিন গণনা। ছেলে পড়াশোনায় যতটা না সিরিয়াস, বেড়াতে তার সিরিয়াসনেস অনেক বেশি। পরীক্ষা শেষ হলো। শুরু হলো ব্যাগ গোছানো। রান্নাবান্না। রান্নাবান্না কেন! আমরা যে হোটেল বুক করেছি, মানে অ্যাপার্টমেন্ট, তাতে রান্নার সুবিধা আছে। ফ্রিজ, ডাইনিং টেবিল, সোফাসেট—সবই। আমরা সব সময় চেষ্টা করি অ্যাপার্টমেন্ট নিতে। এখানে প্রাইভেসি থাকে। বাড়ি বাড়ি লাগে। আমার আরেকটা সমস্যা আছে। আমি অতি মাত্রায় বাঙালি। ভাত ছাড়া আমার চলেই না। অনেক শহরে আবার সব সময় ভাত, তরকারি সহজে পাওয়া যায় না। তাই আমরা যেটা করি, অ্যাপার্টমেন্ট নিই এবং লন্ডন থেকে কিছু তরকারি রান্না করে নিয়ে যাই। ওখানে ডিপ ফ্রিজে খাবার ঢুকিয়ে রাখি। পরে শুধু গরম করে খাই, আর শুধু ভাতটা রান্না করতে হয়। একবেলা বাইরে খাই, একবেলা রুমে। বৈচিত্র্য থাকে। খরচও তুলনামূলক কম হয়।

ছবি: লেখক

২৭ জুন বেলা ৩টা ২০-এ ফ্লাইট। লন্ডনের গেটউইক বিমানবন্দর থেকে। করেনডন এয়ারলাইনসে। এটা তুরস্কের বিমান সংস্থা। বাসা থেকে দুপুর ১২টায় নিজের গাড়ি নিয়ে হলাম। রেলস্টেশনের দূরত্ব পাঁচ মিনিট। গাড়ি পার্ক করে চড়লাম ট্রেনে। এয়ারপোর্ট আসতে ২৫ মিনিট লাগল। অনলাইনে চেক ইন করে ফেলায় এয়ারপোর্টে ঢুকতে খুব একটা সময় লাগল না। ভাবলাম, ঢুকেই জোহরের নামাজটা পড়ে ফেলব। বাসা থেকে অজু করে এসেছি। কিন্তু ছেলে একজনের সঙ্গে কথা বলে জানাল, এই টার্মিনালে কোনো নামাজ পড়ার জায়গা নেই। আমরা গতবার যে জায়গায় নামাজ পড়েছিলাম, সেটা অন্য টার্মিনাল। কী আর করা। কিছু খাবার ও পানীয় কিনলাম। এয়ারপোর্টের ভেতরে বাইরে থেকে পানি আনা যায় না। এক লিটার পানি প্রায় তিন পাউন্ড। আমার বউ অন্য দোকান ঘুরে এসে বলল, ‘তুমি একটা বেয়াক্কল, ওই দোকানে পানির দাম ১ টাকা ৬০ পয়সা, আর তুমি কিনা কিনলা ৩ টাকায়! মানুষ দেখে শুনে কিনে না?’ এদিকে ছেলে এসে বলল, সে এক রেস্তোরাঁয় নুডলস খাবে, দাম ১০ পাউন্ড। মানে ১ হাজার ৪০০ টাকা। ছেলের মা আবার গরম হয়ে গেল, ‘নুডলস ১০ পাউন্ড! তোরে ভূতে পাইছে!’

আরে খাক না। এটা তো এয়ারপোর্ট। দাম তো বেশি হবেই। তাই বলে ১০ পাউন্ড!

অনুমতি পেয়ে ছেলে দৌড়াল নুডলস খেতে। খাওয়াদাওয়ার পর যথাসময়ে প্লেনে উঠলাম। তিনজনেরই ব্রিটিশ পাসপোর্ট থাকায় তুরস্কের ভিসা লাগেনি। প্লেন ছাড়ল ৩০ মিনিট বিলম্বে। যাত্রী আসনগুলো খুব চাপাচাপি করে সাজানো। আমি মাঝেমধ্যে উঠে হাঁটতে লাগলাম। একজন বিমানবালা বললেন, খাবার পরিবেশনের সময় হাঁটলে তাঁদের অসুবিধা হয়। স্ত্রী ভিডিও করছিল। অন্য এক বিমানবালা এসে বললেন, ভিডিও করা যাবে না। কিরে ভাই, কোন বিমানে উঠলাম! এ দেখছি নিষেধমার্কা এয়ারলাইনস। মেজাজ গরম হলো। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমাদের পেছনের দুই সারিতে যাত্রী নেই। সোজা গিয়ে শুয়ে পড়লাম, তিন সিট দখল করে। এবার বিমানবালারা কিছু বললেন না। আরাম পেয়ে বিমানবালাদের ওপর যে রাগ ছিল, সেটা নিমেষেই হয়ে গেল হাওয়া। সাড়ে চার ঘণ্টা পর রাত প্রায় ১০টার দিকে বিমান নামল আন্তালিয়া বিমানবন্দরে। নেমেই পেলাম বুক করা ট্যাক্সি। চালকের বয়স ২৫-২৬ হবে। মোটামুটি ইংলিশ বলতে পারে। সে গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, ‘তোমাদের খিদে পেলে কোনো রেস্তোরাঁর সামনে থামাতে পারি।’
‘ওকে, থামাও।’
৪০-৪৫ মিনিট গাড়ি চালানোর পর এক জায়গায় গাড়ি থামাল। তুরস্ক আসার আগে একজন বলেছিলেন, তুরস্কে খাবারদাবার ও কাপড় খুব সস্তা। কাবাব পাওয়া যায় তিন পাউন্ডে। কিন্তু নেমে দেখি, কাবাব ১২ পাউন্ড। মানে, গলাকাটা। লন্ডনের চেয়ে বেশি। ছেলে বলল, সে ক্ষুধার্ত নয়, খাবে না। টুকটাক জিনিস কিনে হোটেলে পৌঁছালাম প্রায় রাত সাড়ে ১১টায়।

স্ত্রী ও লেখক
ছবি: সংগৃহীত

এসেই বউ ভাত বসিয়ে দিল চুলায়। তরকারি নিয়ে এসেছি লন্ডন থেকেই। অ্যাপার্টমেন্ট খুব একটা পছন্দ হয়নি বউ-ছেলের। সব সুবিধাই আছে, কিন্তু গতবারের (স্পেনের) অ্যাপার্টমেন্টের মতো ঝকঝকে নয়। তারা এটা বুঝতে চায় না, গতবারেরটা ছিল ফোর স্টার, এবার থ্রি স্টার। অবশ্য সকালে ঘুম থেকে উঠে তাদের বিরক্তি অনেকটাই কেটে গেল। যখন দেখল, রুমের পাশেই কমলালেবু ঝুলে আছে, আছে লেবু, কলাসহ অনেক ফলমূল ও সবজির বাগান, সুইমিংপুল, রেস্তোরাঁ, তখন তারা এটাকে গ্রহণ করতে শুরু করল। আসলে কোনো কিছুকেই হুট করে খারাপ বলা ঠিক নয়। যার বাহির কালো, তার হৃদয় তো আলোয় ভরাও হতে পারে। পারে না?

২.
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে গেল। বউ, ছেলে তখনো ঘুমাচ্ছে। ভাবলাম, আশপাশের এলাকাটা একটু দেখা দরকার। বেরিয়ে গেলাম হাঁটতে। চারপাশে কেবল দোকানপাট আর হোটেল। বসতি তেমন একটা চোখে পড়ল না। আজ ঈদের দিন। কিন্তু ঈদের কোনো আমেজ চোখে পড়ল না। দেখলাম না কোনো টুপিওয়ালা লোকও। দোকানপাটও খোলা। এ কেমন ইসলামি দেশ। আসার আগে ভেবেছিলাম, চারদিকে মসজিদ থাকবে। আজানের মধুর সুরে ঘুম ভাঙবে আমাদের। কিন্তু না, খবর নিয়ে জানলাম, নিকটতম মসজিদের দূরত্ব প্রায় দুই মাইল। হেঁটে যেতে সময় লাগবে ৩০-৪০ মিনিট। আমাদের দেশের শহরগুলোতে  ঈদের জামাত হয় একাধিক। এ শহরে ঈদের জামাত হবে একটা, ভোর ৬টা ১০ মিনিটে। নামাজে যেতে হলে মোটামুটি রাত চারটায় ঘুম থেকে উঠতে হবে। আমরা গত রাতে জার্নি করে ঘুমিয়েছি রাত ১টায়। ১টায় ঘুমিয়ে ৪টায় ওঠা বেশ কষ্টসাধ্য। তারপর পথঘাট চিনি না। ঈদের নামাজ মিস হয়ে গেল। সম্ভবত জীবনে প্রথম ঈদ জামাত মিস করলাম। অপরাধী লাগল নিজেকে। বউ-ছেলের ওপর রাগ হলো। আমি বাড়িতে ঈদ করা লোক। আপনজন ছেড়ে, একা একা ঈদ করার মধ্যে কী আনন্দ থাকতে পারে! তাদের যুক্তি ছিল, অন্য সংস্কৃতি দেখা। যা-ই হোক। একা চারপাশ ঘুরতে খারাপ লাগল না। নতুন জায়গা দেখার আনন্দ আছে। কয়েকটা দোকানে ঢুকলাম। কিনলাম ডিম, জলপাই তেল, টার্কিশ ব্রেড, পানি, পেঁয়াজ—এসব। অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে দেখি, বউ, ছেলে তখনো ঘুমাচ্ছে। খিদে পেয়েছে। টেবিলে থাকা ইয়াম ইয়াম খেলাম। বউ-ছেলে ঘুম থেকে উঠল দেরিতে। বউ বলল, ‘কী নাশতা খাবে?’
‘এখন প্রায় দুপুর ১২টা বেজে গেছে। নাশতা না খেয়ে ভাতই খেয়ে ফেলি।’
বউ পোলাও বসিয়ে দিল। লন্ডন থেকে আনা চিকেন রোস্ট বের করল ফ্রিজার থেকে। ডিম সেদ্ধ দিল। তাকে সহযোগিতা করলাম আমি।

ছেলের সঙ্গে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

খেতে গিয়ে বোঝা গেল আজ ঈদ। ছোটবেলা থেকেই আমরা ঈদ উদ্‌যাপন করি পোলাও-রোস্ট খেয়ে। আজও করলাম। তুরস্কে। তুরস্কের লোকেরা ভাত খায় কম। রুটিই বেশি খায় তারা। আমি আজ সকালে বিশাল এক টার্কিশ রুটি কিনে এনেছি মাত্র ৬ লিরায়। ৬ লিরা মানে ১৮ টাকা। বউ বলল, ‘এই রুটি এনেছ কেন?’

‘যে দেশে যাবে, সেই দেশের খাওয়া কেমন, চেক করা দরকার।’

চেক করলাম। খারাপ নয়। অবশ্য এটা কী দিয়ে খেতে হয়, সেটাই জানি না। খাওয়াদাওয়ার পর ছেলে গেল হাঁটতে। ফিরে এল ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই। অতঃপর ছেলেকে বললাম, ‘চলো, এবার তিনজন একসঙ্গে বের হই। ছেলে রাজি নয়। সে বলল, তোমরা যাও, আমি একটু পর সুইমিংপুলে গোসল করতে যাব।’
ঠিক আছে।

অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়েই বাগান। সেখানে আছে দোলনাও। আমি দোলনায় শুয়ে থাকলাম। বউ খুশিতে চিৎকার করছে, ‘এই দেখো, কী সুন্দর কমলা ঝুলে আছে। কী সুন্দর ফুলবাগান, সবজিও আছে, কত লেবু।’ সে খুশিতে ক্লিক ক্লিক ছবি তুলছে। ভিডিও করছে। একসময় চিৎকার করে আমাকে কমলা পেরে দিতে বলল। আমি গেলাম সেখানে, কিন্তু কমলা পাড়তে পারলাম না। অনেক উঁচুতে। তার শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস দেখে এগিয়ে এলেন সাদা, সুদর্শন এক ভদ্রলোক। হাফ প্যান্ট পরা। এসে জানতে চাইলেন আমরা কোন দেশ থেকে এসেছি।
‘লন্ডন। তবে আমরা বাংলাদেশের লোক।’
‘ওখানে কী কাজ করেন?’
‘সেলফ এমপ্লয়েড। রাজনীতিও করি। আমি একজন ব্রিটিশ কাউন্সিলরও।’
‘তাই নাকি! তাহলে ভবিষ্যতে মেয়র-এমপি হতে পারো?’  
‘সময়ই বলে দেবে।’
তিনি এখন আমাদের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণভাবে গ্রহণ করলেন। তাঁর পরিচয় দিলেন। তাঁর নাম মাহমুদ। তিনি তুরস্কেরই লোক। এই রিসোর্টের মালিক। আমাদের বললেন, ‘আমার রিসোর্টে অনেক ধরনের ফলমূলের গাছ আছে, চলুন ঘুরে দেখাই।’
আমরা রাজি হয়ে গেলাম। অনেক ধরনের ফলমূলের গাছ। ফল ঝুলে আছে।
এত ফল আপনারা কী করেন? বিক্রি করেন?
না। নিজে খাই এবং আমার সহকর্মীদের মধ্যে ভাগ করে দিই।
খুব মার্জিত, ভদ্রলোক তিনি। তাঁকে বললাম, ‘সমুদ্রসৈকতে যাওয়ার রাস্তা কোন দিকে?’ তিনি অনেকটা পথ হেঁটে রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। অতঃপর বউ টুকটাক বাজার করল পাশের দোকান থেকে। রুমে ফিরে দেখি, ছেলে তার ফোন নিয়েই ব্যস্ত। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছে। লন্ডনে।
বাংলাদেশে একটু ফোন করা দরকার। বাংলাদেশে আগামীকাল ঈদ। ভাই-বোনদের ঈদের প্রস্তুতি কেমন। গরু কিনল কি না, এসব।
প্রথম ফোন দিলাম দিনাজপুরে। আমার ছোট বোন শিরিনের কাছে। তার গরু কেনা শেষ। দাম পড়েছে ৬৯ হাজার। তাকে বললাম, ‘আয় তোকে হোটেল দেখাই। যে অ্যাপার্টমেন্টে আমরা আছি।’
‘দেখাও, দেখাও।’
ভিডিও অন করলাম। সব দেখে সে খুব খুশি। ফোন করলাম লন্ডনে থাকা বোন পলিনকেও। তাদের আজ ঈদ। কুশল বিনিময়ের পর বলল, ‘ছোটপা বলছে, তোমাদের হোটেল নাকি বেশ সুন্দর।’
‘দেখবি?’
‘দেখাও।’
ভিডিও অন হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর দেখি, যে বউ হোটেল খারাপ বলে নাক উঁচুতে তুলেছিল, সে-ও দেখি আনন্দের সঙ্গে এখন তার এক প্রিয়জনকে ভিডিও মারফত অ্যাপার্টমেন্ট দেখাচ্ছে। হায় রে মানুষ। তুমি আসলেই আকাশ। রং বদলাতে কতক্ষণ!
ফোন করলাম আমার ভাইকে। সুনামগঞ্জে। তাকে বললাম, ‘লন্ডনের ডাক্তার আমাকে এনজিওগ্রাম করতে বলেছে। তারা সন্দেহ করছে, আমার হার্টে একটা ব্লক থাকতে পারে। লন্ডনে ফিরে এনজিওগ্রাম করাব।’ আমার ভাই অস্থির হয়ে উঠল। ‘এইটা খাবি না, ওইটা খাবি, ভয় পাস না।’  

বুঝলাম, পৃথিবীটা মায়ার ফিতায় বাঁধা। হাজারো মাইল দূরে আছি, তারপরও দেশ জেগে আছে, জেগে আছে প্রিয় কিছু মুখ এ দুর্বল হৃদয়ে। হৃদয়ের কোনো দেশ নেই। বিভাজন নেই। যখন যেখানে যাবে, সেখানের কিছু মুখ তোমার প্রিয় হবে, কিছু গাছপালা, নদীর তরঙ্গ, পাখির উড়াল।

তুরস্ককে ভালোবাসতে শুরু করেছি। এখানকার মানুষেরা বেশ ভালো। যদি টের পায় আপনি মুসলিম, লম্বা করে একটা সালাম দেবে। অনেক দোকানে দেখলাম, বিড়ালছানা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিড়াল ভালোবাসে তারা। তবে বাংলাদেশের মতো বেওয়ারিশ কুকুরও আছে এখানে। ওরা ঐতিহ্যে বিশ্বাস করে। যেমন কোনো কোনো বাড়িতে দুটি দরজার হ্যান্ডেল থাকে। একটা ছোট, একটা বড়। ছোটটা নাড়লে বাড়ির লোক বুঝতে পারে, নারী অতিথি এসেছে। বড়টা নাড়লে পুরুষ অতিথি। খুব মজার ব্যাপার না! মজার ব্যাপার আরও আছে। কারও বাড়িতে গেলে আপনাকে চা দেবে, সঙ্গে পানি। যদি পানি খান, তাহলে ওরা বুঝবে, আপনি ক্ষুধার্ত। আপনাকে খাবার দেবে। আর যদি চা পান করেন, তাহলে বুঝবে, ক্ষুধার্ত নন। আপনার জন্য খাবারের কোনো আয়োজন থাকবে না। তুরস্কের লোকেরা হরেক রকম চা খায়। হুঁকা টানে, যাকে কেউ কেউ বলে সিসা।

ফোন আলাপ শেষ হলো দেশে থাকা প্রিয়জনদের সঙ্গে। বউকে বললাম, ‘চলো, কফি খেয়ে সমুদ্র দেখতে যাই।’ বউ কফি বানাল। বারান্দায় পাতা চেয়ারে বসলাম আমরা তিনজন। টেবিলে রাখা আছে কেক। কফি খেতে খেতে খেয়াল করলাম, বয়স্ক এক নারী রোদে কাপড় শুকাচ্ছেন, আমাদের পাশেই। তাঁর সঙ্গে কথা শুরু করে দিলাম। তিনি তেমন ইংরেজি বলতে পারেন না। কথায় বুঝলাম, তিনি এ রিসোর্টেরই একজন কর্মী। তাঁর কাজ হচ্ছে লন্ড্রির কাজ। তিনি অঙ্গভঙ্গি দিয়ে আমাদের বোঝাতে চাইলেন, তিনি সারাক্ষণ কাজ করেন। তাঁর মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগেই থাকল। তাঁকে কোনোভাবেই চেনাতে পারলাম না আমাদের দেশ, বাংলাদেশকে। বোঝা গেল, তিনি এই দেশের নাম জানেনই না। শুধু পাকিস্তান চিনতে পারলেন। হয়তো তেমন লেখাপড়া জানেন না তিনি।

হঠাৎ কলিং বেল বাজল। কে এল? দরজা খুলে দেখি, তিন লোক দাঁড়ানো। তাঁরা এসি ঠিক করতে এসেছেন। রুমের দুই এসির মধ্যে একটা কাজ করছে না। তাঁরা বিকল এসি চেক করলেন। তাঁদের বললাম, ‘সমস্যা কী?’

তাঁরা ইংরেজি জানেন না। তাতে কী? পকেট থেকে মোবাইল বের করে গুগল ট্রান্সলেট দিয়ে আমাদের বোঝালেন, এসির গ্যাস শেষ হয়ে গেছে। এটা আপাতত ব্যবহার করা যাবে না। কাল ঠিক করে দেবেন। ফোন করলেন অভ্যর্থনা কক্ষ থেকেও। তাঁরা দুঃখ প্রকাশ করলেন, আর বললেন, এসির জন্য তাঁরা যে রোজ ৮ পাউন্ড চার্জ করেন, তা আপাতত দেওয়া লাগবে না। শুনে খুশি হলাম।

অতঃপর কফি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা তিনজন। সমুদ্রসৈকতের দূরত্ব ৫-৭ মিনিট। সৈকতে আনন্দে ভরে গেল মন। চমৎকার সাজানো চারপাশ। সৈকতে চমৎকার সব ছাতায় সুশোভিত। বালুর সৈকত। চারদিকে মায়া মায়া বিকেল। আকাশে উড়ছে ঘুড়ি। স্বল্প পোশাকের সাদা রমণীরা হয়ে উঠছেন একেকজন ক্লিওপেট্রা। বাতাস উড়িয়ে নেয় চুল। সমুদ্রতীরে অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন হোটেল। সরব রেস্তোরাঁ। আমি আর আমার স্ত্রী বালুকাময় সৈকতে হাঁটতে শুরু করলাম। স্পর্শ নিলাম বিস্তৃত জলের। সন্ধ্যা নেমে আসছে। ঘরে ফিরতে মন চাইছে না। ইচ্ছা হচ্ছে শুয়ে থাকি। বাতাস খাই। হাওরের বাতাস খেয়ে বড় হওয়া লোক আমি। জল দেখলে গলে যাই, বাতাস পেলে উদাস হই। আহা।
হঠাৎ স্ত্রী বলল, ‘ছেলে কোথায় গেল, চলো একটু খুঁজি।’

কোথায় আর যাবে! নিশ্চয় কোথাও বসে মোবাইল টিপছে। এই প্রজন্মের কাছে প্রকৃতির চেয়ে মোবাইল বড়। পরিবারের চেয়ে অনলাইন।

ছেলেকে খুঁজে পাওয়া গেল। আমার ধারণাই সত্য। সে মোবাইল নিয়েই আছে। ছাতার নিচে শুয়ে গান শুনছে। তাকে বললাম, ‘চলো, টুকটাক শপিং করি। ফেরার পথে কোনো রেস্তোরাঁয়, রাতের খাবার সেরে নেব।’

আমরা তিনজন হেঁটে হেঁটে শপিং সেন্টারের দিকে যাব, অমনি পেয়ে বসল এক সেলসম্যান। বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় অফার দিতে লাগল আমাদের। একসময় আমরা তার কথার মারপ্যাঁচে বন্দী হলাম। আমরা একটা অফার নিলাম, শনিবারে তারা আমাদের কাঠের জাহাজে ওঠাবে। সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত রাখবে জাহাজে। ঘুরিয়ে দেখাবে সিডে শহর। খানাপিনা ফ্রি। তিনজনের জন্য দিতে হবে ৫০ পাউন্ড। ১০ পাউন্ড দিয়ে বুকিং দিলাম। এখানে ফিক্সড দামে বেচাবিকি হয় কম। ১০ ইউরো বললে ৫ ইউরোতেই দিয়ে দেয়। অনেক সময়। এ দেশের মুদ্রার নাম লিরা। লিরার পাশাপাশি ইউরোপের মুদ্রা ইউরোও বহুল প্রচলিত। প্রায় সব দোকানেই ইউরো, পাউন্ড, ডলার দিয়ে কেনাকাটা করা যায়।
সন্ধ্যার পর তুরস্কের রাস্তা আলোঝলমল হয়ে উঠেছে। দোকানে খুব একটা ভিড় নেই। প্রায় দোকানের সামনেই প্রশস্ত জায়গা। অনেক দোকানি সেখানে চেয়ার-টেবিল পেতে রেখেছেন। দোকানে খদ্দের না থাকলে এখানে বসে বাতাস খান, চা পান করেন, হুঁকা টানেন। আরামের দোকানদারি। কেনাকাটা শুরু করলাম। চারদিকে ম্যাসাজ পারলার, হাম্মামখানা। হাম্মাম হচ্ছে একধরনের ফোম দিয়ে গোসল।

আপনাকে গোসল করিয়ে দেবে কোনো নারী কিংবা পুরুষ। এক জায়গায় দেখি, বাপ-ছেলে অ্যাকুয়ারিয়ামে পা ঢুকিয়ে বসে আছে। মাছে ঠুকর দিচ্ছে তাদের পা। এ অনুভূতি পেতে লাগে ৫ ইউরো। ছেলে বলল, সে-ও পা ঢোকাবে। ছেলেকে বললাম, আজ নয়, রাত অনেক হয়ে গেছে, রেস্তোরাঁয় খেয়ে রুমে ফিরতে হবে। ঢুকলাম স্তেইক হাউসে। ছেলে কাঁচা মাংসের স্বাদ নেবে। রেস্তোরাঁটা বেশ আলোঝলমলে। খদ্দেরে পূর্ণ। লাইভ কনসার্ট চলছে। আমাদের একটা টেবিল দিল আকাশের নিচে। তার মানে, ব্যালকনিতে । আকাশ দেখা যায়, রেস্তোরাঁর লোকজনও। অর্ডার করলাম। খেতে খেতে গান শুনতে ভালোই লাগছে। চারদিকে রঙিন বাতি। আবহাওয়াও চমৎকার। না শীত, না গরম। বিল এল ৫০ পাউন্ড। মানে ৭ হাজার টাকা। বিল মিটিয়ে পথ ধরলাম। অ্যাপার্টমেন্ট ১৫ মিনিটের পথ। চারপাশে দোকানপাট। দোকান দেখলেই বউ ঢুকবে। ব্যাগ ও জুতার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা। ছেলে আর বউ এটা-সেটা কিনল। এখানে অনেক ব্র্যান্ডের আইটেম পাওয়া যায়। এগুলোর বেশির ভাগই নকল। দামও কম। ছেলে কিনল তার প্রিয় দল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তিনটি টি-শার্ট, ২২ পাউন্ডে। রাত ১১টায় ফিরলাম। নামাজ পড়ে ঘুমাতে ঘুমাতে ১টা। চলবে...

**দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা [email protected]