অকৃতজ্ঞতা: কারণ, প্রভাব ও করণীয়
অকৃতজ্ঞতা হলো এমন একটি আচরণ, যা সাধারণত তাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যারা অন্যের উপকার থেকে উপকৃত হয়, কিন্তু পরে সেই উপকারের কোনো মূল্যায়ন করে না, বরং অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে।
বিভিন্ন সমাজে নানা সময়ে এ ধরনের আচরণ দেখা যায়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক ও স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়।
বর্তমান সময়ে আমরা প্রায়ই দেখি, যাকে সাহায্য করা হয় সে সাহায্য পাওয়ার পরই পরিবর্তিত হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে ধরুন, কেউ তার আর্থিক সংকটে আপনার থেকে ঋণ নিয়েছে। যখন তার সমস্যা কাটিয়ে উঠেছে এবং আপনি ঋণের অর্থ ফেরত চাইছেন, তখন সে নানা অজুহাত দেখিয়ে টালবাহানা করছে। শুধু তা–ই নয়, অনেক সময় ঋণ ফেরত চাওয়ার কারণে আপনার বদনাম করা, কটূক্তি করা, এমনকি সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্নের চেষ্টাও করে।
আমি নিজে আমার খুব কাছের এক আত্মীয়কে ছয় বছর ধরে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছি। তাকে বিদেশে পড়াশোনা করতে সহায়তা করেছি, তার সব দায়িত্ব নিয়েছি এবং তাকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছি। অথচ বিনিময়ে সে ও তার স্ত্রী আমার বিরুদ্ধে নানা রকম বদনাম রটিয়েছে, অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে। এ ধরনের অভিজ্ঞতা একদিকে মনোবল ভেঙে দেয়, অন্যদিকে ভবিষ্যতে অন্যদের সাহায্য করার ইচ্ছাকে দমিয়ে দেয়।
ইসলাম ধর্মে এ বিষয়গুলোর ওপর ভালো গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কৃতজ্ঞতা, দায়িত্ববোধ ও মানবিকতা ইসলাম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অথচ আমাদের দেশে এই নৈতিকতার চর্চা খুবই কম। পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় আমরা দেখি, সাহায্যপ্রাপ্তরা সাধারণত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং সুযোগ পেলে অন্যদের সাহায্য করতে উদারতা প্রদর্শন করে। এই বৈপরীত্যের মূল কারণ হতে পারে আমাদের সমাজের নৈতিক শিক্ষা ও মানসিকতার পার্থক্য
অনেক সময় বলা হয়, শিক্ষার অভাবে মানুষ অকৃতজ্ঞ হয়। কিন্তু আমার দেখা ও জানামতে, শিক্ষিত সমাজই বেশি অকৃতজ্ঞ হয়ে থাকে। এর পেছনের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ব্যক্তিগত লাভ ও স্বার্থপরতা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ সঠিকভাবে শেখানো হয় না।
নামকরা বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া ব্যক্তিরাই কিন্তু সমাজের বড় বড় দায়িত্ব পালন করেন। অথচ তাঁরাই দেশের বারোটা বাজিয়ে চলেছেন। এটি একধরনের ‘নুন খেয়ে নিমকহারামি’। তাঁরা দেশের সম্পদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে পরে দেশের সর্বনাশ করেন এবং ব্যক্তির কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে পরে তাঁকে ধোঁকা দেন, যা একই ধরনের অপরাধের শামিল।
মানুষের এই অকৃতজ্ঞতা ও নিমকহারামির মূল কারণের মধ্যে অন্যতম হলো মানসিক সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা এবং সঠিক নৈতিক শিক্ষার অভাব। অনেকেই মনে করে, একবার সাহায্য পেয়ে গেলে সেটি তাদের অধিকার হয়ে যায় এবং সাহায্যদাতার প্রতি তাদের কোনো দায়িত্ব থাকে না। আমাদের উচিত এ সমস্যার মূলে আঘাত করা। সমাজে সঠিক নৈতিক শিক্ষা প্রচার করা এবং ব্যক্তিগত মানসিকতার পরিবর্তন আনা। একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের উচিত সাহায্য পেয়ে কৃতজ্ঞ থাকা এবং সেই সাহায্যের সঠিক মূল্যায়ন করা। যেমন একটি কুকুরের উপকার করুন, দেখবেন রাত জেগে সে আপনার বাড়ি পাহারা দেবে। অন্যদিকে মানুষের উপকার করবেন, দেখবেন সবচেয়ে বড় বাঁশটা সে আপনাকেই দেবে।
অন্যদিকে যাঁরা সাহায্য করেন তাঁদেরও সচেতন থাকা উচিত এবং নির্দিষ্ট শর্তে সাহায্য প্রদান করা উচিত। প্রয়োজনে লিখিত চুক্তি করা বা আইনগত সাহায্য নেওয়া যেতে পারে, যাতে পরবর্তী সময়ে কোনো সমস্যা না হয়। দরকারে এদের মুখোশ খুলে দিতে হবে। সমাজে প্রকাশ্যে এদের চিহ্নিত করে সবাইকে অবগত করতে হবে, যেন সবাই এ ধরনের কুৎসিত ও অরুচিসম্পন্নদের থেকে দূরে থাকে। আমাদের কঠিন হতে হবে বিচারকের কাঠগড়ায় এবং ন্যায়সংগত বিচার বিভাগ মনের মধ্যে তৈরি করতে হবে। তবে যদি কেউ অনুতপ্ত হয়, অবশ্যই তাকে ক্ষমা করতে হবে।
এ ধরনের অকৃতজ্ঞ মানুষের কারণে সমাজে সাহায্য করার মনোবল কমে যেতে পারে। কিন্তু আমাদের উচিত নৈতিকতা ও মানবিকতার পথে অবিচল থাকা। সমাজের প্রতিটি স্তরে এই নৈতিকতার প্রচার করতে পারলে, আমরা নিমকহারামির এই চক্র থেকে মুক্তি পেতে পারি। যারা অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দেয়, তাদের নিজেদের আচরণের ফল ভোগ করতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের সঠিক স্থানে প্রতিস্থাপিত হবে। একজন ভালো মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত সর্বদা ন্যায় ও সত্যের পথে থেকে অন্যদের সাহায্য করা। কারণ, একটি সুন্দর ও মানবিক সমাজ গড়তে এটাই আমাদের দায়িত্ব।