দেব খোঁপায় তারার ফুল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আজকে ছুটির দিন রিশার। ছুটির দিন মানে অফিসের কাজ নেই, কিন্তু বাজার করা, রান্না করা, সানির (ওর স্বামী) ওষুধ গুছিয়ে রাখাসহ আরও কত কাজ বাকি ওর। সকালবেলা ছোট্ট বাবাটার নাশতা রেডি করেছে ও। স্কুল না থাকলে ভোরবেলা উঠে যায় কেন জানি ও। রাফসানকে (ওদের ছেলে) নাশতা দিয়ে রিশা এক কাপ চা হাতে বারান্দায় বসে রাস্তায় মানুষের আনাগোনা দেখল কিছুক্ষণ। একটু পরেই সানি উঠবে। অসুস্থ মানুষ আবার সকালবেলা উঠতে পারে না। ওকে ঘুমে রেখেই রাফসানকে স্কুলে নামিয়ে কাজে চলে যায় ও অন্যান্য দিন। কত দিন মুখ পুড়িয়েছে ও আগুন–গরম চা শেষ করে অফিসে যাবে বলে। আজকে আরাম করে চা শেষ করবে।

একটু পর রান্নাঘর থেকে টুনটুন শব্দ ভেসে আসতেই রিশা দৌড়ে রান্নাঘরে এল। দেখল, সানি কী যেন করছে। বলল, উঠে গেছ? যাও, তৈরি হয়ে এসো, আমরা নাশতা খাব। সানি মিটিমিটি হেসে বলল, না রিশা, বসো প্লিজ। আজকের দিনে এক কাপ চা অন্তত আমাকে বানাতে দাও তোমার জন্য। কী এমন দিন আজকে ভাবতে ভাবতে রিশা কাপড় বদলাতে চলে গেল। বাজারে যেতে হবে। একটু দেরি করে গেলে পছন্দসই ফ্রেশ সবজি পাবে না।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

রেডি হয়ে এসে দেখে নাশতা সুন্দর করে সাজিয়ে বসে আছে সানি। সঙ্গে ছোট্ট ফুলদানিতে একগুচ্ছ ঘাসফুল। রিয়া বলল, আরে কী ব্যাপার? সানি বলল, ভাগ্য ভালো আমি কাজী নজরুল নই, আর তুমি নজরুলের প্রেমিকা নও। নয়তো তোমার জন্য তো তারার ফুল, তৃতীয়া তিথির চাঁদের দুল এনে তোমাকে সাজাতে হতো, তাই না? অসুখে খিটখিটে হয়ে যাওয়া সানির এত কেয়ারিং কথাগুলো সেই বিয়ের প্রথম বছর ছাড়া শেষ কবে শুনেছে, মনে করতে পারল না রিশা। মন ভালো করে রওনা দিল বাজারে। আহা, প্রতিটি ছুটির দিন যদি এত আনন্দের হতো, কোনো কষ্ট ওর গায়েই লাগত না।

আজকে বাজারে অনেক সরজি উঠেছে, ঝিঙে কিনতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তিতা হবে না তো, মামা। হবে না লন। তারপর নিল শজনে ডাঁটা আর পুঁই শাক, একটি রুই মাছ মাঝারি মাপের আর মুরগি। সপ্তাহের বাজার দরাদরি করে কিনতে গিয়ে পিপাসা পেয়ে গেল ওর। তিনটা জুস নিয়ে নিল। ওর ছেলে রাফসানের ভীষণ প্রিয় এ জুস। রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরতে গিয়ে কেন যেন বারবার মনে পড়ছে রিশার সাউথ আফ্রিকার দিনগুলোর কথা। সানির রোমান্টিক ব্যবহার, অনেক কেয়ারিং আচরণ...বিয়ের পরপর সানির সঙ্গে চলে গিয়েছিল ও সাউথ আফ্রিকা। ও দেশে ড্রাইভার নিয়ে যেত গ্রোসারিতে ওদের। কত আরামের কয়েকটা বছর কেটেছিল। গাছপালাঘেরা ছোট্ট দোতলা বাড়িতে ওরা ভাড়া থাকত। রাফসানের জন্মও ওই দেশেই। কাজ করার লোক পাওয়া যেত। ছোট্ট বাবার দেখাশোনা করতে ওদের তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। নতুন চাকরিতেও যোগ করেছিল রিশা।

তিন বছরের মাথায় সানির হঠাৎ হঠাৎ অনেক মাথাব্যথা শুরু হয়েছিল। রিশার জোরাজুরিতেই চিকিৎসকের কাছে গেল সানি। চিকিৎসক বলেছিলেন, নিজের এতটুকু খেয়াল রাখেননি, সানি সাহেব। আপনার ব্লাড প্রেশার অসম্ভব বেশি। ল্যাব রেজাল্টে দেখা যাচ্ছে, দুটি কিডনিই নষ্ট। সানি একদম ভেঙে পড়েছিল। রিশা কিছুদিন একা একা চাকরি করে চেষ্টা করেছিল সাউথ আফ্রিকা থেকে যেতে। ছোট রাফসানকে নিয়ে পারেনি। তারপর সানির কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা লাগবে। ভারত ছাড়া সেটা সম্ভব হবে না। অনেক ভেবেচিন্তে দেশে চলে এসেছিল ওরা।

মায়ের কাছে রাফসানকে রেখে রিশার শুরু করেছিল এক সংগ্রামী জীবন। অভিমানী সানি কারও কাছে যাবে না সাহায্য চাইতে। চাকরি করে টাকা জমিয়ে ভেলোরে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করিয়েছে রিশা সানির তিন বছরের মাথায়। সবাই তখন বলত, পারবে না এত কিছু করতে। কিন্তু রিশার সামনে ওর সংসারটা টিকিয়ে রাখার স্বপ্ন। ছোট্ট রাফসান কি বাবা ছাড়া বড় হবে? রিশা এ ক্লান্তিময় পথ পার হতে পেরেছে। মানুষটা ভালো আছে, তবে মেজাজটা সব সময়ের জন্য খুব খিটখিটে হয়ে গেছে সানির। সবকিছুতেই খুঁত খোঁজে ও। বাজার করে আনলে বলে মাছ ফ্রেশ নয়, তরকারিতে লবণ কম, স্বাদ কম। রিশা শাড়ির আঁচলে মুখ মুছল। তবু তো রাফসান বাবার বুকে মাঝেমধ্যে ঘুমায়। বাবাকে সঙ্গে নিয়েই বড় হচ্ছে সে। এটা অনেক বড় পাওয়া।

লেখক
ছবি: সংগৃহীত

বাসার সামনে চলে এল এত কিছু ভাবতে ভাবতে রিশা। আজকের রিকশাওয়ালা বাজার লিফট পর্যন্ত আর এগিয়ে দিলেন না। যে গরম, কী আর বলবে রিশা। কষ্ট করে বাসা পর্যন্ত চলে এল ও। ভেতরে ঢুকে দেখল, সানি মিটিমিটি হাসছে। বাসায় রান্নার গন্ধ। রিশা অবাক হয়ে তাকাতেই সানি বলল আজকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, বউ। ঘরে-বাইরে সবাই পালন করছে, আমরাও করব। আমার কঠিন পরিশ্রমী বউ যে এভাবে মৃত্যুর হাত থেকে এতগুলো বছর বাঁচিয়ে রেখেছে, সেটা আমার সব সময় মনে থাকে।

শরীর খারাপ লাগে তো, তাই অমন করি। হাত মুখ–ধুয়ে খেতে এসো, আমরা ডিম–খিচুড়ি খাব। বুয়া আসেনি, তাই রেঁধেছি আমি। আনন্দের অশ্রু রিশার চোখ ঝাপসা করে রেখেছে। ও শুনল, সানি টেবিল সাজাতে সাজাতে গুনগুন করে গাইছে—

‘মোর প্রিয়া হবে এস রাণী,/ দেব খোঁপায় তারার ফুল।’