লায়লা চৌধুরীকে মনে পড়ে

ছবি রেজা সিদ্দিকের সৌজন্যে

মানুষের যেকোনো বিপদ–আপদ অথবা প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানো বা যেকোনো মানুষের আনন্দে শরিক হওয়ার উদারতা মুক্তিযোদ্ধা কামরুল চৌধুরী ও তাঁর জীবনসঙ্গিনী লায়লা চৌধুরীর সহজাত চারিত্রিক গুণ। তাই তরুণ বয়সে একা একা ঘাটে ঘুরে বেড়ানো গায়ে ঘা ছোট্ট মিন্টুকে আগলে নিয়ে এসে পরম মমতায় ধুয়েমুছে ঠাঁই খুঁজে দেওয়ার কাজটি করতে পেরেছিলেন কামরুল ভাইয়ের মতো মানুষই। আজ কামরুল চৌধুরীর কথা থাক, বলি লায়লা চৌধুরীর কথা। উনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন আজ বছর হয়ে গেল। এখনো ঘুরেফিরে তাঁর কথা আলোচনায় আসে।

কামরুল ভাইয়ের স্ত্রী লায়লা চৌধুরী একজন অসাধারণ মানুষ। তাঁর উপস্থিতি সরবে উচ্চকিত নয়। চলনে–বলনে ধীরস্থির লায়লা ভাবি যেন ‘আলোর পানে প্রাণের চলা’। তাঁর অনেক কথাই বলা যায়, তবে লায়লা চৌধুরীকে বোঝার জন্য দুটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি।

একবার এক ভারতীয় বন্ধুর নিমন্ত্রণে গিয়েছি। ওখানে সমবেত ব্যক্তিদের মধ্যে আমার পরিচিতজন কম। একটি টেবিল থেকে পরিচিত মুখ অম্বলী মাসিমা ডাকলেন। কাছে গিয়েই বসলাম। ওই টেবিলে বসা অন্যরা জানতে চাইলেন, আমি ভারতের কোন শহর থেকে এসেছি। মাসিমা হইহই করে উঠলেন ‘আরে বলছ কী তোমরা? ও আমার বাংলাদেশের মেয়ে।’ মাসিমা নিজে বাংলাদেশের মানুষ, বিয়ে হয়েছে ভারতে। তবে বাংলাদেশের জন্য আজও তাঁর টান গভীর। ওই দিন ওই টেবিলে বসা সবার মুখে বাংলাদেশিদের হৃদ্যতার গল্প শুনে মনটা ভরে গেল। একজন শোনালেন লায়লা চৌধুরীর এক ঘটনা।

ঘটনা হলো, এক তরুণ দম্পত্তি ভারত থেকে অভিবাসন নিয়ে এসেছেন। ভারতের অবস্থাপন্ন শ্রেণির মানুষ তাঁরা। বিদেশে তাঁদের কষ্ট বেশিই হচ্ছিল। তরুণের চাকরি হতে দেরি হচ্ছিল দেখে তাঁর বউ বাচ্চাসহ দেশে ফিরে যান। তার পরপরই তরুণের চাকরি হয়। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বউ–বাচ্চাও অস্ট্রেলিয়ায় আসার জন্য প্লেনে উঠে। দুঃখজনকভাবে যেদিন মেলবোর্নে তাঁদের পৌঁছার কথা, সেদিনই শাওয়ার করার সময়ে স্ট্রোক করে তরুণের মৃত্যু হয়। চারপাশে সবাই হতভম্ব। কে নেবে তরুণের শেষকৃত্যের ভার? কাকে বলা যায় কাজটি করতে? কে মরদেহ দেশে পাঠানোর খরচ বহন করবে ইত্যাদি প্রশ্ন যখন কমিউনিটিতে উঠছে, তখন নাকি লায়লা চৌধুরী শেষকৃত্যের সব খরচ বহন করার জন্য এগিয়ে আসেন। টেবিলের সবাই বাংলাদেশের মানুষের মন অনেক বড়, এসব বলাবলি করছিলেন তখন। ব্যাপারটা যেকোনো বাংলাদেশির জন্য আনন্দের ও গর্বের। লায়লা চৌধুরীর গভীর ভালো মনের পরিচয় জানা হলো, তা–ও ভিনদেশি কয়েকজন ব্যক্তির কাছ থেকে, এটা কম কথা নয়।

‘দূর পরবাস’–এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]

এরপরের ঘটনা হলো আমার অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। আমার বন্ধু, ছোট বোনের মতো এক তরুণী, যার নাম পান্না। নিজে চিকিৎসক ছিল, তা–ও এত বড় অসুখ যে শরীরে দানা বেধেছিল, তা বুঝতেই পারেনি। কঠিন সে অসুখ। অর্থবিত্ত, সফল পেশাগত জীবন, চারপাশে সহৃদয় বন্ধুবান্ধব—কোনো কিছুর কমতি ছিল না তার। তাকে কষ্টের মধ্যে সময় পার করতে হচ্ছিল। আমার মনটা ভীষণ, ভীষণ খারাপ। এর মধ্যে পবিত্র রমজান মাস শুরু হলো। মন খারাপের সেই সময়ে আমি তার মঙ্গল চেয়ে আল্লাহর কাছে খতমে তাহলিল পড়ার জন্য প্রতিশ্রুত হলাম। শুধু আল্লাহ নন, আমার বিবেকের কাছেও আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বন্ধুটি আমার নিজে চিকিৎসক, অর্থের তার প্রয়োজন নেই। আল্লাহর দয়া ও সহায়তা চেয়ে অঞ্জলি পাতলাম। সোয়া লাখবার দোয়াটি পড়তে হবে। এর সঙ্গে দরুদ শরিফও পড়তে হবে। কঠিন কাজ সন্দেহ নেই। কাকে বলব আমার সঙ্গে পড়তে? সবাই ব্যস্ত। ঘনিষ্ঠরা যে যাঁর মতো করে তার জন্য দোয়া–কালাম পড়ছেন। আমার ইচ্ছা, পবিত্র রমজানের মধ্যেই খতমটি শেষ করার। আমার বিষণ্ন ও ব্যাকুলতা দেখে, আমার কর্মব্যস্ত কন্যা রত্না বলল, সেও চেষ্টা করবে কিছু তাসবিহ পড়ে দিতে।

একদিন নিবেদিত মনে তাসবিহ জপছি তো জপেই যাচ্ছি। ফোন বাজল। লায়লা ভাবির ফোন। আমি ভীত ছিলাম ভেবে যে, পবিত্র রমজানের মধ্যে মানত শেষ করতে পারব কি না। খতমে তাহলিল পড়ছি শুনে লায়লা ভাবি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, উনিও এই দোয়ায় শরিক হবেন। আমি প্রতিদিন কত হাজার পড়েছি, তা ডায়েরির পাতায় তারিখ দিয়ে দিয়ে লিখে রাখতাম। লায়লা ভাবি শত ব্যস্ততার মধ্যেও পড়ে গিয়েছেন। কয়েক হাজার হলেই আমাকে জানাতেন। আমিও নিষ্ঠার সঙ্গে তাসবিহর হিসাব লিখতাম। এমনকি সাহ্‌রির সময়ও আমি কখনো কখনো লায়লা ভাবির মেসেজ পেয়ে ডায়েরিতে তাঁর নামের পাশে তাসবিহর হিসাব লিখেছি। করুণাময়ের কৃপায় শবে কদরের (২৭ রোজা) মধ্যেই খতমে তাহলিল পড়া শেষ হলো। কৃতজ্ঞ আল্লাহর কাছে যে লায়লা ভাবির মতো নিঃস্বার্থ বন্ধু সহায়তা করেছেন বলেই খতমটি নিয়ত অনুযায়ী সময়মতো শেষ করা গিয়েছিল।

লায়লা ভাবি কোভিড–পরবর্তী কাশিতে ভুগছিলেন। চেন্নাই গিয়েছিলেন বড় মেয়ে পিয়ার কাছে বেড়াতে। ওখানে সে ছিল অস্ট্রেলীয় সরকারের ভারতে নিয়োজিত বাণিজ্য প্রতিনিধি। লায়লা ভাবির শরীরটা ওখানে খারাপ করল। চিকিৎসার কোনো কমতি হয়নি। তারপরও তাঁকে ধরে রাখা গেল না। তিন সন্তান পিয়া, নূপুর (অস্ট্রেলিয়ার মাস্টারশেফ–জয়ী কিশোয়ার চৌধুরী), সারা ও জীবনসঙ্গী কামরুল চৌধুরীকে রেখে চলে গেলেন কোথায়, কোন অজানায়? তাঁর আসীন জান্নাতুল ফেরদৌসে হোক, এই প্রার্থনা।

কামরুল চৌধুরী ও লায়লা চৌধুরীর মতো কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা নিভৃতে ও নীরবে মানুষকে সাহায্য করেই সুখী ও তৃপ্ত।