থাইল্যান্ড ডায়েরি: ভালো কিছু গ্রহণ করার মানসিকতা
কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন স্যারের ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাস চোখে পড়ল। স্ট্যাটাসটি হুবহু এ রকম, ‘যেদিন দেখবেন ভিসির নাম ছাত্র–ছাত্রী এমনকি শিক্ষকদেরও অনেকেই জানে না, সেদিন বুঝবেন, এটি একটি সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে।’ স্ট্যাটাসটি দেখে আমার মনে হলো, থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এআইটি) এক বছরের বেশি সময় ধরে পড়ছি। সত্যিই তো, এআইটির প্রেসিডেন্ট (এখানে ভাইস চ্যান্সেলেরকে প্রেসিডেন্ট বলা হয়) স্যারের নাম আমি তো জানি না! শুধু আমি নই, আমার মতো এ রকম অনেক শিক্ষার্থীই আছেন, যাঁরা ওনার নাম জানেন না বা ওনাকে চেনার তেমন কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেন না। শুধু কয়েকটি অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখেছি বক্তব্য দিতে। ভদ্রলোক জাপানিজ। ওনাকে দেখেই মনে হয়েছে, খুব সাধারণ জীবনযাপন করেন। তবে ওনার একাডেমিক ও প্রশাসনিক যোগ্যতা অসাধারণ।
এআইটির লাইব্রেরি সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার সময় রাত তিনটা পর্যন্ত খোলা থাকে। বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি শেষে রাত আড়াইটার সময় আমি যখন লাইব্রেরি থেকে ডরমিটরিতে ফিরব, তখন আমার এক ফিলিপিনো বান্ধবীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি এখন রুমে যাবে কি না? গেলে আমি তোমার হোস্টেল পর্যন্ত তোমাকে পৌঁছে দিতে পারি।’ আমার কথা শুনে সে অবাক হয়ে গেল। মানে এ রকম প্রশ্নের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। আমি তখন ভাবলাম তাই তো, আমাদের দেশে সন্ধ্যার পরে মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বের হতে পারেন না। আর এখানে রাত তিনটার সময় ক্যাম্পাসের লাইব্রেরি থেকে একটা মেয়ে একা একা হোস্টেলে চলে যাবে! নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি সহযোগিতা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। আসলে ক্যাম্পাসে রাত তিনটা বলেন আর যে সময়ই বলেন, প্রত্যেক শিক্ষার্থীই নিজেকে নিরাপদ বোধ করেন।
গত সেমিস্টারে একটা টেকনিক্যাল কোর্সে অনেক পড়াশোনা করেছি। তারপরও আত্মবিশ্বাস পাচ্ছিলাম না। পরীক্ষার হলে আমার পেছনে সিট পড়া এক ক্লাসমেটকে বললাম, ‘সুযোগ পেলে আমরা অঙ্কের উত্তর মিলাব।’ এটা শুনে সে এমনভাবে তাকাল আমার দিকে, আমি সত্যি লজ্জায় পড়ে গেলাম। সে আমাকে বলল, ‘নো নো, ইট’স আনএথিক্যাল’। সত্যিই তো তা–ই! আমাদের অনেকেরই তো অভ্যাস আছে পরীক্ষার হলে পরিদর্শককে ফাঁকি দিয়ে অসৎ উপায় অবলম্বন করার। বলে রাখি, এখানে কোনো শিক্ষক সরাসরি পরীক্ষার ডিউটি করেন না। রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট (আরএ) বা টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট (টিএ) এই কাজগুলো করেন।
এখানে আমার প্রত্যেক শিক্ষক খুব বন্ধুসুলভ এবং অনেক আন্তরিক। যদি আমার অ্যাডভাইজর (সুপারভাইজার) স্যারের কথা বলি, আমার দেখা অন্যতম ভালো একজন মানুষ। আমার স্কলারশিপ থেকে শুরু করে সমস্ত প্রকার সহযোগিতা উনি আমাকে করেছিলেন। এমনকি প্রথম দিনে বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকক বিমানবন্দরে নেমে কীভাবে আইটিতে আসব, ট্যাক্সিভাড়া, বিমানবন্দরে ওয়াই–ফাই কীভাবে কানেক্ট করব, কীভাবে ডরমিটরি পাব—সবকিছুর তথ্য উনি আমাকে দিয়েছিলেন। ওনার ওই দিন সময় থাকলে উনি আমাকে নিজেই রিসিভ করতে বিমানবন্দরে যেতেন, যা সত্যিই আমার খুব ভালো লেগেছিল। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা শিক্ষার্থীর ই–মেইলের উত্তর দেন না, কল রিসিভ করেন না, অকারণে দুর্ব্যবহার করেন, ইচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষার্থীকে ফেল করিয়ে দেন, শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে নোংরা রাজনীতি করেন, যা মোটেও কাম্য নয়।
আমার নেপালি রুমমেট বয়সে আমার ছোট, কিন্তু এখানে এক বছরের অগ্রজ। তার আন্তরিকতা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। থাইল্যান্ডের সুন্দর সুন্দর জায়গা সে আমাকে চিনিয়েছে। সেই ইন্টারমিডিয়েট লাইফ থেকে আমি আজ অবধি যত রুমমেট পেয়েছি, তার মধ্য মনে রাখার মতো সে একজন। সেদিন আমার একটা চামচ তার হাতে ভেঙেছিল বলে কতবার যে সরি বলেছে, তা অকল্পনীয়। পরদিন দেখি, সে নতুন একটা চামচ কিনে এনেছে আমার জন্য। তা দেখে আমি নিজেই লজ্জিত হয়েছি। মানুষ এত ভালো হয় কী করে! আমার নেপালি বন্ধু ঐতিহ্যবাহী খাবার রান্না করে খাওয়ায় নিয়মিত। আমি চেস্টা করি, বাংলাদেশের অনেক মজার মজার রান্না করে খাওয়ানোর। তবে সে ঝাল খুব কম খায়।
এবার আসি অন্য রকম একটি অভিজ্ঞতা নিয়ে। ‘ম্যাক্রো’ এখানকার একটা নামকরা সুপারশপ। আমার রাইস কুকার নষ্ট হয়েছিল বলে প্রথমবার পরিবর্তন করতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন করে দিল। দ্বিতীয়বার একই সমস্যা হওয়ার কারণে একদম টাকা ফেরত দিয়েছিল, যা আমি সত্যিই আশা করিনি। ভেবেছিলাম, কয়েক দিন সময় নিবে বা ঘোরাবে। সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। কীভাবে এআইটিতে ফিরব, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। বোল্টে সার্চ দিয়ে কোনো ট্যাক্সি পাচ্ছিলাম না। উপায়ান্তর না দেখে শপিংমলের সিকিউরিটিকে বললাম। উনি আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। কিছুক্ষণ পরই দেখলাম তিনটা তরুণীকে রিসিভ করার জন্য একটা ট্যাক্সি আসল। ওনারা আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করলেন ওখানে যাওয়ার জন্য। মানে ওনারা আমাকে লিফট দিতে চান। আমার একটু অস্বস্তি লাগতেছিল এবং সত্যি কথা বলতে কি, ভয়ও পাচ্ছিলাম। পরে সিকিউরিটি গার্ড আমাকে নিশ্চিত করলেন, ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। ওনারা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই ঠামাসাট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন এবং ওখানেই যাবেন। তারপর আমি ওনাদের লিফট নিলাম। আমি একটা অপরিচিত যুবক ছেলে একই প্রাইভেট কারে অপরিচিত তিনটি মেয়ের সঙ্গে যাচ্ছি! সত্যি বিষয়টা আমার কাছে একটু অন্য রকম লেগেছিল। তাঁরা আমাকে এআইটি গেটে নামিয়ে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে গেলেন। সত্যিই থাইদের আন্তরিকতা প্রশংসাযোগ্য।
খুব আশ্চর্যের বিষয়, এই এক বছরে রাস্তায় একটা গাড়ির হর্ন শুনিনি। এমনকি একটা ট্রাফিক পুলিশও আমার চোখে পড়েনি। সবকিছু সিগন্যালের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রতিটি যানবাহন তাদের নির্দিষ্ট লেন অনুসরণ করে। নিয়ম ভাঙলেই কঠোর জরিমানা এবং লাইসেন্স বাতিল। কয়েক দিন আগে ব্যাংককে রাস্তা পার হওয়ার জন্য জেব্রা ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে আছি। গাড়ি অনেক দূরে আছে দেখে আমি পার হওয়ার জন্য যখন এক পা এগিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে একজন পথচারী আমার হাত টেনে ধরলেন এবং বললেন, ‘নো নো, ইউ আর নট পারমিটেড টু ক্রস দ্য রোড নাও’! কারণ, তখন পথচারী পার হওয়ার জন্য সিগন্যাল বাতি জলেনি। সেদিন সত্যি আমার খুব ভালো লেগেছিল। কত সুন্দর নিয়মকানুন মেনে চলে এখানকার মানুষ!
আসলে আমরা যাঁরা বাইরে পড়তে এসেছি, বিমানবন্দর পার হওয়ার পরই যখন ভালো কিছু দেখি, সেগুলো গ্রহণ করতে খুব ইচ্ছা করে। দেশে ফিরেই এগুলো প্রয়োগ করতে মন চায়। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের দেশের সিস্টেমের অনেক পরিবর্তন করতে হবে। এ জন্য আমাদের নৈতিক দিক থেকে আরও সৎ হওয়া খুব প্রয়োজন। একই সঙ্গে ভালো কিছু গ্রহণ করার মানসিকতাও থাকতে হবে। অনেকে ভালো কথা বললে জ্ঞান দিচ্ছে বলে উড়িয়ে দেন। তেমনভাবে গুরুত্ব দেন না, যা মোটেও উচিত নয়। সবাই মিলেমিশে সুন্দর একটি দেশ গড়ার প্রত্যয়ে অবশ্যই আমরা ভালো কিছু গ্রহণ করতে পারি। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের ফলে একটা নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। আমি সত্যিই খুব আশাবাদী ভালো কিছু হবে সুদূর ভবিষ্যতে ইনশা আল্লাহ। এ জন্য আমাদের সবাইকে আন্তরিক সহযোগিতার মনোভাব এবং সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
*লেখক: মীর মোকাদ্দেস আলী, সহকারী অধ্যাপক (শিক্ষাছুটিতে), আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও মাস্টার্স শিক্ষার্থী, এআইটি, থাইল্যান্ড
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]