হারানো যোগসূত্র-একটি সত্য ঘটনা

ঈদের দিনে পবিত্র আল-আকসা মসজিদে ফিলিস্তিনিদের জমায়েতফাইল ছবি: রয়টার্স

ছেলেটার নাম মোহাম্মদ, পেশায় একজন আমেরিকান কমেডিয়ান। স্ট্যান্ডআপ কমেডি করে, টুকটাক অভিনয়ও করে।

আদি নিবাস ফিলিস্তিন, যদিও ওর জন্ম সে দেশে হয়নি।

ইজরায়েলিরা ওদের বাস্তুচ্যুত করে দেশছাড়া করেছে। ওর বাবা মা কুয়েতে গিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করে। কুয়েতেই ওর জন্ম।

মুসলিম দেশে নিজেরা ভালোই গুছিয়ে নিচ্ছিল। এরপর সাদ্দাম হোসেন মাত্র এক রাতের ব্যবধানে আবারও ওদের গৃহহীন করে। ঘরবাড়ি সব ছেড়ে ওদের আবারও নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা শুরু করতে হয়।

ওর পরিবার এসে আশ্রয় নেয় আমেরিকায়, টেক্সাসের হিউস্টনে। আবারও শূন্য থেকে শুরু হয় ওদের জীবনের লড়াই। এবার প্রতিকূলতা আরও বেশি। ভিন্ন সমাজ, সংস্কৃতি ও ভাষার একটি দেশ।

একদিন বাবা মারা যায়।

বয়স বেশি ছিল না।

কিন্তু ক্রমাগত সংগ্রামের এত ধকল নিতে পারেনি বেচারার শরীর। হৃৎপিণ্ড একদিন বলে বসল, ‘I quit!’

বেচারা বলারও সুযোগ পায়নি, ‘এখনই হার মানলে কীভাবে চলবে? আমার ছোট ছোট ছেলে মেয়ে আছে, ওদের বড় করতে হবে। আমাদের এখনো কাগজপত্র হয়নি, বৈধভাবে কাজ করার অধিকার আমাদের বাচ্চাদের নেই, আমি ওদের এভাবে একা ফেলে গেলে খুবই স্বার্থপরতা হবে।

কিন্তু মৃত্যুদূত কাউকে এক মুহূর্তও বেশি সময় দেয় না।

ছেলেটার একটা সময়ে কাগজপত্র হয়। সে আমেরিকার নাগরিক হয়ে যায়। জন্ম কুয়েতে, বেড়ে ওঠা হিউস্টনে, কিন্তু তারপরও সে একজন ফিলিস্তিনি, রক্তে বইছে হাজার বছরের আরব ডিএনএ।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের মূল কারণগুলোর একটি জেরুজালেমে অবস্থিত পবিত্র আল-আকসা মসজিদ
ছবি: এএফপি

একদিন সে সিদ্ধান্ত নেয় ফিলিস্তিন বেড়াতে যাওয়ার। তার পৈতৃক গ্রামে এখনো কিছু আত্মীয়স্বজন আছেন। খালা, চাচা, মামাদের অনেকেই এখনো সেসব ভিটেতে আছেন, যেখানে এক শ, দুই শ, চার শ বা তার চেয়েও বেশি বছর ধরে তার পূর্বপুরুষেরা থাকতেন।

জীবনে এই প্রথম তাকে পেয়ে তার গ্রামের আত্মীয়েরা উল্লসিত হয়ে ওঠেন। এই খাবার, ওই খাবার কোনো কিছুই বাকি নেই। হামুসের সঙ্গে ফিলিস্তিনের বিশ্বখ্যাত জয়তুনি তেলে (অলিভ অয়েল) পিটা রুটি চুবিয়ে খাবার তুলনা পৃথিবীর অন্য কোনো খাবারের সঙ্গে সে করতে পারে না।

বিকেলে গ্রাম ঘুরে দেখতে বের হয়। গ্রামের একাংশে বিশাল দেয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে। ইজরায়েলি ভূমিদস্যুরা তাদের উৎখাত করে নিজেদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। কেউ কিছু বলতে পারে না। কারোর বলার সাহস নেই। শুধু ফিলিস্তিনিরা হাউমাউ করে কাঁদে। গুলি করে ওদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। শিশু বয়সে নিজ গৃহ থেকে অন্যায়ভাবে বিতাড়িত হয়ে গৃহহীন হয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া লোকের সংখ্যা হাজারো। অনেকে আজও বেঁচে আছেন। ছানিপড়া চোখে স্বপ্ন নিয়ে। একদিন তাঁদের ঘরে, নিজ উঠোনে তাঁরা ফেরত যাবেন।

দৃষ্টিশক্তির পাশাপাশি স্বপ্নও দ্রুত ফিকে হয়ে আসে।

কেউ বলেন, অলীক স্বপ্ন না দেখতে। হৃদয় ভাঙার কষ্ট থেকে তাহলে নিজেকে রক্ষা করা যাবে।

তাঁরা বলেন, স্বপ্নই যদি না দেখি, তাহলে সেটা পূরণ হবে কীভাবে?

গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে মোহাম্মদ একটি মসজিদ দেখতে পায়। বহু প্রাচীন সেই মসজিদের বয়স জানতে চাইলে ওর কাজিন বলে, ‘কয়েক শ বছর ধরে এটি আমাদের গ্রামের মসজিদ।’ মোহাম্মদ বলে, ‘আমি সেই মসজিদে যেতে চাই। আমি সেখানে আসরের নামাজ পড়ব।’

কাজিন বলে, ‘সিরিয়াসলি? কেন?’

‘ওটা এত শতাব্দী ধরে দাঁড়িয়ে আছে, নিশ্চয়ই আমার বাবা, আমার দাদা সেখানে নামাজ পড়তেন। আমাকে সেই মসজিদে যেতেই হবে।’

মোহাম্মদ কোনোভাবে তাঁর পূর্বপুরুষদের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। দাদার স্নেহ সে পায়নি। আল্লাহ বাবাকেও শৈশবেই নিজের কাছে ডেকে নিয়েছেন। যদি আরেকটিবার তাঁকে জড়িয়ে ধরতে পারত! কোনো উপায়ে, কোনো অলৌকিক উপায়ে বাবার স্পর্শ যদি সে পেত! বাবাকে যে তার অনেক জরুরি কথা বলার আছে!

তারা গিয়ে মসজিদে উপস্থিত হয়। ভেতরে তেমন কেউ ছিল না। তারা আসরের নামাজ পড়ে। মোহাম্মদ উপলব্ধি করার চেষ্টা করে তার পূর্বপুরুষদের স্পর্শ। এখানে এ মসজিদের প্রাঙ্গনে কোনো এককালে তার বাবা, তাঁর বাবা, তাঁরও বাবা হেঁটেছেন। কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছেন, এ মাটিতেই সিজদায় মাথা ঠেকিয়েছেন। মোহাম্মদ হাত দিয়ে সেই মেঝে ছুঁয়ে দেখে।

এই সময়ে মসজিদের ভেতরের কিছু লোকজনের সঙ্গে তার কথাবার্তা হয়। একজন বলেন, ‘এখন মাগরিবের সময় হয়ে গেছে, তুমিই আজান দাও!’

মোহাম্মদ ঘাবড়ে যায়। বলে, ‘আমি কীভাবে আজান দিতে পারি? তোমরা দাও!’

ওরা বলে, ‘তুমি অতিথি, তুমিই দাও!’

ইসলামে মুয়াজ্জিনের সম্মান অনেক! সম্মানিত অতিথিকে আরও সম্মানিত করতে আমরা আজান দিতে বলি। মোহাম্মদ ভাবে, সে কি এর যোগ্য? এ যে বিশাল দায়িত্ব! সে কারণেই ও ঘাবড়ে যায়।

‘তুমি কি আজান দিতে পারো না?’

‘অবশ্যই আমি পারি। কিন্তু আমি কীভাবে দিব?’

ওরা জোর করেই ওকে মাইক ধরিয়ে দেয়। মোহাম্মদ আজান দেয়।

আজান শেষে মসজিদে এক মুরব্বি এসে উপস্থিত হন। চেহারার গাম্ভীর্য দেখেই মন ঘাবড়ে ওঠে। বোঝা যায়, এ ভদ্রলোকের জন্ম হয়েছে মানুষকে ধমক দেওয়ার জন্য।

‘এই আজান কে দিয়েছে?’

মোহাম্মদের ধারণা হয়, সে নিশ্চয়ই কোনো ভুল করেছে। নাহলে শুধু শুধু কেন জানতে চাইবে? সে ভেবেছিল, ওর কাজিনরা ওকে রক্ষায় এগিয়ে আসবে। কিন্তু ওরা সঙ্গে সঙ্গে ওর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ‘ও দিয়েছে।’

মুরব্বি এগিয়ে এসে বলে ওঠেন, ‘তুমি ১০ মিনিট আগে আজান দিয়ে দিয়েছো। সূর্য ডুবতে এখনো ১০ মিনিট বাকি।’

মোহাম্মদ বলে, ‘কিন্তু মসজিদের ঘড়ি যে দেখাচ্ছে এখন সময় হয়ে গেছে?’

‘ওটা ১০ মিনিট এগিয়ে আছে।’

মোহাম্মদ দাঁত কামড়ে মনে মনে বলে, ‘আগেই জানতাম, কিছু একটা গন্ডগোল পাকাবোই!’

মুরব্বি বলে ওঠেন, ‘তোমাকে বিদেশি মনে হচ্ছে। কার বাড়িতে এসেছো? কে তুমি?’

মোহাম্মদ নিজের পরিচয় দেয়। নিজের পরিবারের নাম বলে। বৃদ্ধের চেহারার গাম্ভীর্য আচমকাই উজ্জ্বলতায় পাল্টে যায়। ঝলমলে স্বরে তিনি বলে ওঠেন, ‘কি আশ্চর্য! তুমি মুস্তফার ছেলে? মুস্তফা আর আমি খুবই ভালো বন্ধু ছিলাম। আমরা এক সঙ্গে বড় হয়েছি।’

বৃদ্ধ যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজের শৈশবে ফিরে গিয়েছিলেন। একটি ছোট নিশ্বাস চেপে তিনি উপলব্ধি করেন, জীবন কত দ্রুত ফুরিয়ে আসে!

তিনি মোহাম্মদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। একজন বাবা যেমন তাঁর ছেলেকে আদর করেন।

তারপর কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘তুমি যে একটু আগে আজান দিলে, তুমি কি জানো এই মাইক কে ফিট করেছিল?’

মোহাম্মদ থমকে যায়। তাঁর হৃৎপিণ্ড লাফাতে শুরু করে। চোখ নিংড়ে বেরিয়ে আসা জর্দান নদীর জল মেক্সিকান উপসাগরের নোনা পানির সঙ্গে মিলেমিশে তোলপাড় হয়ে যায়।

বৃদ্ধ বিড়বিড় করে বলে ওঠেন, ‘তোমার বাবা!’

টেক্সাসের উঠতি কমেডিয়ান মোহাম্মদ আমেরের পিতা মুস্তফা একজন টেলিকম ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ইলেকট্রিকের কাজ বুঝতেন বলে গ্রামের মসজিদের জন্য তিনি মাইক ফিট করে দিয়েছিলেন। এরপর তাঁকে গ্রাম, দেশ ও পৃথিবী ছাড়তে হয়। এরই বহু বছর পরে একদিন তাঁরই ছেলে এসে সেই একই মাইকে আজান দেয়।

*বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে

**দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা [email protected]