ট্রাফিক জ্যাম ও সময় ব্যবস্থাপনা

অফিস ছুটির পর রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজট। মধ্য বাড্ডার প্রগতি সরণি, ছবিটি ১৪ মার্চ তোলা।ছবি: দীপু মালাকার

ঢাকা বা চট্টগ্রামে ট্রাফিক জামে পড়েননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ট্রাফিক জ্যাম মানে রাস্তায় অতিরিক্ত যানবাহনের কারণে যান চলাচল ধীর বা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ট্রাফিক জ্যাম তখন ঘটে যখন যানবাহনের সংখ্যা সড়কের ক্ষমতার চেয়ে বেশি হয়ে যায় বা দুর্ঘটনা, সড়ক নির্মাণ, কিংবা দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কারণে বাধার সৃষ্টি হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোয় ট্রাফিক জ্যাম প্রায়ই ঘটে এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থায়ী হয়। মাঝেমধ্যে আমরা ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতেও ট্রাফিক জ্যাম দেখতে পাই।

বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোয়, ট্রাফিক জ্যামের প্রভাব সমাজ ও অর্থনীতির ওপর পড়ে। ট্রাফিক জ্যামের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে যানজটে আটকে থাকার ফলে কর্মক্ষেত্রে কাজের সময় হারিয়ে যায়। কর্মচারীরা অনেক সময় যানজটে আটকে থাকেন, যা সামগ্রিক উৎপাদনশীলতাকে কমিয়ে দেয়। সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে, যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা অপচয় হচ্ছে, যার ফলে বছরে ক্ষতি ৫০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ।

দীর্ঘ যাত্রাসময়ের কারণে জ্বালানি খরচ বেড়ে যায়, যা ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক উভয়ের জন্যই ব্যয় বাড়ায়। ফলে পণ্য সরবরাহের সময় বেড়ে যায়, যার ফলে ব্যবসায়িক খরচ বেড়ে যায়, যা নিত্যপণ্যের বাজারে প্রভাব পড়ে। চরম ট্রাফিক জ্যাম বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত হয়। রাস্তাগুলোয় অতিরিক্ত যানবাহনের কারণে রাস্তা দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে রাস্তা মেরামতের খরচ বাড়ে। প্রায়ই মেরামতের প্রয়োজন হলে আরও বেশি ট্রাফিক ব্যাঘাত ঘটে এবং অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পায়।

যানজটে আটকে থাকার ফলে মানুষের মধ্যে প্রচুর হতাশা, ক্লান্তি ও মানসিক চাপ তৈরি হয়। এর ফলে উচ্চ রক্তচাপ, উদ্বেগ এবং অন্যান্য স্ট্রেস-সম্পর্কিত রোগ ত্বরান্বিত হতে পারে। এটি পরিবার ও বিনোদনের জন্য সময় কমিয়ে দেয়। দীর্ঘ যানজটের কারণে যানবাহন থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য বিষাক্ত শ্বাসকষ্টজনিত রোগ যেমন হাঁপানি ও ব্রঙ্কাইটিস বাড়িয়ে তোলে। ক্রমাগত হর্ন বাজানো এবং ইঞ্জিনের শব্দের ফলে শব্দদূষণ বাড়ে, যা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। এর ফলে মাথাব্যথা, বিরক্তি এবং শ্রবণশক্তি হ্রাসের মতো সমস্যা হতে পারে। এর পাশাপাশি জরুরি সেবা, যেমন অ্যাম্বুলেন্স বা ফায়ার সার্ভিস, প্রায়ই যানজটে আটকে যায়, যা সেবার সময়কে বিলম্বিত করে।

ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম কমানোর জন্য বিভিন্ন খাতের অফিস সময়সূচি সামঞ্জস্য করা অত্যন্ত জরুরি। স্কুল, অফিস ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সময় ৯টা থেকে ৫টার পরিবর্তে আলাদাভাবে নির্ধারণ করলে একসঙ্গে রাস্তায় ভিড় কমবে এবং যানজট কমবে।

স্কুলের সময়সূচি—

  • প্রাথমিক: সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা

  • মাধ্যমিক: সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা

  • কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়: সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা

অফিস এবং করপোরেট খাত—

  • সরকারি অফিস: সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা।

  • বেসরকারি অফিস এবং করপোরেট সেক্টর: সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা

সেবা খাত (ব্যাংক, দোকান, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি)—

  • ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ডাকঘর: বেলা ১১টা থেকে ৭টা।

  • দোকান ও শপিং মল: বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা।

  • স্বাস্থ্যসেবা: সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা

যানজটের ফাইল ছবি
ছবি: আশরাফুল আলম

কারখানা ও শিল্প খাত—

কারখানাগুলো সকাল ৭টা থেকে শুরু করতে পারে যদি শিফট না থাকে। শিফট থাকলে বিভিন্ন শিফটে কাজ করতে পারে, যেমন:

  • শিফট ১: সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৩টা

  • শিফট ২: বেলা ৩টা থেকে রাত ১১টা

  • শিফট ৩: রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা

যানবাহন ব্যবস্থাপনা—

  • দূরপাল্লার বাস ঢাকা শহরে কোনোমতেই প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। ঢাকার বাইরে ডিপো করে শাটল বাস দিয়ে যাতায়াতের সমন্বয় করতে হবে।

  • দূরপাল্লার ভ্রমণের জন্য দ্বিতলবিশিষ্ট রেলওয়ে বগির ব্যবস্থা করতে হবে।

যানজট নিরসনের জন্য লুক্সেমবার্গ সরকার ২০২০ সাল থেকে সে দেশের জনগণের জন্য গণপরিবহন ফ্রি করে দিয়েছে। আমাদের সরকার চাইলে বিশেষ বিশেষ সময়ে এ ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে। এর পাশাপাশি স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য নিজস্ব বাস চালু করা যেতে পারে।

৯ থেকে ৫টার পরিবর্তে এ ধরনের সময়সূচির সামঞ্জস্যের মাধ্যমে যানজট অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে। বাংলাদেশের নগর এলাকায়, বিশেষত ঢাকা এবং চট্টগ্রামে, যানজট অর্থনীতি, সমাজ এবং পরিবেশের ওপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি উৎপাদনশীলতা কমায়, জীবিকার খরচ বাড়ায়, পরিবেশের ক্ষতি করে এবং সামগ্রিক জীবনমানকে প্রভাবিত করে। যানজট মোকাবিলার জন্য একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন, যার মধ্যে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট উন্নয়ন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং দীর্ঘমেয়াদি শহর পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করা, যা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।

 *লেখক: কফিল উদ্দিন আহমদ, অটোমেশন ইঞ্জিনিয়ার, সিটি ব্যাংক সিইপি (এনএ), ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড