তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ভূমিকা বাড়াতে হবে

ছবি: মাসুদুজ্জামান

দেশে-বিদেশে তরুণ প্রজন্মকে বাংলার প্রতি আকৃষ্ট করতে হলে বাংলা ভাষায় গুরুত্বারোপ করতে হবে। এর একটা কার্যকর ও ভালো উপায় হচ্ছে এই ভাষার উপযোগিতা বৃদ্ধির জন্য তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ভূমিকা বাড়ানো বা কার্যকর করে তোলা। আর বিশেষ করে বিলেতে বাংলা ভাষা টিকিয়ে রাখতে হলে নতুন প্রজন্মকে বাংলা শেখাতে হবে। দুভাবে এ কাজটি করতে হবে। প্রথমত, মা-বাবাদের ঘরে সন্তানের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, বিলেতের বাঙালি–অধ্যুষিত এলাকার স্কুলগুলোর পাঠ্যসূচিতে বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।

লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে ‘প্রবাসে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় লন্ডনের এন্টারপ্রাইজ একাডেমির সেমিনার হলে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে এ আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

‘বাঙালি নতুন প্রজন্মকে মাতৃভাষা শিখাতে আগ্রহী করে তুলতে করণীয়’ শীর্ষক বিষয়ে বক্তব্য দেন দৈনিক প্রথম আলোর সাবেক পরামর্শক সম্পাদক ও বিবিসি বাংলার সাবেক সাংবাদিক কামাল আহমদ এবং ‘বিলেতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক বিষয়ে বক্তব্য দেন লন্ডনে শহীদ মিনার ও নজরুল সেন্টারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং টাওয়ার হ্যামলেটস কলেজের সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল রাজন উদ্দিন জালাল।

প্রেসক্লাব সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ। অনুষ্ঠান শুরু হয় এক মিনিট নীরবতা পালনের মাধ্যমে। নীরবতা পালনকালে বায়ান্নর ভাষাশহীদ ও সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে হতাহতদের গভীর সহানুভূতির সঙ্গে স্মরণ করে নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাসমতে তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করা হয়।

প্রয়াত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি সমবেত কণ্ঠে পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের মূল কার্যক্রম শুরু হয়। অনুষ্ঠানের অতিথি ও ক্লাবের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নিয়ে গানটি পরিবেশন করেন চ্যানেল এস-এর সংবাদ উপস্থাপক রুপি আমিন। পরে একুশের গান রচনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে প্রয়াত আবদুল গাফফার চৌধুরীর একটি লেখা পড়ে শোনান সাংবাদিক টিভি উপস্থাপক উর্মি মাযহার। দুই অতিথি বক্তার বক্তব্যের ওপর উন্মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ক্লাবের সদস্যরা। আলোচনাপর্ব শেষে অনুষ্ঠিত হয় একুশের কবিতা পাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

কামাল আহমদ বলেন, আর্থিক লাভালাভের নিরিখে কোনো ভাষার গুরুত্ব কত, সেটাই এখন বিশ্বে ভাষার প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করে। কারণ, নতুন প্রজন্ম ভবিষ্যৎ জীবন-জীবিকার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করাকেই সবচেয়ে জরুরি মনে করে। কোনো ভাষায় কত মানুষ কথা বলেন, তার নিরিখে বিশ্বে প্রথম স্থানে আছে ইংরেজি, যা প্রায় দেড় শ কোটি মানুষের ভাষা। সংখ্যার দিক দিয়ে সপ্তম অবস্থানটি হচ্ছে বাংলাভাষীদের, যাদের সংখ্যা হচ্ছে ২৭ কোটি। কিন্তু অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিচারে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ভাষার তালিকায় বাংলা নেই।

কামাল আহমেদ আরও বলেন, দেশে ও বিদেশে তরুণ প্রজন্মকে বাংলার প্রতি আকৃষ্ট করতে হলে বাংলা ভাষায় গুরুত্বারোপ করতে হবে। এর একটা কার্যকর ও ভালো উপায় হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ভূমিকা বাড়ানো বা কার্যকর করে তোলা। একইভাবে শিল্প-সাহিত্যে, সিনেমা-গানে বাংলায় যদি আলোড়ন তোলার মতো সৃজনশীল কিছু হয়, তাহলে সেগুলোও অভিবাসী তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে পারে। যুক্তরাজ্য অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যা, তাতে সরকার দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্কুলে বাংলা পড়ার পেছনে বিনিয়োগ বাড়াবে, তেমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বিনিয়োগ বাড়ানোর দাবি ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে তোলা দরকার। কিন্তু তার চেয়েও বেশি দরকার বিকল্প হিসেবে নিজেদেরও উদ্যোগ নেওয়া। ব্রিটেনেও বাংলা একাডেমির মতো কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার, যেখানে বাংলা শেখানো, চর্চা ও বিকাশের ব্যবস্থা থাকবে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটেরও এ ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া উচিত।

ছবি: মাসুদুজ্জামান

রাজন উদ্দিন জালাল বলেন, বিলেতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ ইতিবাচক নয়। আমাদের এই প্রজন্মের মানুষ যখন থাকবে না, তখন বাংলায় কথা বলবে কে? যারা কথা বলবে তারা হলো আমাদের ছেলেমেয়েরা। কিন্তু তারা তো বাংলা শিখছে না। বাংলার প্রতি তাদের আগ্রহ নেই। তা ছাড়া পূর্ব লন্ডনে অভ্যন্তরীণ মাইগ্রেশন চলছে। টাওয়ার হ্যামলেটস থেকে বাংলাদেশিরা বেরিয়ে গিয়ে এখন নিউহ্যাম, বার্কিং অ্যান্ড ডেগেনহ্যাম, হেইভারিং ও এসেক্স এলাকায় বসবাস করতে শুরু করছেন। টাওয়ার হ্যামলেটসে বসবাস ব্যয়বহুল হয়ে পড়ায় মানুষ এখান থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে হলে নজরুল সেন্টারকে পুনরায় জাগ্রত করতে হবে অথবা নজরুল সেন্টারের মতো একটি সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে—যেখানে বাঙালিরা প্রতিদিন আসতে না পারলেও অন্তত ছুটির দিনে আসবে এবং ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চার বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবে।

প্রেসক্লাব সভাপতি এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, সন্তানদের বাংলা শেখানোর কাজটি আমাদের নিজেদের ঘর থেকে শুরু করতে হবে। তাহলে অন্তত প্রাথমিক জ্ঞানটুকু আমরা দিতে পারব। তিনি বলেন, এ লেভেলে সাধারণত তিনটি বিষয় শিক্ষার্থীরা পছন্দ করে। তার মধ্যে তারা যদি বাড়তি বাংলা বিষয়টি নেয় এবং ওই বিষয়ে যদি সে ভালো ফলাফল করতে পারে, তাহলে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পথ অনেকটা সুগম হবে। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পছন্দের বিষয়ে পড়ার সুযোগ বাড়বে।

তাইসির মাহমুদ বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের অন্তত সাতটি স্কুলের ‘ন্যাশনাল কারিকুলামে’ বাংলা ভাষা অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত আছে। একসময় মা-বাবারা তার সন্তানকে স্কুলে বাংলা বিষয়টি নিতে উৎসাহী করে তুলতেন। কিন্তু এখন সেটা খুবই কম। তা ছাড়া অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষ কৌশলে বাঙালি শিক্ষার্থীদের বাংলা বিষয় নিতে নিরুৎসাহিত করে থাকে। তাই ঘরে ও স্কুলে বাংলা পড়তে সন্তানদের আগ্রহী করে তুলতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে অভিভাবকদেরকে। তাহলে বিলেতে আরও অনেক দিন বাংলা টিকে থাকার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।

আলোচনাপর্বের শেষ দিকে অনুষ্ঠানের স্পনসর ওয়ার্ক পারমিট ক্লাউডের ফাউন্ডার ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লুৎফুর রহমানের হাতে ‘প্রশংসা সনদ’ তুলে দেওয়া হয়।
একুশের কবিতা আবৃত্তি ও গান

দ্বিতীয় পর্বে ক্লাবের সহকারী সাধারণ সম্পাদক সাঈম চৌধুরী ও নির্বাহী সদস্য নাজমুল হোসেনের যৌথ সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয় একুশের কবিতা আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। এতে কবিতা আবৃত্তি করেন লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সদস্য জিয়াউর রহমান সাকলেন, শহিদুল ইসলাম সাগর, আমিমুল আহসান তানিম, সৈয়দ রুম্মান, রোমান বখত চৌধুরী, মিছবাহ জামাল, মুনিরা পারভীন এবং লন্ডন সফররত শিক্ষাবিদ শওকত আলী। মাতৃভাষাবিষয়ক পুঁথি পাঠ করেন চ্যানেল এস-এর ক্যামব্রিজ প্রতিনিধি সাংবাদিক মামুন রশিদ। গান পরিবেশন করেন ক্লাব সদস্য ও চ্যানেল এস-এর জ্যেষ্ঠ সংবাদ উপস্থাপক রুপি আমিন।

প্রেসক্লাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক চৌধুরীর ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সফল সমাপ্তি ঘটে। বিজ্ঞপ্তি

দূর পরবাসে লেখা ও ছবি পাঠাতে পারেন [email protected]–এ।