কোন কষ্টে কষ্ট বেশি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমি প্রতিবছরই সুইডেনে বাংলাদেশি শাকসবজি রোপণ করি। এবার তীব্র ঠান্ডার কারণে ঠিকমতো কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না। মাটির তাপমাত্রা যত দিন না রাতে ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের ওপর উঠছে, তত দিন কোনো কিছুই রোপণ করা সম্ভব নয়। কৃষিজমিতে কাজ করার শখ মূলত ছোটবেলা থেকেই। গ্রামের বাড়িতে গরুর খামারের গোবর থেকে উৎপাদিত জৈব সার, এ ছাড়া বাড়ির আঙিনায় আলাদা করে গরুর খামার, দেশি হাস-মুরগি, চীনা হাঁস, রাজহাঁস, কবুতরের খামার করেছি। বাড়ির পুকুরে চাষ করেছি রুই, কাতলা, তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। অবসর সময়ে নদী, নালা, খালে, মাঠে, মাছও ধরেছি। পরে বিদেশে এসে বাড়ির আশপাশে টুকটাক গাছপালা, শাকসবজির চাষাবাদ সব সময় করার অভ্যাসটা রেখে দিয়েছি। সুইডেনের বাড়ির আশপাশে নানা ধরনের ফসলের আবাদ আমার ছোটবেলারই ধারাবাহিকতা। প্রতি ইঞ্চি জমিতে আবাদ করার বিষয়টি মা-বাবার সবুজ বিপ্লবের ডাক থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছি ছোটবেলা থেকেই।

এবার বিভিন্ন জাতের ধান, ছোলা, কলাই, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লালশাক, পালংশাক, ধনেপাতা, গ্রামবাংলার জনপ্রিয় টমেটো, লাউ, শিমসহ প্রায় সব ধরনের শীতকালীন শাকসবজি চাষ করব ভাবছি। এ ছাড়া সুইডেনে শর্ষে, শর্ষেখেতে মৌচাক পালনের মাধ্যমে মধু আহরণ, হলুদ, মরিচ, আদা, পেঁয়াজ, স্ট্রবেরিসহ নানা ধরনের ফল এবং গোলাপ, সূর্যমুখী, গাঁদা ফুলসহ বিভিন্ন ধরনের ফুলের চাষ করব। ইদানীং সুইডিশদের বাংলাদেশের শাকসবজি রোপণে অনুপ্রেরণা দিতে একটি প্রজেক্ট করেছি, প্রজেক্টের নাম ‘ওডলা ইহুপ’ মানে—এস একসঙ্গে রোপণ করি। গ্রুপে বেশির ভাগই সুইডিশ, তবে আমি এবার একজন আফগান এবং মরক্কোর ছেলেকে সঙ্গে নিয়েছি। ছেলে দুটির একজন সুইডেনে আফগানিস্তানের খাবারসহ নানা ধরনের স্যুভেনির বিক্রি করে। অন্যদিকে মরক্কোর ছেলেটি সরাসরি মরক্কো থেকে কাঁচামাল এনে সুইডেনের বিভিন্ন দোকানে সেগুলো বিক্রি করে। এরা দুজনে আমার প্রজেক্টে জাফরান এবং তরমুজের চাষ করবে বলেছে। সুইডেনে গরম সাধারণত ৩-৪ মাস সময়, যদি সুইডিশ সামার আমাদের অনুকূলে থাকে, তবে আশা করছি আমরা সম্ভাব্য কিছু একটা ফলাফল দেখতে পাব এ বছরেই।

যে কারণে ঘটনাটি তুলে ধরলাম, সেখানে ফিরে আসি।

গতকাল তরমুজ কিনেছি, একটি তরমুজের দাম ৪০০ ক্রোনার। এখানে তরমুজ কেজিদরে বিক্রি হয়। একটি তরমুজের ওজন ৬-১৫ কেজির মতো। এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০ ক্রোনার/কেজি। (১০ টাকা = ১ ক্রোনার)। এ তরমুজ এসেছে মরক্কো থেকে। খেতে ভালো এবং মিষ্টি। সিজনের শুরুতে দাম চড়া, তবে আগামী মাস থেকে গ্রিস, টার্কিশ, স্পেন ও ইতালি থেকে তরমুজ আসতে শুরু করবে, তখন দাম কমে ১৫ ক্রোনারের মধ্যে/কেজি চলে আসবে। নতুন কিছু বাজারে এলে চাহিদা বেশি হয়, তারপর প্রতিযোগিতা যদি না থাকে, তখন দাম চড়া হয়ে থাকে, বিশ্বের সব জায়গায় এটা দেখা যায়। এখন চাহিদা এবং দাম বেশি বলে কাঁচা তরমুজ বিক্রি করলে তো ধরা খেতেই হবে কোনো না কোনোভাবে। অনেকে গোলআলু আগেভাগে তুলে বিক্রি করেন বেশি অর্থ উপার্জন করতে। ঠিক আছে, আলু ছোট হলে সমস্যা নেই; কিন্তু কিছু কিছু ফল যেমন আম, কলা তরমুজ এগুলো তো কাঁচা বা অপরিপক্ব বিক্রি করলে পাবলিক কিনবে না? তারপর ফরমালিন মেশালে হয়তো পাকবে; কিন্তু স্বাদ বা মিষ্টি তো সঠিকভাবে পাওয়া যাবে না। এ বিষয়গুলো মাথায় রাখা দরকার; কিন্তু সেটা মাথায় থাকলেও সবার বিবেকে সেটা থাকে না। যাহোক, সুইডেনে পরিপূর্ণ গাছপাকা ফল পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। কারণ, দূরপ্রান্ত থেকে আমদানি করে আনতে পথে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে দেখা যায় আম, কলা, পেঁপে, কাঁচা অবস্থায় এসে হাজির হয়েছে। এত সব ঝামেলার কারণে মূলত আমার চেষ্টা যদি সম্ভাব্য কিছু শাকসবজি, ফলমূল রোপণ করতে পারি, তবে সুস্বাদু এবং ভেজালমুক্ত খাবার খেতে পারব। তবে খরচ কম হবে না, কারণ এখানে নিজ হাতে কিছু করা মানে আমাদের সময় বিনা পয়সায় ব্যয় হবে। যাকে বলে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হবে।

তাহলে কেন কৃষি খাতে এ সময়গুলো দিই? কারণ ভালো লাগা এবং শখ, শখের বিচার কখনো অর্থ দিয়ে হয় না। তারপর প্রকৃতির সঙ্গে সময় দেওয়া, নিজ হাতে কিছু করা, সমাজের কথা ভাবা, শারীরিক পরিশ্রম করা, প্রিয়জনকে নিয়ে একসঙ্গে কিছু করা; সব মিলে একটি চমৎকার ‘কোয়ালিটি টাইম’–এর মূল্য তো একটু বেশি হবেই।

এ তো গেল বিলাসীদের বেলায়, কিন্তু যারা দিনমজুর এবং যাদের পেশাই কৃষিকাজ, তাদের কী অবস্থা এবং আমাদের থেকে তাদের জন্য কী ব্যবস্থা?

আমি কয়েক দিন আগে গণমাধ্যমে দেখেছি বাংলাদেশে একজন কৃষক তার বেগুন গরুকে খেতে দিয়েছে বিক্রি করতে না পারার কারণে। বেচারা যে সময় এবং অর্থ ব্যয় করেছে, তাতে কমপক্ষে তাকে পাঁচ টাকা কেজি না দিলে বা সে বিক্রি করতে না পারলে, এ কাজ তো সে করতে পারবে না। পারবে না তার সংসার চালাতে। পারবে না তার ঋণ শোধ করতে। অন্যদিকে শহরে সেই বেগুন বিক্রি হচ্ছে কমপক্ষে ৪০ টাকা। যেখানে যে রোপণ করল, সে বড়জোর পাচ্ছে ১ টাকা! এটা আমাকে কষ্ট দিয়েছে, মূলত সেই কারণে লিখছি যদিও আমার এ লেখার কারণে কোনো পরিবর্তন হবে না, তবুও লিখছি।

দেশের সাধারণ মানুষ না হয় বিবেকহীন হয়ে পড়েছে গরমের মধ্যে, কিন্তু সরকার? সরকার তো থাকে এসির তলে, তাদের তো বিবেক হারালে চলবে না!

এবার তাহলে কিছু অপ্রিয় সত্য কথা তুলে ধরি।

সত্যকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে না পারলে লিখে কী লাভ? আমি তো নোবেল পুরস্কার পেতে লেখালিখি করিনে? করি মূলত বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে, সেগুলোর ভালো–মন্দ দেখি এবং সেগুলো তুলে ধরি, নিজেদের সচেতন করতে। কারণ সচেতন জাতি সব সময় খোঁজে সমাধান।

এমনিতেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সরকারের প্রতি সেসব দেশের মানুষের একটি প্রতিপক্ষ মনোভাব থাকে। কিন্তু সমস্যাগুলো সঠিকভাবে বিবেচনা করলে মানুষের সে ক্ষোভ অনেকটাই কিন্তু লোপ পায়। উন্নয়ন হচ্ছে দেশে ঠিক আছে, সেটা চলুক উন্নয়নের মতো করে। সরকার যদি অবকাঠামো উন্নয়ন অতি জরুরি বলে মনে করে, তবে তাতে জরুরি হাত দিতে হবে। একই সঙ্গে কিন্তু মানবিক উন্নয়নও যে জরুরি, সেটা উপেক্ষিত থাকলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না, সে উন্নয়ন দেশকে শক্তভাবে দাঁড়ও করাতে পারবে না, এটাও মাথায় রাখতে হবে।

আমি বিদেশে থাকলেও দেশের সব বিষয়ে খোঁজখবর রাখি, আমরা কিন্তু অনেক সম্পদ দেশে করেছি, যদিও ভোগদখলে নেই, কারণ দেশে না থাকলে যা হয় আরকি। আমি নানা প্রচারমাধ্যমে শুনছি বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয়, কৃষি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, ধান-চাল উৎপাদনে সফল ইত্যাদি। কিন্তু এ দেশে লাখ লাখ মানুষ মাসে এক-দুবার মাছ-মাংস কিনতে পারে না, তখন সব পরিসংখ্যান দেখলে আমার কাছে হাস্যকর হয়ে যায়। উৎপাদন অনেক বেড়েছে, কথা সত্য। কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি, ওপেন টেলিফোনে আলোচনা করে দ্রব্যমূল্য চড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা চলছেই। চলছে দুর্নীতি, অনীতি। এসব তো সরকারকেই দেখতে হবে? নাকি আমি ভুল কিছু বলছি?

বাংলাদেশেও এখন তরমুজের সময়। একটি তরমুজ উৎপাদক বিক্রি করছেন ৩০-৫০ টাকায়, সেটি শহরে এসে হয়ে যাচ্ছে ৩০০-৪০০ টাকা! তারপর যদি বলা হচ্ছে ভেতরটা দেখতে চাই, লাল কি না! শুরু হয়ে যায় হাতাহাতি, কারণ ভেজাল। দেশের ফড়িয়া কারবার আগেও ছিল, এখনো আছে। এটি বাজার অর্থনীতির অংশ। কিন্তু এতটা জিম্মি করে কীভাবে, তা কিন্তু কারও কাছে অজানা নয়। জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা গেলেই এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারে সাধারণ মানুষ। এখন সরকার নিজে যখন জবাবদিহি থেকে বহু দূরে, কীভাবে সেটা তারা প্রতিষ্ঠা হবে? এসব সুন্দর কাজ করতে দরকার সুন্দর মনের, প্রয়োজন আইনের শাসন, যা এ দেশে আজীবন অনুপস্থিত! লাখো লাখো নেতাদের মাঝে ভালো সব কাজ অনুপস্থিত হয়ে আছে। কিন্তু এই অনুপস্থিতির জন্য দায়ী কে বা কারা? ব্যক্তিমালিকানা ভবন, হাওয়া ভবন, গণভবন, বঙ্গভবন, বিশ্ব ভবন, নাকি একটু একটু করে সব ভবন?

জনগণের ভোটে পাস করা নেতাদের প্রধান এবং প্রথম কাজ হচ্ছে সরকারপ্রধানকে এ পালস বুঝতে সহায়তা করা। মূলত দলীয় নেতা-কর্মী, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান অথবা চিন্তাশীল বা সৃজনশীল নাগরিকদের এ কাজগুলো করার কথা। দুঃখের বিষয়, কোনো একটি সত্তা সরকারপ্রধানকে সঠিক রিপোর্ট করে কি না, তা নিয়ে নানা মহলের মতো আমারও সন্দেহ আছে। অথবা করলেও তা সরকারপ্রধানের চোখ পর্যন্ত পৌঁছায় কি না, জানা নেই। নির্বাচন হয়ে গেছে এবং প্রধানমন্ত্রী পঞ্চম দফা এবং টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে দেশ চালাচ্ছেন। এখন সারা দেশে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নেই, কোনো বিক্ষোভ নেই, সড়ক অবরোধ নেই, জ্বালাও-পোড়াও নেই। অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে শান্ত। হয়তো অসন্তোষ দানা বেঁধে আছে বিশাল আকারে। সেটা কারও না বোঝার কথা নয়। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে সেটা বোঝা যায়, এ অসন্তোষ যতটা না নির্বাচন ঘিরে, তার চেয়ে অনেক বেশি দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দুর্বলতা নিয়ে। আমি দূর পরবাসে থেকে বলতে পারি, যে অরাজকতা দেশে চলছে, তা সামাল দিলে সারা দেশের মানুষের ক্লেদ, ক্ষোভ অনেকটাই প্রশমিত হতে পারত। এখন সেই অরাজকতা সরকারের জানা এবং সে মোতাবেক কাজ করা খুবই প্রয়োজন। এই অরাজকতার মূলে আছে ব্যাংক লুটপাট, মানি লন্ডারিং, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, রাষ্ট্রের কর্মচারীদের ঘুষ–বাণিজ্য, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের সাধারণ মানুষের প্রতি অনাচার ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ এবং বক্তব্য। দেশের সমস্যা, বিশেষ কোনো বলার মতো বিষয় নয়, এগুলো সরকারের অবশ্যকরণীয়! কিন্তু সেটা সঠিকভাবে হচ্ছে না।

বিদেশে যেসব দূতাবাস রয়েছে তারাও তো সঠিক কাজগুলো করছে না, অথচ মাস গেলে দেশের টাকা ডলারে ভাঙিয়ে বেতন তুলছেন তাঁরা। আজ যদি দেশের তৎকালীন ৭ কোটি বাংলার মেহনতি মানুষ যুদ্ধ না করত, ৩০ লাখ মানুষ জীবন না দিত, সম্ভব হতো কি মন্ত্রী, এমপি, সচিব, ডিসি, এসপি, রাষ্ট্রদূত এসব হওয়া? যাহোক, দেশের ক্ষমতাবান মানুষের কথা শুনলে মনে হয় তারা চাঁদের দেশে বাস করে। তাদের কথাবার্তা শুনলে মনে করিয়ে দেয়—ফরাসি বিপ্লবের সময় (১৭৮৯ সাল) ক্ষমতায় থাকা ফ্রান্সের সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের প্রতাপশালী স্ত্রী-সম্রাজ্ঞী মারি আঁত্তিওনেতকে। তার সময় ফ্রান্সে চলছিল প্রচণ্ড খাদ্যাভাব। ইউরোপের বহু দেশের মতো সাধারণ ফরাসিদেরও প্রধান খাদ্য রুটি বা আলু। খাদ্যাভাবের দুর্যোগে তারা যখন রুটি পাচ্ছিল না। সে পরিপ্রেক্ষিতেই মারি আঁত্তিওনেত নাকি বলেছিল, ‘রুটি পাচ্ছে না তো কী হয়েছে? ওরা তো কেক খেলেই পারে।’ যাদের জনগণের অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট, রাগ-ক্রোধ, হিংসা-শত্রুতা ইত্যাদি সম্পর্কে মোটেও ধারণা, সমবেদনা বা সহমর্মিতা নেই; কেবল তারাই বলতে পারে, ‘ভাত পাচ্ছ না তো কী হয়েছে, পোলাও বা বিরিয়ানি খেলেই তো চলে’ বা রোজার মাসে শুনেছি এক মন্ত্রী বলেছে, খেজুর কেন, বরই দিয়ে ইফতার করব। ভাবুন, ‘মধ্যস্বত্বভোগীদের’ কারণে উচ্চ মহলের সবাই যেন বিপদে না পড়ি।