কপ–২৯ এবং বৈশ্বিক জলবায়ু কার্যক্রম: একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ
১১-২২ নভেম্বর আজারবাইজানের বাকুতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৯) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যেখানে বিশ্বের ১৯০টির বেশি দেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার করবে। মূল লক্ষ্য হলো, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহযোগিতা প্রদানে উন্নত দেশগুলোর দায়িত্ব নিশ্চিত করা।
প্রধান আলোচ্য বিষয়গুলো হলো—
১. জলবায়ু অর্থায়ন
উন্নত দেশগুলোর অর্থায়ন বৃদ্ধি পেলে, উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু অভিযোজন এবং সবুজ জ্বালানিতে দ্রুতগতিতে বিনিয়োগ করতে পারবে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে ভূমিকা রাখবে।
২. ন্যায্য স্থানান্তর এবং অভিযোজন
নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তরের সময় যেন শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কার্যকর অভিযোজন কৌশল বাস্তবায়নে সহায়তার আশ্বাসও দেওয়া হবে।
৩. কার্বন মার্কেট এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকি
জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা হ্রাসের জন্য একটি বৈশ্বিক কার্বন মার্কেট নীতিমালা তৈরির প্রস্তাবও থাকছে, যা বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করতে পারে।
প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ—
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এর কার্যকর বাস্তবায়নে এখনো অনেক দেশ পিছিয়ে রয়েছে। বিশেষত, চীন, সৌদি আরব এবং রাশিয়ার মতো দেশগুলোর কার্বন নির্গমন কমানোর প্রতি আরও জোর দেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রাথমিকভাবে উন্নত দেশের তহবিলের ওপর নির্ভরশীল, যা সময়মতো এবং যথাযথভাবে না পাওয়া গেলে অভিযোজন প্রচেষ্টায় ব্যাঘাত ঘটে।
বিভিন্ন দেশের অবদান ও উদ্যোগসমূহ—
১. যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন—
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য তহবিল সরবরাহের পাশাপাশি, কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে তারা ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিভিন্ন সহায়তাও প্রদান করছে।
২. চীন—
চীন নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে মনোযোগী হলেও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার অব্যাহত রাখা নিয়ে সমালোচনার মুখে রয়েছে। তবে তারা আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নীতি পরিবর্তনের দিকে আগ্রহী।
৩. মধ্যপ্রাচ্য—
সৌদি আরবসহ আরব রাষ্ট্রগুলো সবুজায়ন প্রকল্প গ্রহণ করলেও আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলে তাদের ভূমিকা সীমিত।
উন্নয়নশীল দেশসমূহের সহায়তার প্রয়োজনীয়তা—
বাংলাদেশ, নেপাল ও মালদ্বীপের মতো জলবায়ুপ্রবণ দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে তহবিল সহায়তা প্রত্যাশা করে। তবে বাংলাদেশের জলবায়ু তহবিল ব্যবহারে দুর্নীতি এবং স্বচ্ছতার অভাব লক্ষণীয়, যা প্রকৃত উন্নয়নের পথে অন্তরায়। ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে জলবায়ু তহবিল হিসেবে প্রায় ৪৪০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ হয়েছে, তবে গবেষণায় দেখা যায়, এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রকৃতপক্ষে দরকারি প্রকল্পে ব্যয় হয়নি।
দুর্নীতি ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের প্রভাব—
বাংলাদেশে জলবায়ু তহবিল ব্যবস্থাপনায় রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির প্রভাব প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের কাছে এই সহায়তা পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করছে। টিআইবির মতে, প্রকল্পগুলোতে অনভিজ্ঞ ঠিকাদার এবং স্থানীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ তহবিল ব্যবহারে অস্বচ্ছতা তৈরি করেছে। ফলে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি এবং কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধানের উপায়
জলবায়ু তহবিলের কার্যকর ব্যবহারের জন্য একটি শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য, যা দুর্নীতি হ্রাস করে প্রকৃত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক হবে। উন্নত দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে এই তহবিল ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
তবে দুঃখজনকভাবে বাস্তবতা হলো, শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের বহু দেশই জলবায়ু তহবিলের সুযোগের অপব্যবহার করছে। রাজনৈতিক প্রভাব এবং ক্ষমতার অপব্যবহার তহবিল ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির সৃষ্টি করছে, যা বৈশ্বিক সংকট সমাধানের পথে বড় এক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি দ্রুতই এই সংকটের সমাধানে সব দেশ সক্রিয়ভাবে এগিয়ে না আসে এবং দুর্নীতির অবসান ঘটিয়ে দায়িত্বশীলতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করে, তবে বাংলাদেশের মতো জলবায়ুপ্রবণ বহু দেশ ক্রমে বিলীন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
কপ–২৯ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে, যদি অংশগ্রহণকারী দেশগুলো আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসে। উন্নত দেশগুলোর কাছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি মানবিকতার ভিত্তিতে সহায়তার প্রত্যাশা রয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, বিশ্বের অনেক দেশই জলবায়ু তহবিল ব্যবহারে দুর্নীতির কারণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার অপব্যবহার জলবায়ু তহবিলের কার্যকর ব্যবহারে বাধা সৃষ্টি করছে। যদি এই পরিস্থিতির পরিবর্তন না ঘটে এবং সব দেশ সমানভাবে সহায়তার হাত না বাড়ায়, তবে বাংলাদেশের মতো অনেক জলবায়ুপ্রবণ দেশ অদূর ভবিষ্যতে প্রকৃতপক্ষে বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে। সুতরাং, কপ–২৯ শুধু একটি সম্মেলন নয়; এটি একটি বাস্তবায়নযোগ্য পরিবর্তনের সুযোগ, যা সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে পৃথিবীকে একটি নিরাপদ ও বাসযোগ্য ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে পারবে।