মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক রেমিট্যান্স–যোদ্ধারা কেন তৃতীয় শ্রেণির: প্রসঙ্গ ঔপনিবেশিক আধিপত্য

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির কারণগুলোর মধ্যে প্রধান একটি প্রবাসী আয়প্রথম আলো ফাইল ছবি

আমি রেমিট্যান্স–যোদ্ধাদের নিয়ে অনেক রকম লেখা পড়েছি। প্রায় সব লেখাই পয়সাকড়ির হিসাবে ঠাসা। কিন্তু কোনো লেখাই আমাদের ঔপনিবেশিক দাসত্বের আচরণ সম্পর্কে লেখেনি! আমি আমার পড়ালেখা এবং কাজের সূত্রে প্রায় ২০ বছর বাইরে যাওয়া–আসা করি। খেয়াল করেছি, মূলত কম দক্ষ শ্রমিকেরা মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে অঞ্চলে যান। এঁদের মধ্যে অনেকে বাংলা ও ইংরেজি কোনোটাই ঠিকমতো বোঝেন না। অধিকাংশ সময়ে বিমানবন্দরে একশ্রেণির কর্মকর্তা থাকেন, যাঁরা টাকার বিনিময়ে তাঁদের চেকিং ফরমটা পূরণ করে দেন। বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা যখন বোঝেন যে এঁরা নিরক্ষর এবং সাধারণ কোনো কাজকর্ম করে, তখন তাঁদের চেহারা উপনিবেশদের মতো হয়ে যায়। এটা তখন আরও নির্মম হয়, যখন তারা চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়া বাংলাদেশে ছুটিতে আসে। এ প্রবাসীরা সাধারণত বিদেশি কম্বল, সোনা ও ইলেকট্রনিকস পণ্য এনে থাকে।

এ মানুষগুলো যখন লাইনে দাঁড়ায় পাসপোর্ট চেক করার জন্য, তখন তাঁদের অশ্লীল ভাষাই চিৎকার করা হয়, যাতে তাঁরা ভয়ে জড়সড় হয়। শুধু তা–ই নয়, তাদের ব্যাগগুলো কেটে মালপত্র চুরির ঘটনাও ঘটে। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে আমাদের বর্তমান সরকার তাঁদের জন্য আলাদা ভেন্যুর ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছে। যে মানুষগুলো আপনার রিজার্ভ তৈরি করছে, পরিবার টানছে, সমাজ গঠন করছে, তাঁরা কেন এতটুকু ভালো সার্ভিস পাবে না!

অন্যদিকে আমরা যারা দক্ষ প্রফেশনাল, মূলত একাডেমিক, প্রকৌশলী ও চিকিৎসক—তাদের গন্তব্য ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। আমরা সবাই আত্মবিশ্বাসী যে আমরা বাংলাদেশের ক্রিম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরের দিকের শিক্ষার্থী। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রকৌশলী অথবা যে–ই হই না কেন, আমরা উপনিবেশকদের দেশে যাচ্ছি পড়তে। ওরা আমাদের পড়ার জন্য টাকা দিচ্ছে, এর চেয়ে সম্মানের আর কিছু হতে পারে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্পষ্ট করে লেখা থাকে নর্থ আমেরিকা, ইউনাইটেড কিংডম, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের পিএইচডি শিরোধার্য।

কারণ এরা সবাই ইংলিশ স্পিকিং দেশ। আমরা যখন বিমানবন্দরে যাই আমাদের ঠাটবাটের–কাপড়চোপড় পরা থাকে, না চাইলেও আমরা ঠকাঠক ইংলিশ বলার চেষ্টা করি। আমাদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করার সময় আমাদের মুখে থাকে একধরনের তাচ্ছিল্যের হাসি যে আমি আমজনতা বাংলাদেশি নয়।

বিমানের কর্মীরা আমাদের সঙ্গে তুই–তোকারি করতে ভয় পায়, যদি উন্নত দেশের দূতাবাসে অভিযোগ করি। দুঃখের বিষয় মোট মাইগ্রেশনের তুলনাই আমাদের সংখ্যা মাত্র ৪ শতাংশ। মধ্যপ্রাচ্যের তুলনাই অতিনগণ্য। অনেক গোলটেবিল বৈঠক হয় কিন্তু সেখানে এই সাধারণ প্রবাসীরা জায়গা পান না। সেখানে থাকে আমাদের মতো দ্বৈত সত্তার Colonial ডক্টরেট, যাঁরা এই প্রবাসী ভাইদের জন্য আলাদা বসার জায়গা ঘোষণা করেন। আমরা একই দেশের মানুষ কিন্তু ওরা কী অন্যায় করেছে? এ মানুষেরাই জুলাইয়ের আন্দোলনে রেমিট্যান্স বন্ধ করে দেশের অর্থনীতি নিষ্ক্রিয় করে দিয়াছিলেন। বিমানের সেবা উপনিবেশায়ন থেকে মুক্ত না করে আমরা তাদের তৃতীয় শ্রেণির মানুষ বানাচ্ছি। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত বিউপনিবেশায়নের (Decolonization) ওপর কোনো আলোচনা অথবা কার্যক্রম নেই। কারণ, আমরা সবাই স্যার/ম্যাডাম।

আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়েছি, কিন্তু কোনো দেশে দেখিনি এত ভাগ/বিভাগ–সাধারণ, ভিআইপি ও রেমিট্যান্স। আমাদের মতো গরিব একটি দেশে কেন ব্রিটিশদের ভিআইপি ব্যবসা থাকবে?

  • শাহিদা খানম, বোর্ড মেম্বার, প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন, কানাডা