আজ উপমার বিয়ে

বর–কনের সঙ্গে লেখকসহ অন্যরা
ছবি: সংগৃহীত

বিয়ে তো আসলে উপমা ও নাসিফের। কিন্তু শুধু উপমার কথা লিখলাম এ জন্য যে আমরা ছিলাম কনেপক্ষ। এ ছাড়া নাসিফ ও তার পরিবারকে চিনতে শুরু করেছি গত দুই-তিন মাস ধরে, ওদের দুই পরিবারের সম্বন্ধ শুরু হওয়ার পর। খুব কাছ থেকে ওদের দেখার সুযোগ হয়নি। তবুও অল্প কিছুদিনের পরিচয়ে ওদেরকে বেশ ভালোই লেগেছে।

উপমার পরিবারকে চিনি সেই ৯ বছর ধরে। গোল্ড কোস্টে বসবাসের সপ্তাহখানেক পর প্যারাডাইস পয়েন্ট পার্কে একটা অনুষ্ঠানে। সাধারণত কোনো শহরে নতুন কেউ এলে আমাদের কমিউনিটির কিছু লোক একটু দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে, ব্যক্তিত্ব দেখায়। কিন্তু উপমার বাবা মামুন চৌধুরী সাহেব ছিলেন ব্যতিক্রম। মামুন ভাই নিজ থেকেই এসে কথা বলেন। অল্পক্ষণের মধ্যে কেমন আপন করে নেন। আমি লেখালেখি করি জেনে তাঁর আগ্রহের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। তিনি প্রচুর বই পড়েন। এর কিছুদিন পর তাঁর হাইল্যান্ড পার্কের বাড়িতে গিয়ে আমি তো মোহিত হয়ে যাই। পাহাড়ের ওপর তিনতলা বাড়ি থেকে প্রায় অর্ধেক গোল্ড কোস্ট শহর দেখা যায়। তিনি জানান, তিনতলার কাচ পরিবেষ্টিত ব্যালকনিতে বসে প্রশান্ত মহাসাগরের বিস্তৃত জলে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখেন। আমি সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর বাড়িটার নাম দিই ‘কাব্যবাড়ি’।

বর–কনের ছবি
ছবি: সংগৃহীত

সাধারণত প্রবাসে কিছু ব্যতিক্রম বাদে অনেকেরই সকালের সম্পর্ক বিকেলে থাকে না, বিকেলের সম্পর্ক সকালে। এটা স্বাভাবিক, এখানে কেউ কারও বাল্যবন্ধু নয়, কোনো আত্মীয়স্বজনও নয়। তারপরও লতাপাতায় জড়ানো সম্পর্কটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে যখন কমিউনিটির কেউ অসুখে পড়ে বা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যায়। তখন সবাই হাসপাতালে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এখানেই বাঙালিরা মহৎ, সবচেয়ে আবেগী জাতি। তখন চরম শত্রুকেও ভালোবাসতে ইচ্ছা করে।

দীর্ঘ ৯ বছরে মামুন ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কখনই ওঠানামা হয়নি। আমাদের সম্পর্কটা বরাবরই শ্রদ্ধা ও স্নেহের। যদিও প্রবাসের বাস্তবতায় খুব একটা দেখা হয়নি। এ ছাড়া মামুন ভাই ও শারমিন ভাবির প্রতি আমার শ্রদ্ধা একটু বেশি এ কারণে, তাঁদের এ দুজনের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে জড়িত। মামুন ভাই এসেছেন আমাদের মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল এম এ জি ওসমানীর পরিবার থেকে। আর শারমিন ভাবির বাবা ছিলেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বুদ্ধিজীবী হাবিবুর রহমান। যিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন বলে ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তাঁকে বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর নামানুসারে একটি ছাত্র হলের নামকরণ ‘শহীদ হাবিবুর রহমান হল’ রেখেছেন এবং হলের সামনে ‘বিদ্যার্ঘ’ নামে তাঁর একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ প্রদান করেছেন।

২.
উপমাকে প্রথম যখন দেখি, তখন সে সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে শুরু করেছে। মামুন ভাই বলেন, উপমা লেখালখি করে। অবশ্যই ইংরেজিতে। বর্তমানে সে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে পুরোদস্তর আইনজীবী। আর নাসিফ একটা সংস্থায় চাকরি করে।

দুই-তিন মাস ধরেই গোল্ড কোস্টে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু উপমা ও নাসিফের বিয়ে। উপমা মামুন ভাই ও শারমিন ভাবির ছোট মেয়ে। এক অর্থে তাঁদের পরিবারে সেটা শেষ বিয়ে। আর নাসিফ বিশিষ্ট মেডিকেল স্পেশালিস্ট ডা. জামান ও ডা. নাসরিন জামানের একমাত্র ছেলে। তাই বিয়ের প্রতিটি অনুষ্ঠানের পরতে পরতে তাঁরা কোনো কমতি রাখেননি। প্রস্তাব পাঠানোর আলাদা অনুষ্ঠান, বাগ্‌দানের জন্য আরেকটা অনুষ্ঠান, আকদের জন্য লেকের পাড়ে বিশাল অনুষ্ঠান। তারপর মেহেদি নাইট, রং খেলা, আরও কত কী! সবচেয়ে বড় দুটি অনুষ্ঠান হয়েছে গায়ে হলুদ ও বিয়ের অনুষ্ঠান। গায়ে হলুদ হয়েছে গোল্ড কোস্ট রোবিনা অডিটরিয়ামে আর বিয়ের অনুষ্ঠান ব্রিসবেনে বিখ্যাত গ্রিক ক্লাবে।

মেয়ে অবন্তিকার আঁকা বর–কনের ছবি
ছবি: সংগৃহীত

গ্রিক ক্লাবে বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার সময় পাশে বসা এক বন্ধুকে একটা গল্প বললাম। সেটা ১৯৯৪-৯৫ সালের কথা। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। সূর্যসেন হল ছিল আমার আবাসিক হল। আমাদের হলের ডাইনিং বা ক্যানটিনের খাবার ছিল একেবারে যাচ্ছেতাই। তাই মাঝেমধ্যে আমরা খুঁজতাম, সস্তায় ভালো কোথায় খাওয়া যায়। নীলক্ষেতের মোড়ে এক রেস্তোরাঁয় সস্তায় খাওয়ার জন্য একজনকে তো চাচাই বানিয়ে ফেলেছিলাম। চাচা আলাদা করে আমার জন্য রুই মাছের মাথাটা রেখে দিতেন। কিন্তু সব সময় তো আর বাইরে খাওয়া যায় না। আমার বাবা একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পাঠাতেন। মাসের শেষে এমনিতেই টাকার টান পড়ে যেত। এটাই ছাত্রাবাসে থাকা প্রতিটি ছাত্রের ট্র্যাজেডি অথবা জয়...। তাই বাইরে রেস্তোরাঁয় খাওয়া আর সম্ভব হতো না। আমাদের আবার হলের ডাইনিং বা ক্যানটিনই বেছে নিতে হতো।

সূর্য সেন হলের আমার দুই-চারজন বন্ধু আমাকে বলত, চল, সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে ফ্রিতে রোস্ট-পোলাও বা বিরিয়ানি খেয়ে আসি। তখন বাংলামোটরের সোহাগ কমিউনিটি সেন্টার বিয়ে বা যেকোনো অনুষ্ঠানের জন্য খুব প্রসিদ্ধ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক হলের কোনো কোনো ছাত্র হলের খাবারে অতিষ্ঠ হয়ে সুযোগ বুঝে সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারে কখনো বরপক্ষ সেজে, কখনো কন্যাপক্ষ সেজে চলে যেত। সব সময় যে করত, তা নয়। কালেভদ্রে করত। কিন্তু তখনো আমার সেখানে যাওয়া হয়নি।

বর–কনের সঙ্গে দ্বিতীয় প্রজন্ম
ছবি: সংগৃহীত

একবার আমি হলের বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে গিয়েছিলাম। সেকি দুরাবস্থা আমার! আমরা তিন বন্ধু মিলে যাই। ঠিক বলিউডের ‘থ্রি-ইডিয়েটস’ মুভির মতো। আমরা খুব সম্ভব বরপক্ষ সেজে যাই। আমার সঙ্গে আসা বাকি দুই বন্ধু খুব স্বাভাবিক। ওরা আগেও এসেছে। কিন্তু আমার হাত–পা কাঁপছিল। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল, রোস্ট-বিরিয়ানির লোভ করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাব। ধরা পড়ার পর কী অবস্থা হবে, সেটা ভাবতে ভাবতেই আমার কলিজায় পানি ছিল না। মনে হচ্ছিল, আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে।

একসময় আমি বন্ধু দুজনকে কোনো বলার সুযোগ না দিয়ে, সেখান থেকে দৌড়ে বের হয়ে যাই। সেকি দৌড়! পরে শুনেছি, ওদের কিছুই হয়নি। কেউ জিজ্ঞেসও করেনি, ওরা বরপক্ষ না কন্যাপক্ষ। শেষ পর্যন্ত আমি সেই বন্ধু দুজনের কাছ থেকে ‘কাপুরুষ’ উপাধি পাই। আমি এরপর আর কোনো দিন সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারে যাইনি। আজও না।

৩.
২৬ বছর ধরে পরবাসে আছি। এক অর্থে বলা যায়, প্রবাসে এটাই আমার প্রথম কোনো গায়ে হলুদ ও বিয়ে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা। সেটা কীভাবে সম্ভব, সেটা বলি। একে তো অভিবাসী হয়ে আসার পর এক শহর থেকে আরেক শহর, এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরছি। জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছি নিউজিল্যান্ডে। নিউজিল্যান্ডে যে দুই-চারটা বিয়ে হয়েছে, সেগুলোয় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। আর বেশির ভাগই দেখা গেছে, বাংলাদেশে বিয়ে করে এসে নিউজিল্যান্ডে বিবাহোত্তর পার্টি দিয়েছে, সেটা ভিন্ন ব্যাপার।

অস্ট্রেলিয়াতেও একই ব্যাপার। নতুন করে নতুন দেশে জীবনটা গোছাতে গোছাতে সময় কীভাবে যে চলে গেছে! এরই মধ্যে দুই-তিনটা বিয়ের নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, সেগুলো ছিল সিডনিতে। অত দূর আর যাওয়া সম্ভব হয়নি। সেই অর্থে উপমা ও নাসিফের গায়ে হলুদ ও বিয়ে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা ছিল আমাদের জন্য অন্য রকম আনন্দের। আমার ছেলেমেয়ে দুটিও প্রথম কোনো গায়ে হলুদ ও বিয়ে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে। ওদের আনন্দের সীমা ছিল না। ছেলে অনিম তো নাসিফ-উপমার গায়ে হলুদ ও বিয়ে অনুষ্ঠান—দুটিতেই কন্যাপক্ষের হয়ে নেচেছে। মেয়ে অবন্তিকা কয়েক সপ্তাহ রাত জেগে নাসিফ ও উপমার পেনসিল স্কেচ করেছে, যা দেখে সবাই খুব মোহিত হয়েছে।

গায়ে হলুদে অনিমদের নাচ
ছবি: সংগৃহীত

উপমা ও নাসিফ প্রবাসে আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে ও বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসক হয়ে আমরা যাঁরা অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে অভিবাসী হয়ে এসেছি, তাঁরা সবাই প্রবাসে প্রথম জীবনে যে কষ্টটা করেছি, তা কেউ বিশ্বাস করবে না। এমনকি আমাদের ছেলেমেয়েদেরও বোঝাতে পারব না। ওরা দেখে, মা-বাবা প্রতিষ্ঠিত। আসলে আমরা ওদের জন্যই বিদেশ করছি। ওরা ভালো থাকবে, নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করবে। নয়তো আমরা দেশে কম কি ছিলাম?

হ্যাঁ, অবশ্যই ওরা ভালো আছে। আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম প্রবাসে বেশ ভালো করছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে। এমনকি চাকরির ক্ষেত্রেও। আমি আমাদের গোল্ড কোস্ট শহরের কথা বলি। এখানে আমাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া ও চাকরির ক্ষেত্রে কে কার থেকে ভালো করবে, এমন একটা প্রতিযোগিতায় থাকে। প্রতিটি ছেলেমেয়ের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বও বিদ্যমান। আমি মনে করি, প্রত্যেকে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এটা একটা ভালো দিক।

অতলান্ত ভালোবাসা আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মকে। ভালোবাসা নাসিফ ও উপমাকে। তাদের নতুন জীবন স্বপ্ন ও স্বর্গের মতো হোক।

*লেখক: মহিবুল আলম, গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া