মায়ের হাতের গরুর মাংস
ছোটবেলা থেকে গরুর মাংস খুবই প্রিয়। মায়ের হাতের গরুর মাংসের স্বাদ আজই যেন মুখে লেগে আছে। মায়ের হাতের সব রান্না সুস্বাদু, তবে গরুর মাংস একটু বেশি প্রিয় ছিল। গরুর মাংসের সঙ্গে ছোট ছোট টুকরা করে আলু দিতেন। খাবারে গরুর মাংস হলে ভাতের চেয়ে তরকারি বেশি খেয়ে ফেলতাম। মনে মনে দোয়া করতাম, ছোট মামা যেন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। কারণ, ছোট মামা এলে মা গরুর মাংস রান্না করতেন। মামাকে আমাদের বাড়িতে আসতে দেখলে মনে মনে অনেক খুশি হতাম। মামার সঙ্গে খাবারের টেবিলে বসতাম। মামা আমাকে বলতেন, ‘তুমি ছোট মানুষ, বেশি বেশি করে খাবার খাও।’ সেই সুযোগে গরুর মাংস একটু বেশি খেয়ে ফেলতাম।
গরুর মাংস ও রুটি ছিল আমার খুবই প্রিয়। ঈদের সময় আমাদের গ্রামের বাড়িতে গরু কোরবানি দিত। গ্রামের বাড়িতে গরু কোরবানি দিয়ে গরুর মাংস কেটেকুটে ভাগ করে আমাদের বাসায় আনতে অনেক সময় লেগে যেত। তারপর মা গরুর মাংস রান্না শুরু করতেন। অপেক্ষায় থাকতাম, কখন যে মা গরুর মাংস আর রুটি বানানো শেষ করবেন। গরুর মাংস আর রুটি বানানো শেষ হলে আমাদের খাবার টেবিলে ডাকতেন। বড় একটা ডিশে গরুর মাংস বেড়ে দিতেন। সঙ্গে অনেকগুলো রুটি দিতেন। আমি আর আমার ছোট চাচা দুজনে মিলে গরুর মাংস এবং রুটি অনেক খেয়ে ফেলতাম। ছোট চাচা তো মায়ের হাতের গরুর মাংসের রান্না প্রশংসা করতেন আর একের পর এক রুটি ও গরুর মাংস খেয়ে যেতেন। ছোট চাচার প্রশংসা শুনে মা-ও অনেক খুশি হতেন।
তারপর প্রবাসজীবনে পাড়ি জমাই। প্রবাসে মায়ের হাতের রান্না করা গরুর মাংস খুবই মিস করতে থাকি। প্রতি ঈদে মায়ের কথা অনেক মনে পড়ত। প্রবাসে গরুর মাংস অনেক খেয়েছি, কিন্তু মায়ের হাতের রান্না করা গরুর মাংসের মতো হতো না। একবার মা এক পরিচিতের কাছে আমার জন্য কোরবানির গরুর মাংস পাঠিয়েছিলেন। আমি যেভাবে পছন্দ করি, সেভাবে রান্না করে পাঠিয়েছিলেন। গরুর মাংসের সঙ্গে ছোট ছোট টুকরা করে আলু দিয়েছিলেন। উনি দেশ থেকে আনার পর আমাকে বাসায় না পেয়ে ফোন দেন। আমি তখন চাকরিতে ছিলাম। আমি উনাকে বাসায় রেখে যেতে বললাম। উনি টেবিলের ওপর রেখে চলে গেলেন। তাড়াতাড়ি বাসায় এলাম। অনেক দিন পর মায়ের হাতের রান্না করা গরুর মাংস খাব বলে। অনেক এক্সাইটেড ছিলাম।
গরুর মাংসের বক্স খুলে অনেক খুশি হলাম। কয়েক টুকরা গরুর মাংস টপটপ করে খেয়ে ফেললাম। কিছুক্ষণ পর গরুর মাংস থেকে দুর্গন্ধ আসতে থাকে। গরুর মাংসগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। মায়ের হাতের গরুর মাংস খেতে না পেরে অনেক কষ্ট পেলাম। গরুর মাংস ফেলে দিতে খুব কষ্ট লাগছিল, তাই আবার ফ্রিজে রেখে দিলাম। এক পরিচিত মামা ফ্রিজে গরুর মাংস দেখে এক টুকরা মুখে দিয়ে আমাকে বলতে লাগলেন, ‘গরুর মাংস নষ্ট হয়ে গেছে, তুমি এগুলো ফেলে দাও।’ মায়ের হাতে রান্না করা গরুর মাংস ফেলে দিতে খুব কষ্ট লাগছিল, বুক ফেটে কান্না আসতে লাগল। চোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি পড়তে লাগল। মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় মাকে বলেছিলাম, ‘মা তোমার হাতের রান্না করা গরুর মাংস অনেক মজা হয়েছে। অনেক দিন পর পেটভরে খেলাম।’ আমি যে গরুর মাংস ফেলে দিয়েছি, সে কথা জানতে পারলে মা অনেক কষ্ট পাবেন বলে মাকে সেদিন মিথ্যা কথা বলেছিলাম।
প্রবাসে স্ত্রী চলে আসার পর অনেক রকমের সুস্বাদু খাবার রান্না করে। গরুর মাংসও অনেক মজা করে রান্না করতে পারে। তারপরও মায়ের হাতের গরুর মাংসের স্বাদটাই যেন অন্য রকম। একদিন দুষ্টুমি করে বউকে বলেছিলাম, গরুর মাংসের রান্না অনেক মজা হয়েছে, কিন্তু আমার মায়ের হাতের রান্নার মতো না। বউ যেন একটু লজ্জা পেয়ে গেল। মা মাঝেমধ্যে নানির রান্নার গল্প শোনাতেন। কারও বাড়িতে বিয়েশাদি হলে নাকি নানিকে ডাকত। আমি মাকে বলতাম, বুড়ো বয়সে নানি এত মানুষের রান্না কীভাবে করতেন?
মা তখন বলতেন, রান্না তো বাবুর্চি করত, নানি শুধু দেখিয়ে দিতেন। উনার হাতের স্পর্শে নাকি খাবার অনেক সুস্বাদু হয়ে যেত। নানির সেই গুণ নাকি মা পেয়েছেন। আসলেই মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। আর গরুর মাংসের স্বাদ তো অতুলনীয়।