একটি রাবীন্দ্রিক কথোপকথন

সংলাপে জয়দীপ চক্রবর্তী এবং সংঘমিত্রা
ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি নিয়ে সেদিন একটি সংলাপ দেখলাম। ভারতীয় দূতাবাসের সান্ধ্যকালীন এ অনুষ্ঠানটি ছিল প্রাণময়। নাট্যজন জয়দীপ চক্রবর্তী কোনো কথাকে মধুর করে আনার ক্ষেত্রে বরাবরই মুনশিয়ানার পরিচয় দেন। এ দিন তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অন্যদিকে সংঘমিত্রা দত্ত অভিনয়ে যেমন পারদর্শী, তেমনি তাঁর উপস্থাপনার গুণও ঈর্ষণীয়। মুগ্ধতা নিয়ে শ্রোতা–দর্শকেরা উপভোগ করলেন সময়টি।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা নিয়েই শুরু। কথার সূত্রপাত করেন জয়দীপ চক্রবর্তী। উদ্ধৃত করলেন কবির প্রেমবিষয়ক কবিতার কিছু লাইন। বললেন, সত্যিই রবিঠাকুরের কবিতাগুলো পড়লে মনে হয়, এগুলো আমাদের জন্যই লেখা। জয়দীপ এসবের ইংরেজি অনুবাদও যুক্ত করলেন। মঞ্চের বিপরীত দিকে ছিলেন সংঘমিত্রা দত্ত। তাঁর উদ্দেশ্যে প্রথমজন বলছিলেন, রবিঠাকুরের কথা শতবর্ষ নয়, হাজার বছর পরেও পাঠক প্রতিদিন মনে করতে থাকবে। আসলেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের মনের কবি, প্রাণের কবি। একজনের বাল্যকাল, শৈশব-কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য—সব অধ্যায়ের সঙ্গে কবির ভাবনা জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে।

একদম ঠিক বলেছ জয়দীপ দা! সংঘমিত্রা সমর্থন করে বলেন, আমাদের সব আবেগের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাই। যখন যন্ত্রণাগুলো চোখের জলে ভাসে, কবির লেখা সে দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। যদি একজনের ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে তখনো কবি একা চলার সাহস যোগান।

আলাপ জমে ওঠে। দুজনই যে সাংস্কৃতিক জগতের বাসিন্দা! জয়দীপ চক্রবর্তী নাটক পরিচালনা করেন। আর সংঘমিত্রা অভিনয়ে পারদর্শী। দুজনই সংস্কৃতির অন্যান্য মাধ্যমেও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে চলছেন।

তুমি যদি ভালোবাসার দিকটা দেখ, দেখবে, এটা কখনো কষ্টের, কখনো মধুর, কখনো–বা স্বপ্ন জড়ানো একটি গল্প। এর আবেগ প্রতিনিয়তই আমরা উপলব্ধি করি তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে। কী আবেদন দেখো! ‘ভালোবেসে সখি নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে।’ জয়দীপের কথা শেষ হতে না হতেই সংঘমিত্রা কবি-প্রেমের তাৎপর্যপূর্ণ দিকটিতে মনোযোগ আকর্ষণ করেন। ভানুসিংহের পদাবলী উচ্চারিত হয় তরুণীর মুখে। কণ্ঠে ভিন্ন মাত্রা আনলেন। ‘গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে, মৃদুল মধুর বংশী বাজে।’ ভালোবাসার সাগরে ভেসে এই লেখা। বলেন সংঘমিত্রা।
এরপর তাঁরা ছুটে যান অন্য এক ভুবনে।
এ আয়োজন নৃত্যের।

যে তরুণীরা নেচেছেন মঞ্চে
ছবি: সংগৃহীত

নৃত্য দিয়েই জয় করা হলো চরাচর। তরুণী মায়েরা নাচ উপহার দিয়েছেন। নিজেদের মতো করে কোরিওগ্রাফ করেছেন। তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্য তাঁদের নিজস্ব ভুবনে। উল্লেখ করতেই হয়, রাবীন্দ্রিক এ পর্বের পরিচ্ছদ নকশা করেছেন স্থাপত্য জগতের অবন্তি সেনগুপ্ত। তাঁর কাজ এবং এর বৈশিষ্ট্য ছুঁয়ে গেছে ঠাকুরবাড়ির মহিলা মহল। মনে করা যায়, সাজসজ্জায় উঠে এসেছে জোড়াসাঁকোর নারীর মাহাত্ম্য।

সোনালী ঠাকুরতা আর সোনালী হালদার এলেন ‘তবু মনে রেখো’...এ অনুরোধ বা আকুতি নিয়ে। প্রিয় মানুষটির প্রতি দুর্নিবার টান বলেই এমন কথা। নতুন কোনো প্রেমজালে পুরনো প্রেম ঢাকা পড়ে যেতে পারে। আবার কাছে থাকার পরও ছায়ার মতো দেখতে না পাওয়া সে অনুভূতি কোথায় যেন নিয়ে যায়! তবে তা হৃদয়ে দাগ কেটে এগোয়। এই রাস এই লীলা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তারপরও মনে রাখার পথটি কেন বন্ধ থাকবে। প্রতিধ্বনি বলে, ‘মনে রেখো...।’

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন। তিনি আছেন আমাদের চিরসখা হয়ে। তিনি তাঁর বহু কবিতাকে গানের সুরে বেঁধেছেন। মানসী কাব্যগ্রন্থের এ কবিতাও তাই। আজ হলো তারই নৃত্যায়ন।

বৈষ্ণব কবিদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পদ রচনা করেছেন ভানুসিংহ ছদ্মনামে। ভানুসিংহের সেই পদাবলি মঞ্চায়ন হলো। উপভোগ করলেন দর্শকেরা। গানে আর নৃত্যে।

মঞ্চে ঝুমা বিশ্বাস এবং রিপতা রায় চৌধুরী
ছবি: সংগৃহীত

ঝুমা বিশ্বাস, রিপ্তা রায় চৌধুরীর নাচ অনন্য হয়ে উঠল। ‘শুনলো শুনলো বালিকা, রাখ কুসুম মালিকা, কুঞ্জ কুঞ্জ ফেরনু সখি, শ্যামচন্দ্র নাহি রে।’

রবিঠাকুর বুকের গভীরে বসেই লিখেছেন। তা না হলে এত অন্তর টানা হয়ে ওঠে কীভাবে! পূজা পর্যায়ের এই গানের মধ্য দিয়ে তাঁর ঈশ্বর ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। এ এক অন্য রকম প্রাপ্তি, আনন্দও বটে। সবার মুখে মোহনীয় হাসি, ‘বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা।’

নৃত্যে তরুণীদের মোহনীয় প্রকাশ দর্শকের সমূহ প্রশংসা কুড়াল। এ পর্যায়ে নাচলেন অবন্তি সেনগুপ্ত, সৌমি ঘোষ আর তমা। মাত করে দিলেন চরাচর।  পূজা পর্বের আর একটি গান ‘মেঘ বলেছে যাব যাব, রাত বলেছে যাই।’ সত্যিই অরূপ দেবতাকে প্রিয় সখারূপে কল্পনা করে তার সঙ্গে মিলনের আকাঙ্ক্ষা। নৃত্যে এরই রূপায়ন।

চিকচিক করে ওঠে চারপাশ। আর এর সার্থকতা শিল্পীদের হাত–পা–দেহ সঞ্চালনের তাল–লয়–ছন্দে। স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। চমৎকার একটি আবহে ঘিরে রাখেন তাঁরা। দর্শকশ্রোতার মুখে মুগ্ধতা। এ গৌরব অর্পিতা রাহা, সানহিতা শাঁসমল আর মৌমিতা মুখার্জীর।
কথা শেষ হয় না।

রবীন্দ্রনাথকে ধরেই জয়দীপ এগোন। সংগীত বিশ্বজনীন। সংগীতের কোনো সীমানা নেই। সংগীতে মুক্ত হাওয়া লাগলে গতি আসবে তাতে। রবীন্দ্রনাথ গানে রাগের ব্যবহার করেছেন বিস্তর। তিনি যোগ করেন, রবিঠাকুর বিশ্বাস করেন রাগ–রাগিনীর গুণী স্রষ্টারা ভারতীয় সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছেন।

রাগসংক্রান্ত আলোচনায় সংঘমিত্রা বলেন, এ মন্তব্য একদম ঠিক। বাঙালির উৎসব দুর্গাপূজার প্রাক্কালে আকাশে–বাতাসে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে আনন্দের দোলা। তিনি সুনির্দিষ্ট করে বলেন, এ সময় রবিঠাকুরের ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ বাজে আমাদের মধ্যে। মালকোষ রাগের প্রভাব এতে স্পষ্ট। এমনি আরও অনেক গানে তাঁর কবি-ভাবনা রাগের সুরে একাকার হয়ে গেছে। ঘটেছে সংগীতের এক অপূর্ব মিলন।

এগুলো না দেখলে আমরা আজ অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হব। সংঘমিত্রা দত্ত এবার আহ্বান জানালেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টির কিছু মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে।

আবার নৃত্য। এবার তাঁরা দলে দলে মঞ্চে এলেন। ভিন্নভিন্নভাবে মঞ্চ কাঁপালেন। একবার প্রস্থান করলেন, আবার এলেন। নৃত্যের মধ্যদিয়েই শেষ হলো অনুষ্ঠান।