দ্বান্দ্বিকতার ঈদ
প্রত্যাশিত সময়ের আগেই প্রায় ভোর চারটায় ঘুম ভেঙেছে। মুঠোফোনে পাঁচটার অ্যালার্ম দেওয়া ছিল। ঘুম ভাঙার পরেও মনে দ্বান্দ্বিকতা কাজ করছিল। মনের বিরুদ্ধেই গুয়াংজু ভ্রমণে যাচ্ছি। যেকোনো ভ্রমণে যাওয়ার আগে আমার মধ্যে বেশ উদ্দীপনা কাজ করে। আর সেটা যদি হয় নতুন কোনো দূরের শহর, তখন উদ্দীপনার পারদ নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। এবার ব্যতিক্রম, তারপরও দ্রুত নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছি।
গুয়াংজু ভ্রমণ নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল। কোরিয়ার গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে গুয়াংজু তার নামকে আরও অর্থবহ করে তুলেছে। কোরিয়ান ভাষায় গুয়াংজু শব্দের অর্থ আলোর প্রদেশ। আশির দশকের গোড়ায় ছাত্রদের দ্বারা সংঘটিত গণতন্ত্রের জন্য অভ্যুত্থান সামরিক স্বৈরশাসকের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। বিখ্যাত এশিয়া কালচার সেন্টার এ শহরেই অবস্থিত। এ ছাড়া গুয়াংজু স্টেডিয়ামে ২০০২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়া শক্তিধর স্পেনকে হারিয়ে প্রথম এশীয় দল হিসেবে সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে নতুন ইতিহাস রচনা করে।
সকাল সাড়ে ছয়টায় সবাইকে ইয়াংসান সাবওয়ে স্টেশনে মিলিত হতে হবে। ডরমিটরি থেকে মিনিট চল্লিশের মধ্যেই ইয়াংসান স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। ইয়াংসান যাত্রাকালে মেট্রোতে দেখলাম জনাপাঁচেক ইন্দোনেশিয়ান ছাত্র। তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘সারং’ পরে ইন্দোনেশিয়ান দূতাবাসে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করায় তারা যখন জানাল, দূতাবাস থেকে সিউল কেন্দ্রীয় ঈদগাহ যাবে। তখন আমার মনটা আবার দুমড়ে গেল। প্রবাসের প্রথম ঈদ তো একেবারেই ভিন্নভাবে কাটতে যাচ্ছে। রমজানের বেশির ভাগ দিনেই কেন্দ্রীয় মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছি, কখনো ইফতার করেছি। তাই ইত্তেউন মসজিদে ঈদের নামাজ পড়ব, বহুসংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেব, দেশে থাকা প্রিয় মানুষগুলোর মুখ তাদের মধ্যে খুঁজে ফিরব, কিন্তু তা এবার হচ্ছে না।
সবাই ধারণা করেছিল, কোরিয়ায় ঈদ সৌদি আরবের সঙ্গে মিলিয়ে ২১ এপ্রিল উদ্যাপিত হবে। যেহেতু রমজান শুরু হয়েছিল একই দিনে, তাই ২২ এপ্রিলের ট্যুরটা বুক করেছিলাম। কিন্তু কোরিয়ায় ঈদ ২২ এপ্রিল উদ্যাপিত হচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে একই দিনে।
ইয়াংসান স্টেশনে গিয়ে দেখলাম, সবাই একে একে মিলিত হচ্ছে—বেশ কয়েকজন ইউরোপিয়ান, ভারতীয় আর আফ্রিকান। আমরা বাসে যার যার নির্ধারিত আসনে বসে সিটবেল্ট বেঁধে নিলাম। সিউল থেকে সড়কপথে গুয়াংজুর দূরত্ব প্রায় চার ঘণ্টার। ট্যুর গাইড একজন ডাচ নারী—ইলনাজ। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি হবে। যথাসময়ে বাস যাত্রা শুরু করল। ছাড়ার আগে মন বলছিল, ফিরে যাই। কিন্তু মন মস্তিষ্কের সঙ্গে পেরে উঠল না।
ইলনাজ সবার সঙ্গে পরিচয় পর্ব সেরে জোকস বলে সবাইকে জমিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমার কাছে জোকসগুলো খুবই প্রাণহীন কৃত্রিম লাগছিল। বরাবরের মতো দীর্ঘ যাত্রায় জানালার পাশে বসেছি। দৃষ্টিজোড়া আকাশ, পাহাড়, নদী, জনপদ—সব দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আজ এগুলো কিছুই আমাকে টানছে না। মনের বাতায়নে যে ভিন্ন কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম। শৈশবে কুমিল্লায় নানাবাড়ি, দাদাবাড়ির ঈদ। ঈদের দিনে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া কিংবা কৈশোরে ঢাকার ঈদ। ছোট ভাইদের সঙ্গে নিয়ে আব্বুর ঈদগাহে যাওয়া। ঈদের নামাজের পর বন্ধুদের সঙ্গে মজা করা, ঈদের লাচ্ছা সেমাইসহ নানা পদের শাহি খাবার। সর্বশেষ ভেসে এল করোনাকালীন গৃহবন্দী ঈদ।
ঘণ্টাখানেক মহাসড়কে যাত্রার পর মস্তিষ্ক মনের দ্বান্দ্বিকতা তীব্রতর হলো। কিন্তু এবার আবেগের কাছে মস্তিষ্ক পরাজিত হলো। মনস্থির করলাম, আমি বাস থেকে নেমে যাব। সিটবেল্ট খুলে ইলনাজের কাছে গিয়ে বললাম, আমি এই যাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি না। আমি বাস থেকে নেমে যেতে চাই। সে আমাকে আশাহত করে বলল, হাইওয়েতে বাস থেকে নামা যাবে না। আমি ভগ্নহৃদয়ে নিজের আসনে গিয়ে বসলাম।
ইলনাজকে কিছু সময় পর দেখলাম চালকের সঙ্গে কথা বলল। চালক কিছু দুর গিয়ে বাস থামাল। যেখানে মহাসড়কের সঙ্গে একটা সরু সার্ভিস রোড মিলিত হয়েছে। তখন ইলনাজ আমাকে নামার অনুমতি দিল। সবাইকে দ্রুত বিদায় বলে ব্যাকপ্যাক নিয়ে বাস থেকে নেমে পড়লাম। পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে নাভের অ্যাপে ঢুকলাম।
নাভের কোরিয়াভিত্তিক সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট। নাভেরের সঙ্গে কোরিয়ার সব ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম যুক্ত। যেকোনো গন্তব্যে পৌঁছার জন্য সম্ভাব্য সব বিকল্প রুটসহ নির্ভুলভাবে নির্দেশনা দিতে নাভের গুগলের চেয়েও অধিকতর সিদ্ধহস্ত—এ কথা আমার নয়। পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আগত স্বনামে ভুবনখ্যাত কাইস্টের সহপাঠীদের মুখে শোনা।
‘ইত্তেউন’ লিখে সার্চ দিতেই আমাকে ফাস্ট অ্যান্ড শর্টেস্ট রুটের ডিরেকশন দিল। নির্দেশনামাফিক প্রথমে হেঁটে নিকটস্থ স্থানীয় বাসস্টপেজে গেলাম।
সেখান থেকে সিটি বাসে চড়ে আন্তশহর বাসস্টেশনে পৌঁছে ‘সিউল এক্সপ্রেস’ বাসে উঠে বসলাম।
এবার ভিন্ন অনুভূতি মনে হচ্ছে। নীড়ে ফিরছি নাড়ির টানে; যদিও আমার নাড়িকে হাসপাতাল বর্জ্য হিসেবে বহু বছর আগে পৌনে চার হাজার কিলোমিটার দূরে ভূগর্ভস্থ করা হয়েছিল।
সপ্তাহান্তের দিন হওয়ায় মাত্র এক ঘণ্টায় সিউলে ফিরে এসেছি। বাসস্টপ থেকে নেমে সোজা ইত্তেউনের দিকে দ্রুতলয়ে পা চালাচ্ছি। মিনিট দশেকের মধ্যেই মসজিদে পৌঁছে গেলাম। দলে দলে নানা বর্ণের মানুষ ঈদগাহে যাচ্ছে। বাচ্চাদের চোখে–মুখে অকৃত্রিম খুশি প্রতিফলিত হচ্ছে। আমিও সেই স্রোতে মিশে গেলাম। মনে আনন্দ খেলে যাচ্ছে।
যথাসময়ে ঈদের নামাজ আদায় করলাম। এরপর বহুলকাঙ্ক্ষিত কোলাকুলি, প্রাণের সঙ্গে প্রাণ মেশানো।
পূর্বপরিচিত একজন বাংলাদেশি ছাত্রের সাক্ষাৎ পেলাম। তিনিও আমার মতো প্রেষণে উচ্চশিক্ষার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় এসেছেন। স্থানীয় দক্ষিণ এশীয়রা মসজিদের বাইরে সবাইকে সেমাই দিয়ে আপ্যায়ন করছেন। আমিও একটু সেমাই চেখে দেখেছি। কিছু সময় নানা জাতির মানুষের ঈদ উদ্যাপন উপভোগ করলাম। কেউ কেউ ছোট বাচ্চাদের ঈদ উপহার হিসেবে চকলেট বক্স বিতরণ করছেন। অবচেতন মনে ভাবলাম, ছোট হলে একটি বক্স আমিও পেতাম।
কিছু সময় পর সিউলে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের আমন্ত্রণে তাঁর বাসভবন ‘বাংলাদেশ হাউস’-এর উদ্দেশে রওনা করলাম। ঘণ্টাখানেক সাবওয়ে, বাসভ্রমণ এবং আরও কিছু সময় পাহাড়ে আরোহণ করে বাংলাদেশ হাউসে পৌঁছলাম।
রাষ্ট্রদূত মহোদয় আমাদের সাদরে গ্রহণ করলেন। বাংলাদেশ হাউস আমার কাছে সিউলের বুকে একটুকরা বাংলাদেশ মনে হলো। রাষ্ট্রদূত–পত্নী আমাদের মধ্যাহ্নভোজের পর্বে নিয়ে গেলেন। ভোজনে নানা পদের বাঙালি-শাহি খাবারের বুফে আয়োজন ছিল। আহার পর্ব শেষে যখন আমরা আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করছিলাম, তখন হঠাৎ বেজে উঠল সেই প্রাণের সুরের মূর্ছনা—
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে
শোন আসমানী তাগিদ।’
*লেখক: আবদুল্লাহ আল মামুন, সহকারী পরিচালক, বার্ড; বর্তমানে প্রেষণে দক্ষিণ কোরিয়ায় উচ্চশিক্ষারত
*** দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা [email protected]