মার্ক কার্নি ভিন্ন দেশের গভর্নর থেকে কানাডার সরকারপ্রধান

সমর্থকদের পাশে নিয়ে লিবারেল পার্টির জয় ঘোষণা করেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নিছবি: রয়টার্স

কানাডায় টানা চতুর্থবারের মতো লিবারেল পার্টি সরকার গঠন করতে যাচ্ছে, আর নেতৃত্বে এসেছেন একজন ব্যতিক্রমী নেতা মার্ক কার্নি। একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক ব্যাংকার হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত এই ব্যক্তি এখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। পাশের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কানাডাকে স্ট্রেট করে নেওয়ার হুমকি এবং শুল্ক আরোপের মধ্যে তাঁর নেতৃত্বে কানাডার ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও অর্থনীতিতে একটি নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।

শৈশব ও শিক্ষাজীবন

মার্ক কার্নি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৫ সালের ১৬ মার্চ, কানাডার ফোর্ট স্মিথ, নর্থওয়েস্ট টেরিটরিজে। বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক এবং মা ছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষক। ছোটবেলায় তাঁর পরিবার আলবার্টা প্রদেশে চলে আসে, যেখানে তিনি বেড়ে ওঠেন। তিনি ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট করেন। এ সময় থেকেই তাঁর ইউরোপের সঙ্গে একটি গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

ব্যাংক অব কানাডার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব

২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের সময়, তখনকার কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পারের নেতৃত্বাধীন সরকার মার্ক কার্নিকে ব্যাংক অব কানাডার গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করে।

ব্যাংকিং জগতের বাস্তব অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসে ১৩ বছরের অভিজ্ঞতা, তাঁকে একটি নিপুণ আর্থিক কৌশলবিদে পরিণত করেছিল। তাঁর নেতৃত্বে কানাডা ২০০৮-২০০৯ সালের মন্দা থেকে দ্রুত উঠে আসে এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ‘রোলমডেল’ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর

২০১৩ সালে মার্ক কার্নিকে নিযুক্ত করা হয় ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর হিসেবে। তিনিই প্রথম বিদেশি, যিনি এই পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ (ব্রেক্সিট)–সংক্রান্ত অর্থনৈতিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় অসাধারণ দক্ষতা দেখান। তাঁর নেতৃত্বে যুক্তরাজ্য মুদ্রাস্ফীতি, সুদের হার ও বিনিয়োগ বাজারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়।

লিবারেল পার্টির সদর দপ্তরে সমর্থকদের উল্লাস
ছবি: রয়টার্স
আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কসংকট মোকাবিলায় দক্ষতা

মার্ক কার্নি যখন ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন (২০১৩-২০২০), তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্বব্যাপী শুল্কনীতি কড়াকড়ি করে তোলে। ইউরোপ, চীন ও কানাডার বিরুদ্ধে ট্যারিফ আরোপ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কে অস্থিরতা তৈরি হয়। এ পরিস্থিতিতে মার্ক কার্নি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখেন। তিনি বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী মহলের আস্থা ধরে রাখেন ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সমন্বয় গড়ে তোলেন।

পারিবারিক জীবন ও ব্যক্তিত্ব

মার্ক কার্নির স্ত্রী ডায়ান ব্রোনউইন একজন পরিবেশবাদী ও সমাজকর্মী। দম্পতির চার কন্যাসন্তান রয়েছে। তাঁর পরিবার সামাজিক সচেতনতা ও পরিবেশবাদী উদ্যোগে সক্রিয়। ব্যক্তিজীবনে তিনি সাদামাটা, পরিবেশবান্ধব ও নীতিনিষ্ঠ একজন মানুষ হিসেবে পরিচিত।

রাজনীতিতে অভিষেক ও প্রধানমন্ত্রিত্ব

২০২৩ সালে মার্ক কার্নি লিবারেল পার্টিতে যোগ দেন। তিনি কাজ শুরু করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে। তাঁর দীর্ঘ আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, নেতৃত্বের গুণাবলি ও দেশপ্রেমের কারণে তিনি দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ২০২৫ সালের ফেডারেল নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে লিবারেল পার্টি জয়লাভ করে এবং তিনি কানাডার ২৪তম প্রধানমন্ত্রী হন।

মার্ক কার্নি একটি বিরল উদাহরণ—যিনি একই সঙ্গে একজন দক্ষ ব্যাংকার, বিশ্বমানের অর্থনীতিবিদ, আন্তর্জাতিক কূটনীতিক এবং এখন একজন রাজনৈতিক নেতা। কানাডা, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ ও বৈশ্বিক অঙ্গনে তাঁর অভিজ্ঞতা এখন দেশের ভবিষ্যৎ পথনির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

‘দূর পরবাস’এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]