বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার: জনগণের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা
‘যে যায় লঙ্কায়, সে–ই হয় রাবণ’—বাংলাদেশের ক্ষমতার আসনটিও লঙ্কা থেকে কম নয়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ায় দেশবাসীর মধ্যে বেশ আশার সঞ্চার হয়েছিল—বহুদিন পর ফ্যাসিবাদের পরাজয় হয়েছে, দেশে নতুন সুর্য উদিত হবে। এ ছাড়া দেশের প্রধান একজন উচ্চশিক্ষিত নোবেল বিজয়ীকে পেয়ে সাধারণ জনগণ ছিল উচ্ছ্বসিত। কিন্তু গত ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনায় সাধারণ জনগণের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন কি পূরণের পথে।
ফ্ল্যাশব্যাক ২৪-এর কোটা সংস্কার আন্দোলন
বাংলাদেশে সব ধরনের সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটাভিত্তিক নিয়োগব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে সংঘটিত হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। শুরুতে এ আন্দোলন সভা-সমাবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ১৪ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর এক বক্তব্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের কটাক্ষ করেন। পরদিন আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা ও মন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নষ্ট করার অভিযোগ আনেন এবং একই দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়ে হামলা করে; একই সঙ্গে পুলিশও লাঠি ও রাবার বুলেট দিয়ে হামলা করে। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু সাঈদ নিহত হলে আন্দোলন পুরো দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯ জুলাই পর্যন্ত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য সংগঠনসহ বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ দিয়ে দমন–পীড়ন চালিয়ে, এমনকি ইন্টারনেট বন্ধ করেও আন্দোলন থামাতে কার্যত ব্যর্থ হলে সরকার দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে এবং মাঠে সেনাবাহিনী নামায়। এসব ঘটনায় কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারী আহত হওয়ার পাশাপাশি হাজারের অধিক নিহত হন। ২১ জুলাই বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করা হয়। সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ প্রদান ও ২২ জুলাই এ বিষয়ে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতেও কাজ হয় না। এক দফা দাবির মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সামরিক হেলিকপ্টারে চড়ে ভারতে চলে যান।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট অস্থায়ী সরকার গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী সমন্বয়কদের প্রতিনিধিদল, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনে অতিষ্ঠ মানুষ বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল ও এর নেতৃবৃন্দকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। এই স্বৈরশাসককে উৎখাত করে ছাত্র–জনতা আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠন করায় জনমনে স্বস্তি ফিরে আসে। তা ছাড়া বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একজন নোবেল বিজয়ী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারপ্রধান হওয়ায় জনমনে আস্থা সৃষ্টি হয়, মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে, সাধারণ মানুষ নোবেলজয়ী ইউনূসকে নিয়ে দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। রাজনৈতিক হানাহানি, ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা, দলীয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ছাত্রলীগের তাণ্ডব, জবরদখল, ধর্ষণ, হত্যা, গুম, খুন, লুটতরাজের অবসান চায় মানুষ। স্বপ্ন দেখে সমৃদ্ধ–সুন্দর বাংলাদেশের।
জনগনের হতাশা
নতুন সরকার জাতিকে দুর্নীতিমুক্ত নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখানোর তিন মাস পরও সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের তেমন কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় জনগণের মনে হতাশা উঁকি দিচ্ছে। বর্তমান সরকারের কিছু কার্যকলাপ আগের সরকারের সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যাওয়ায় মনে হয়, ‘যে যায় লঙ্কায়, সে–ই হয় রাবণ।’
স্বৈরাচার সরকার বিরোধী দলের লোকজনকে শায়েস্তা করতে ‘রাজাকার’ ট্যাগ লাগিয়ে দিত। বর্তমানেও অনেকেই সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে ব্যক্তিগত দুশমনি মেটাতে আওয়ামী লীগের অথবা নিষিদ্ধ ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের ট্যাগ লাগিয়ে অত্যাচার করছেন। চাঁদাবাজি ও লুটতরাজ আগে এক দল করত, এখন অন্য দল করছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
শেখ হাসিনার সরকার বিরোধী মতের লোকজনকে শায়েস্তা করতে মিথ্যা–বানোয়াট মামলা দিত। এখন সরকার মিথ্যা মামলা না দিলেও সুবিধাভোগীরা মামলা দিয়ে মানুষকে হয়রানি করছে, সরকার তা বন্ধ করতে পারছে না।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুষ্ঠুভাবে না ফেরায় অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থক বিভিন্ন দলের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে অবলীলায় পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি নির্যাতন এখনো থেমে নেই।
আগে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছিল সরকার, এখনো কাটেনি শিক্ষাব্যবস্থার বিপর্যয়। ছাত্রছাত্রীদের বিপ্লবী মনোভাব পড়াশোনার পরিবেশ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের।
সুফল
আগের মতো সরকারি মদদে টেন্ডারবাজি হচ্ছে না, দেশের টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে না, ছাত্রলীগের অত্যাচার থেকে জাতি আজ মুক্ত, কণ্ঠরোধের কিছু কালো আইন বাতিল ইত্যাদি।
সাধারণ জনগনের কিছু মতামত
জরুরি ভিত্তিতে দেশের আইনশৃঙ্খখলা পরিস্থিতি উন্নয়নের ভূমিকা নিতে হবে। জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশ পরিচালনায় সবার আগে প্রয়োজন বিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের, তাই উপদেষ্টা নির্বাচনে আরও সচেতন হতে হবে। ছাত্রদের এ মুহূর্তে উপদেষ্টা নিয়োগ না দিয়ে পার্শ্ব–অবস্থানে রাখলে ভালো হতো, তাঁদের ভবিষ্যতের জন্য, দেশের জন্য, উপদেষ্টামণ্ডলীর জন্য। সুষ্টু পরিবেশ নিশ্চিত করে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাঙ্গনে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন খাতে ঘাপটি মেরে বসে থাকা স্বৈরাচারের দোসরদের চিহ্নিত করে ভালো ও যোগ্য লোকদের স্থলাভিষিক্ত করতে হবে।
দেশের সাধারণ জনগণই আপনাদের ক্ষমতায় বসিয়েছে। জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিন, রাষ্ট্রের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারাকারীদের ব্যাপারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বিনষ্টকারীদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। চাঁদাবাজ, খাদ্যদ্রব্যের সিন্ডিকেটকারীদের দলমত–নির্বিশেষে কঠোর হাতে দমণ করতে হবে। গণমাধ্যমে হস্তক্ষেপ বন্ধে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। সংখ্যালঘু নির্যাতন কঠোর হাতে দমণ করতে হবে।
প্রত্যাশা
এসব সমস্যা বাস্তবায়িত না হলে সাধারণ জনগণ হতাশ হবে। এতে আবার স্বৈরাচারের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাই বর্তমান সরকার সমস্যাগুলোর দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে জনগণের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে বলে আমরা আশাবাদী।