সেই সাইকেলটি
ক্লাসরুম ডেকোরেশন অথবা আর্ট-ক্র্যাফ্টের সামগ্রী কেনার জন্য ‘নাইনটিনাইন সেন্টস ওনলি স্টোরে’ একসময় শিক্ষকেরা কেনাকাটা করতেন। তখন অনলাইনের বাজার এতটা জেঁকে বসেনি। আমরা মাত্র দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করেছি। স্কুলে চাকরি হওয়ার পর, নানা রঙের কনস্ট্রাকশন পেপার, কাঁচি, আঠা ইত্যাদি কেনার জন্য শিক্ষকদের উপদেশমতো প্রথম ঢুঁ মারি ‘নাইনটিনাইন ওনলি স্টোরে।’ সস্তায় আর্ট এবং ক্র্যাফ্টের টুকটাক জিনিসের এমন বিপুল আয়োজন দেখে আমি অবাক হয়ে যেতাম।
বরাবরই হাতের কাজের জিনিসের প্রতি দুর্বলতা ছিল আমার। দেশে নিউমার্কেটের সুতো, লেইস-ফিতার দোকান, চাঁদনী চক এবং ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের ব্লক-বাটিক, ফেব্রিক-পেইন্টের দোকানগুলো ছিল আমার বড় প্রিয়। নিত্যই হানা দিতাম এদের নানা পসরার লোভে। দোকানিরাও ছিলেন অতিপরিচিত। তবে অবাঞ্ছিত ভিড়ভাট্টা ঠেলে এসব দোকান অবধি পৌঁছার অভিজ্ঞতা সুখকর হতো না তেমন একটা।
ফিরে আসি একই দামে বাঁধা, স্বল্পমূল্যের ‘99 Cents স্টোরে’। প্রতিটি জিনিসের মূল্য ‘৯৯ সেন্ট’ বেঁধে দেওয়া হলেও দাম মেটাতে গিয়ে প্রায়ই দেখতাম অনেক বেশিই খরচ করে ফেলেছি। ক্র্যাফটের জন্য সুতো, কাঠ, কাগজ, নানা রঙের পমপম, ঝিনুক, বোতাম, দড়ি...কত শত বিচিত্র উপাদান যে ছড়ানো ছিটানো থাকত দোকানের আইলগুলোতে!
প্রবাসে, সময়ের গতি যেন ক্ষানিকটা বেশিই দ্রুত। সেই সময়ের সিঁড়ি বেয়ে ক্রমে জানলাম ‘মাইকেলস’, ‘জো-এন’ এবং ‘হবি লবির’ মতো ক্র্যাফট শপের কথা। কিন্তু এরই মধ্যে ব্যস্ততাও বাড়ল কয়েক গুণ। তার সঙ্গে সঙ্গে মনও বোধ করি সূক্ষ্ম অনুভূতিকে চাপা দিয়ে, প্রয়োজনটাকেই প্রাধান্য দিতে শুরু করল। আর এখন তো সব রুটিনে বাঁধা। বেশির ভাগ টিচারই স্কুল সোর্স ছাড়া স্কুলের জন্য নিজের পছন্দমতো সামগ্রী কিনতে অনলাইনেই কেনাকাটা সারেন। বোধ করি আগের মতো ব্যাপক আঙ্গিকে প্রজেক্টটের কাজও তেমন করা হয় না।
শুরুতে ‘নাইনটিনাইন ওনলি’ শব্দগুলো ম্যাজিকের মতো কাজ করলেও, কোভিড-১৯–এর পরপর, বিশেষ করে ২০২৩–এর দিকে আর ব্যবসা সামাল দিতে না পেরে, একে একে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয় ‘নাইনটিনাইন’ স্টোরগুলো। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় আমাদের আশপাশের বেশির ভাগ স্টোর। আমার স্কুলে যেতে আসতে রাস্তার মোড়ের বিরাট স্টোরটিও একসময় বন্ধ হয়ে যায়। বেশ কিছুদিন থেকে দেখছি সেই স্টোরগুলোই আবার নতুনভাবে দুয়ার খুলেছে ‘ডলার স্টোর’ নামে।
গেল শুক্রবার স্কুলের পর ঢুঁ মারলাম এমনি একটি ডলার স্টোরে। এ স্টোর ব্যাপক জায়গা নিয়ে তৈরি। তবে এর অনেকটা অংশই এখনো ফাঁকা! কেনার মতো তেমন কিছুই চোখে পড়ল না। মজার দেখতে, প্যাকেটে মোড়া গুটিকয় ইরেজার নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ক্লাসরুম ‘treasure-box’–এ রাখা যাবে।
ঘরে বসে অনলাইনে বাজারের সুবিধা, আর ভোক্তার পরিবর্তনশীল চাহিদা মেটাতে গিয়ে এত বড় স্টোর কীভাবে টিকে থাকবে—এসব সাতপাঁচ ভেবে যখন গাড়ির দিকে হাঁটছি, চোখে পড়ল সাইকেলটি! ‘নাইনটিনাইন ওনলি স্টোরই’ বলুন বা ‘ডলার স্টোর’—এদের লক্ষ্যই হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য অসম্ভব স্বল্প মূল্যে ক্রেতার সামনে তুলে ধরা। এখানে সাধারণত তাঁরাই আসেন, যাঁদের বাজেট নিয়ে নিত্য টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যাঁদের আয়-উপার্জন ভালো, যাঁরা জিনিসের স্বল্প দামের চেয়ে গুণগত মানকে বা ব্র্যান্ড নামকেই বেশি প্রাধান্য দেন তারা তো আর নিত্যদিন এখানে সওদা করতে আসবেন না।
তাই অল্প বয়সের যে মানুষটি এ সাইকেলের মালিক, তার পরিবারে যে অর্থের বাহুল্য আছে তা বলা যায় না। তবে, সৃষ্টিশীল মন, আর সামান্য ব্যাপার থেকে মজা নেওয়ার চেষ্টার যে কমতি নেই এ সাজানো সাইকেল তারই প্রমাণ দেয়। সাইকেল থেকে মোটরসাইকেলের মতো শব্দ বের করার এই মজাটা ছোট বেলায় হয়তো অনেকেই উপভোগ করেছেন। তবে, তা এখন চোখের সামনে দেখে বড় কৌতূহল হলো। কার্ড বোর্ড, পানিশূন্য প্লাস্টিকের পানির বোতল, অথবা অ্যালুমিনিয়ামের খালি পানীয় ক্যান চ্যাপ্টা করে সাইকেলের স্পোকের মধ্যে দিয়ে আটকে দেওয়া হয়, সাইকেলের চাকা ঘোরার সময় তা টায়ারের সঙ্গে বারবার ঘষা লেগে যে ঘর্ঘর শব্দ তৈরি হয়, তাতে মনে হবে যেন মোটরসাইকেল ছুটে আসছে! যত দ্রুত যাওয়া যায়, শব্দ তত জোরে হয়। উঠতি বয়সের কোনো ছোকরার কল্পনায় এ শব্দ হয়তো হেলিকপ্টারের শব্দের মতোই বোধ হবে। মনে পড়ল দেশে মফস্সল শহরে ছেলেরাও এই কাজ করত। ইতিউতি তাকিয়েও ছোট আরোহীর দেখা মিলল না।
বাড়ি ফিরতে হবে। ডিনার রেডি করা, সামনের উইকএন্ডের পার্টির জন্য গিফট কেনা, ড্রেস নির্বাচন করা, পরের দিনের লেসন প্ল্যানের জোগাড়যন্ত, আরও কত কি...
হঠাৎ মনটা খুশি হয়ে উঠল, নিজেকে খুব হালকা মনে হলো। কোনো এক দুষ্ট বালকের এই সাইকেল মনে করিয়ে দিল খুশি বা সুখ, ছকবাঁধা পথে হেঁটে যেমন উপার্জন করা যায় না, তেমনি সুখ ক্ষয়ে বা শেষ হয়েও যায় না। জীবনের ছোটখাটো বিষয় থেকেই সুখের আস্বাদন করতে হঠাৎ মনটা খুশি হয়ে উঠল, নিজেকে খুব হালকা মনে হলো। ডলার স্টোরের সামনে পার্ক করা, কোনো এক দুষ্ট বালকের এই সাইকেল মনে করিয়ে দিল খুশি বা সুখ, ছকবাঁধা পথে হেঁটে যেমন উপার্জন করা যায় না, তেমনি সুখ ক্ষয়ে বা শেষ হয়েও যায় না। জীবনের ছোটখাটো বিষয় থেকেই সুখের আস্বাদন করতে হয়, আর আমার সে অনুভূতি বা ক্ষমতা এখনো চাপা পড়ে যায়নি!
লেখক: শবনম চৌধুরী, এলিমেন্টারি স্কুল টিচার, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র