একজন অন্য রকম মা

ফেসবুকে ‘ফিজিশিয়ান মাম গ্রুপ’ বলে একটা গ্রুপ আছে। পৃথিবীর অনেক দেশের চিকিৎসক ওই গ্রুপে আছেন, তবে আমেরিকা আর কানাডার মেয়ে চিকিৎসকেরাই বেশি। অনেক ধরনের পোস্ট দেখি এ গ্রুপে। কেউ হয়তো কাজে স্ট্রেসট আউট, অনেক রকম ভরসার কথা বলে সবাই। একটা মূল্যবান মতামত দেন বিভিন্ন রোগবিশেষজ্ঞ তাঁদের নিজেদের সাবস্পেশালিটি নিয়ে। ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়েও অনেক চিকিৎসক মা মতামত চান। ১০০টি মতামতের ৯০টিই খুব কাজের।

ছবি : লেখক

মেহেলি নামের একটি মেয়ের পোস্ট দেখলাম এক মেঘমেদুর সকালে। সূর্য উঠি উঠি করেও উঠছে না। মন উদাস করা একটা দিন। এমন সময় ফেসবুকে চোখ রেখে দেখলাম সে লিখেছে, শিকাগোতে থাকে। আজকে সন্তানের টিফিন গুছিয়ে দিতে গিয়ে সময়ের অভাবে নিজের কফি আর সে সঙ্গে নিতে পারেনি। হাবি রাতে অনকলে ছিল। তাকে আর সে ঘুম থেকে তোলেনি। ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে হয়েছে, স্টপ সাইনে দাঁড়িয়ে রিয়ার ভিউ মিররে চোখ পড়ল মেহেলির, সে তাকিয়ে দেখে একটা লোক খালি পায়ে একটা মগ হাতে দৌড়ে আসছে। একটু ভালো করে তাকাতেই দেখল লোকটা ওর নিজের হাবি। জানালা খুলতেই ওর হাতে কফির মগটা ধরিয়ে দিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলল, ভুলে গেছিলে বউ।

অনেক গাড়ির বিরক্ত হয়ে হর্ন বাজানোর শব্দে মেহেলি গাড়ি চালানো শুরু করল। কাজের ফাঁকে ওই কফি আর মগটার সঙ্গে হাবির ভালোবাসা মোড়ানো কিছু কথাও শেয়ার করল আমাদের সঙ্গে। আমার মন খুব ভালো হয়ে গেল। হাবিরা এ রকম একটু কেয়ারিং হলে কি হয়?

এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। ব্যস্ত জীবনে মেহেলির বা তার হাবির কথা খুব যে মনে পড়েছে, তা নয়। ইসরায়েল গাজা আক্রমণ করেছে তত দিনে। একদিন গ্রুপে দেখলাম, মেহেলি খুব করুণ করে লিখেছে, তার কার্ডিওলজিস্ট হাবি গাজায় ত্রাণসহ মেডিকেল গ্রুপের সঙ্গে গেছে। হাসপাতালে বোমা হামলার পর তার সঙ্গে ওরা কেউ যোগাযোগ করতে পারছে না। গাজায় কেউ যদি থাকেন, ওর হাবির খোঁজ দিতে পারেন। মেহেলির সন্তানেরা বাবা বাবা করে খুব কাঁদছে। এরপরের কয়েকটা সপ্তাহ ভীষণ কষ্ট আর উৎকণ্ঠায় কাটল। যদি কোনো আপডেট মেহেলি ( নামটার অর্থ দেখেছি মেঘের বন্ধু, জানি না মেহেলি যে দেশের সে দেশেও এই নামের অর্থ একই কি না) দেয়। কিছু পেলাম না। যখন মনকে বুঝিয়ে নিয়েছি প্রচণ্ড কেয়ারিং একজন হাবি বা বাবা আর কখনো ফিরবে না, তখন মেহেলি আপডেট দিল একটা ট্যুরিস্ট গ্রুপের সঙ্গে ওর হাবি ফিরেছে, ভীষণ অসুস্থ। মেহেলির আশপাশের চিকিৎসক মায়েরা পালা করে খাবার দিয়েছে ওকে এরপর। মনে হলো, যাক সুস্থ হয়ে আবার ওরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে। কষ্টের পাথর সরে গেল মন থেকে।

কয়েকটা মাস কেটে গেল ঝড়ের গতিতে এরপর। কাজ, সন্তানদের স্কুল, রান্না—সবকিছু নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত আমি। মা দিবস চলে আসছে প্রায়। খেয়াল করলাম, ছেলের নামে দুটো পার্সেল এসেছে। সে দেখলাম চুপিসারে রুমে নিয়ে গেল। এমন কী জিনিস! ভাবতে ভাবতে তার রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, শুনলাম মেয়ে আমার কী কী যেন বলে দিচ্ছে ভাইকে। মা দিবসে বাসায় ফিরেছি সূর্যাস্তের আগে আগে।

ছেলে আমাকে দেখে বলল, ‘মা, তোমার রুমের ব্যালকনিতে যাও তো।’ বললাম, ‘বাবা একটু হাত-মুখ ধুই, ভাত খাব।’ ছেলের একই কথা, ‘না, যাও মা।’ গেলাম। দেখি কাচের টেবিলে স্বচ্ছ দুটি কাপে নীল আর বেগুনি চা সাজানো। সঙ্গে লেখা ‘তোমাকে ভালোবাসি মা।’ মেয়ে কলেজ থেকে পাঠিয়েছে, ভাইয়ের দায়িত্ব ছিল তা বানিয়ে আমাকে দেওয়া। আইফোন নিয়ে এসে ছবি তুলে মুহূর্তটাকে ধরে রাখলাম। ফেসবুকের প্রোফাইল ছবি বদলে দিলাম এই ছবি দিয়ে।

‘সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক বেশ তো
গোধূলির রঙে হবে এ ধরণি স্বপ্নের দেশ তো...’

তারপর চোখে পড়ল মেহেলির ফিজিশিয়ান মাম গ্রুপের পোস্ট। ওর হাবি আবার মেডিকেল টিমের সঙ্গে গাজায় যাবে। কী কী সাপ্লাই নিতে পারবে, তার একটা তালিকা। তার সঙ্গে ওর হাবির লেখা একটা টেক্সটের স্ক্রিনশট, যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় অনেকটা এ রকম:

‘বউ, কয়েক দিন ধরে গাজায় যাব বলে তুমি খুব মন খারাপ করে কথা বলছ না। খাচ্ছও না ঠিক করে। আমি যত দিন থাকব না, তত দিন আমাদের বাবুদের কে দেখে রাখবে? নিজে বাজার বা রান্না একা একা কোরো না, কেমন? ব্লু অ্যাপ্রোনে অর্ডার কোরো (ওর প্রিকুকড খাবার ডেলিভারি দেয়)। আমি জানি, তুমি খুব শক্ত মনের মানুষ। অন্য মানুষদের সাহায্য করার মিশনে যেতে চাই, মা হিসেবে আমার সন্তানদের তুমি দেখে রাখবে না?’

ঝাপসা চোখে তালিকায় চোখ বোলাচ্ছি, কত তাড়াতাড়ি শিকাগোতে কিছু জিনিস পাঠানো যায়? মাত্র দুই দিন সময় আছে। অ্যামাজন ডেলিভারি দিতে পারবে তো? একজন অন্য রকম মা পোস্ট দিয়েছেন। সামান্য কিছু নিয়ে যদি আমরা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে সাহায্য করতে পারি।

*(সত্য ঘটনার সঙ্গে এ গল্পের আংশিক মিল আছে)

*দূর পরবাসে পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]