টিরিং টিরিং সাইকেলের কথা
বুকপকেটে ঘুষের টাকা রেখে মুঠোফোনটা বের করলেন হাসেম সাহেব। হেসে বললেন, আপনার কাজ হয়ে যাবে, বাসায় গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমান! আমি উঠতে যাব, এমন সময় অট্টহাসি মুখে নিয়ে বললেন, একটা ভিডিও দেখে যান। আমি খানিকটা মাথা এগিয়ে নিলাম, আর উনি উনার মুঠোফোনটা। ভিডিও চালু করতেই শুরু হলো টিরিং টিরিং সাইকেল চালায় ফেরিওয়ালা যায়! হাসেম সাহেব হেসেই চলেছেন, আমি হাসি কী করে, ফাইলটা পাস করাতে হাসেম সাহেবকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে, হাসি আমার আসে কী করে!
হাসেম সাহেব বলেছেন, নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে! মুদি দোকানের সামনে দিয়ে যেতে মনে পড়ল, বাসায় তেল নিয়ে যেতে হবে, নাকে দিয়ে ঘুমানোর জন্য না, আলু ভর্তার জন্য। আধা লিটারেরর শর্ষের তেলের দাম দিতে গিয়ে দেখি, গায়ের দামের চেয়ে ১৫ টাকা বেশি নিচ্ছে হাতেম সওদাগর। তার নাকি বেশি দামে কেনা! তেল নিয়ে বের হব এমন সময় হাতেম সওদাগর মোবাইল বের করে বললেন, আপনার হোয়াটস অ্যাপে একটা ভিডিও দিয়েছি, দেইখেন টিরিং টিরিং সাইকেল চালায়!
বাসায় ফিরব এমন সময় মনে পড়ল জরুরি একটা কাগজ ফেলে এসেছি হাসেম সাহেবের অফিসের নিচের ফটোকপির দোকানে! অন্য সময়ে হলে বাসে ঝুলতে ঝুলতে যেতাম টাকা বাঁচাতে, এখন সময় নেই, তাই সিএনজি স্ট্যান্ড গেলাম, ড্রাইভার বসে বসে সেই ভিডিও দেখছে টিরিং টিরিং সাইকেল চালায় ফেরিওয়ালা যায়! যাবে কি না জানতে চাইলাম, বলল মিটারে যাবে না, ভাড়া যা চাইছে মিটারের চেয়ে ৫০ টাকা বেশি! উপায় না দেখে রাজি হলাম। সিএনজি টান দিতেই ড্রাইভার বলে উঠল, স্যার ভাবতেছি পোলারে আর স্কুলে পাঠামু না!
জানতে চাইলাম, কেন?
স্কুলে তো এখন টিরিং টিরিং সাইকেল চালানো শেখায়, তার চেয়ে আমার লগে থাকি সিএনজি চালানো শিখুক! আমি চুপ করে রইলাম। ড্রাইভার এবার একটা অনুরোধ করে বসল, স্যার সামনে সার্জেন্ট আছে, আপনি বলবেন মিটারে যাইতেছেন। আমি সোজা বলে দিলাম, পারব না মিথ্যা বলতে।
সার্জেন্ট থামাতেই ড্রাইভার, হাতের মুঠোয় কিছু টাকা দিয়ে বললো স্যার মিটারটা খারাপ হয়ে গেছে! সার্জেন্ট মুঠো খুলে বললেন, কী দেস এগুলা! বাড়াইয়া দে আর না হয় সিএনজি থুইয়া টিরিং টিরিং সাইকেল চালা!
ড্রাইভার এক গাল হেসে আরেকটা নোট গুঁজে দেয় সার্জেন্টের হাতে, আর বলে ওঠে, স্যার ভিডিওটা আপনেও দ্যাখছেন! জোস ভিডিও স্যার।
ফটোকপির দোকান থেকে কাগজের খামটা নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
বাসায় এসে ভাবতে লাগলাম শিক্ষা ব্যবস্থা একদম দারুণ থাকা অবস্থায় শিক্ষাজীবন শেষ করা হাসেম সাহেব, হাতেম সওদাগর কিংবা মোড়ের পুলিশ সার্জেন্টটা আজ চিন্তিত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে! এমনকি পড়াশোনার মাঝপথে ঝরে পড়া সিএনজিঅটোরিকশা চালকটা, যে কিনা সুযোগ বুঝে গলাকাটা ভাড়া নিয়ে ছাড়ে, সেও চিন্তিত ভীষণ!
সুশিক্ষার সময়ে শিক্ষিত হাসেম সাহেব, হাতেম সওদাগর কিংবা মোড়ের পুলিশ সার্জেন্টটা তাঁদের সময়ে পাওয়া শিক্ষাব্যবস্থার শিক্ষা থেকে কী শিখেছেন, আর দেশকে কী দিচ্ছেন, কিছু ভিডিও বিতরণ আর ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া!
*লেখক: জাহেদুল আলম জাহেদ, সৌদি জার্মান হসপিটাল, শারজাহ, সংযুক্ত আরব আমিরাত।