কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও কিছু পর্যবেক্ষণ
দুর্নীতি হলো একটি সামাজিক ব্যাধি। দুর্নীতি একটা দেশকে অনুন্নয়নের দিকে ধাবিত করে। দুর্নীতির নেতিবাচক ফলাফলের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, সম্পদ গুটিকয়েক দুর্নীতিবাজ মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া, ভোক্তার ভোগব্যয়ে অর্থ খরচের গতিহীনতা, সরকারের কর আহরণে নিম্নগতি, অর্থ পাচার, দারিদ্র্র্যের হার বৃদ্ধি এবং জনগণের ওপর মানসিক চাপ। মোদ্দাকথা, দুর্নীতি উন্নয়নকে বেঁধে ফেলে চারদিক থেকে।
বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় যে শব্দগুলো দৈনন্দিন জীবনে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়, তার মধ্যে দুর্নীতি অন্যতম। দুর্নীতি শব্দটির ব্যাপক অর্থ নীতিবহির্ভূতভাবে কোনো কাজ করা, অর্থাৎ টাকার বা অন্য কোনো সুবিধার বিনিময়ে কাজ করা, যাকে সাধারণত ঘুষ বা উৎকোচ বলা হয়ে থাকে। আবার কোনো ঠিকাদার যখন নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে স্বল্প পরিমাণ সিমেন্ট দিয়ে একটা স্থাপনা তৈরি করেন, তাকেও দুর্নীতি বলে।
একজন পাবলিক প্রসিকিউটর একটা সরকারি কেস পরিচালনার সময় যখন সরকার ও তাঁর মক্কেল—উভয়ের কাছ থেকে পারিশ্রমিক বা লিগ্যাল ফি গ্রহণ করেন, তখন তাকেও দুর্নীতি বলে। যখন একজন সরকারি নিরীক্ষক সরকারি কোনো অফিস নিরীক্ষা করতে এসে পারিতোষিক গ্রহণ করেন, তাকেও দুর্নীতি বলে। সরকারি কেনাকাটায় আসল মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্য দেখানোকেও দুর্নীতি বলে। যেকোনো পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করাকেও দুর্নীতি বলে। এ তো গেল দুর্নীতির কয়েকটা অতি সাধারণ উদাহরণ, দুর্নীতির আসল চিত্র কিন্তু আরও ভয়াবহ, যা দেশবাসী অবলোকন করছে গত কয়েক মাস ধরে। এর শুরু সাবেক পুলিশপ্রধানের দুর্নীতির চিত্র প্রকাশের মাধ্যমে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ, কর বিভাগের মতিউর রহমান, কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল, পিএসসির গাড়িচালক আবেদ আলী, চট্টগ্রাম পুলিশের এডিসি কামরুল এবং আরও অনেকের দুর্নীতির খবর এতটাই ব্যাপক যে এগুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা হতে পারে।
বাংলাদেশের দুর্নীতির প্রকৃতি অনেকটা পারিবারিক অংশীদারত্বমূলক কর্মকাণ্ডের মতো। এতে এক সদস্যের দুর্নীতিতে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। যেমন স্বামীর দুর্নীতিতে স্ত্রীর অংশগ্রহণ এবং স্ত্রীর দুর্নীতিতে স্বামীর অংশগ্রহণ। আবার পিতা বা মাতার দুর্নীতিতে সন্তানদের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মতো। পরিবারের বাইরে নিকট আত্মীয়দেরও দুর্নীতিতে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজদের শ্বশুর, শাশুড়ি, শ্যালক, শ্যালিকা অন্যতম। দুর্নীতিবাজের পরিবারের সদস্য এবং নিকট আত্মীয়রা সাধারণত দুর্নীতিবাজের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ–সম্পদ রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মানুষ দুর্নীতি করে কেন? দুর্নীতির পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে।
বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী আব্রাহাম মাসলো তাঁর ‘প্রয়োজনের শ্রেণিবিন্যাস তত্ত্বে’ বলেছেন, মানুষ সাধারণত কোনো কিছু করার জন্য প্রণোদিত হয় পাঁচ ধরনের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে। আর এ চাহিদাগুলো পূরণ হওয়া শুরু হয় মৌলিক প্রয়োজন থেকে। মৌলিক প্রয়োজনগুলো হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিনোদন। এসব মৌলিক চাহিদা সরাসরি অর্থের সঙ্গে জড়িত। সুতরাং এ চাহিদাগুলো পূরণে নিয়োগকর্তা যখন যথেষ্ট বেতন দিতে না পারবেন, তখন কর্মচারী বা কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে পারেন। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশে যেসব উচ্চপদস্থ সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির চিত্র প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, আব্রাহাম মাসলোর মৌলিক চাহিদার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। সমস্যা সমাজের অন্য কোথাও, যা বের করা ও তা বন্ধ করা অতি জরুরি। দুর্নীতি ও ক্ষমতার মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক আছে। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা অনেক সময় মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলে। এটাও অনেক সময় বলতে শোনা যায়, অধিক ক্ষমতা মানুষকে অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলে। আবার আইন প্রয়োগের অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, দুর্বল শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বজনপ্রীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ও দুর্নীতির অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশের দিকে তাকালেও দেখা যায়, ক্ষমতার সঙ্গে দুর্নীতির একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা অনেকটাই ক্ষমতানির্ভর। এখানে ক্ষমতা আছে তো সব আছে, আর ক্ষমতা নেই তো কিছুই নেই। যেমন সাবেক পুলিশপ্রধান ক্ষমতায় থাকার সময় তাঁর একটা দুর্নীতির খবরও কোথাও প্রকাশিত হয়নি, হয়েছে ক্ষমতা থেকে অবসর নেওয়ার পর। ক্ষমতা আর দুর্নীতির মধ্যে নিবিড় সম্পর্কের ফলে বাংলাদেশে ক্ষমতা পাওয়ার জন্য অনেক সময় অনেকে মরিয়া হয়ে ওঠেন। ক্ষমতা পাওয়ার অনেক উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম একটা উদ্দেশ্য বলা যায় দুর্নীতি। ক্ষমতা আর দুর্নীতির মধ্যে এ নিবিড় সম্পর্কের জন্য দুর্নীতি চলার পথের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে যখন কোনো কিছু হরহামেশাই মানুষ করে থাকে, তখন তাকে সংস্কৃতি বা ইংরেজিতে কালচার বলে। সংস্কৃতি হচ্ছে একটা জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনে চলার পথের মূল্যবোধ, নিয়ম, নৈতিকতা, বিশ্বাস এবং ভালো ও মন্দের পৃথক্করণের সামষ্টিক রূপ। দুর্নীতি যখন একটা জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে পরিণত হয়, তখন তাকে ত্বরিতগতিতে সমাজ থেকে দূর করা কষ্টকর ও অসম্ভব। বাংলাদেশের দুর্নীতির চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, এর ব্যাপকতা অনেক বেশি এবং অনেক গভীরে। বাংলাদেশের সব মানুষ যে দুর্নীতিগ্রস্ত, তা সত্য নয়; তবে সৎ মানুষের বড়ই ‘আকাল’ বাংলাদেশে।
বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করতে চাইলে, দুর্নীতিকে দমন করতে চাইলে সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করার সংক্ষিপ্ত কোনো পথ নেই। এর জন্য গ্রহণ করতে হবে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ। আগেই বলেছি, ক্ষমতা ও দুর্নীতির মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে বা সাধারণ কৃষক কিন্তু কোনো দুর্নীতি করেন না। সুতরাং যদি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্য থেকে দুর্নীতি দূর করা যায়, তাহলে বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে, অন্যথায় বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে না। প্রথমেই যা দরকার, তা হলো দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার। রাজনৈতিক অভিভাবকদের অঙ্গীকারের মাধ্যমে স্বল্প মেয়াদে সরকার বড় বড় দুর্নীতির খাতগুলো চিহ্নিতকরণ ও দুর্নীতিবাজদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করতে পারে। যেটি সরকার ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও ইতিমধ্যে শুরু করেছে। আশা করি, দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিতকরণ, গ্রেপ্তার ও তাঁদের আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
গ্রামবাংলায় একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে, ঝি কে মেরে বউকে শেখানো! দুর্নীতিবিরোধী কঠোর আইন প্রণয়ন করে কিছু দুর্নীতিবাজকে এমন শাস্তি দিতে হবে, যেন তা দেখে অন্যরা দুর্নীতি করতে আর সাহস না পান। মনে রাখতে হবে, মাছের কিন্তু পচন ধরে মাথা থেকে! তেমনি একটা অফিসের প্রধান যদি দুর্নীতি না করেন, তাহলে তাঁর অধীন কেউ দুর্নীতি করতে সাহস পাবেন না। তাই কোনো অফিসের দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে আগে অফিসপ্রধানের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। একইভাবে একজন সংসদ সদস্য তাঁর এলাকায় দুর্নীতি না করলে অন্য কেউ কিন্তু দুর্নীতি করার তেমন সাহস পাবেন না। এভাবে নির্বাচনী এলাকার দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে সৎ ও কর্মঠ জনপ্রতিনিধিকে মনোনয়ন দিতে হবে এবং নির্বাচিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি ভোটারদেরও দায়িত্ব আছে।
মধ্যম মেয়াদে সরকার দুর্নীতি দমনে গঠিত প্রতিষ্ঠান দুদককে দুর্নীতি দমনে আরও শক্তিশালী, সক্রিয় ও কার্যকর করতে পারে। দুদক চালাতে সরকারের বছরে কত ব্যয় হয়, কয়জন দুর্নীতিবাজকে দুদক ধরতে পারল, কয়জন দুর্নীতিবাজের সম্পদ দুদক চিহ্নিত করতে পারল, কয়জন দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করতে পারল, কয়জন দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে দুদক আদালতে সঠিক অভিযোগপত্র দিতে পারল, কয়টা মামলায় দুদক জিতল, পরিশেষে দুদক দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কতটা অর্থ-সম্পদ উদ্ধার করে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে পারল—এ প্রশ্নগুলো আমলে নিতে হবে। দুদকের কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন করতে হবে। বাংলাদেশে দুর্নীতির সংঘটন এতটাই ব্যাপক যে এটি দেখে মনে হয়, সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা। তাই দুদকের পাশাপাশি প্রতিটি সরকারি অফিস ও মন্ত্রণালয় তাদের নিজ নিজ দুর্নীতিবিরোধী মনিটরিং সেল গঠন করতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে সরকার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণসচেতনতামূলক প্রচার চালাতে পারে। মানুষকে জানাতে হবে, দুর্নীতির কুফল ব্যক্তি, দেশ ও জাতির জন্য কতটা ভয়াবহ। আরও শেখাতে হবে, প্রতিটি মানুষ তাঁদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে কীভাবে দুর্নীতিকে ‘না’ বলতে পারেন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন। সরকারকে হস্তক্ষেপবাদী (দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত, গ্রেপ্তার ও আইনের আওতায় আনয়ন) ও শিক্ষামূলক (দুর্নীতির কুফল প্রচারণা এবং নিজ অবস্থান থেকে এর প্রতিরোধের উপায় জনগণকে শেখানো)—উভয় পদ্ধতিতে দুর্নীতি দমনে নিরলসভাবে কাজ করে যেতে হবে। উন্নয়নখাদক দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা গেলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, আমরা এগিয়ে যাব।
*লেখক: কাজী ছাইদুল হালিম, শিক্ষক, ফিনল্যান্ড