সুইডিশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের দায়িত্ব ও কর্তব্য

সুইডিশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর একটি জরুরি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। প্রথম সাড়া প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে এ বিভাগের কর্মীরা অগ্নি নির্বাপণ, অগ্নি প্রতিরোধ, উদ্ধার, আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান, মুমূর্ষু রোগীদের হাসপাতালে প্রেরণ ও নিরাপত্তা প্রদান করে থাকে। উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনাকারী সংস্থা হিসেবে সব ধরনের প্রাকৃতিক ও মানবিক দুর্ঘটনার উদ্ধারের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। মূলত প্রতিষ্ঠানটি জনগণের সেবায় শতভাগ দিবেদিত। তবে প্রশাসন, সিস্টেম বা পরিকাঠামোতে যে একেবারে ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই, এটা বিশ্বের কোথাও আমি দেখিনি। সুইডেন বেশ হাবুডুবুর মধ্য দিয়ে চলছে বর্তমান ক্রাইম নিয়ন্ত্রণে। কারণ, নানা দেশের মানুষের বসত এখানে। এখানকার নিয়মকানুনগুলো ততটা কঠিন না পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায়, যার ফলে এ সুযোগগুলো অনেকে ব্যবহার করে দেশের শান্তিকে অশান্তিতে পরিণত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এমতাবস্থায় রাষ্ট্র নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ধীরগতিতে সমস্যার সমাধান করতে।

কোনো রাজনৈতিক দল বা সরকারের চাপে না বরং আইনের শাসনে সুইডেন গুরুত্ব দেয়। যার ফলে এখানকার প্রশাসনগুলো সঠিক তদন্ত না করা পর্যন্ত কখনো–বা শতভাগ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত হুট করে কোনো মন্তব্য করে না। যেমন এখানকার পুলিশ প্রশাসন যত বড় দুর্ঘটনাই ঘটুক না কেন, শতভাগ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কিছুই গণমাধ্যমে বলবে না, জিজ্ঞেস করলে উত্তর একটাই—তদন্ত চলাকালীন শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলা যাবে না, কারণ, এতে তদন্তের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। বাংলাদেশে বিষয়টি কিছুটা ভিন্ন। যেমন প্রায়ই লক্ষণীয় ঘটনা ঘটার আগেই গণমাধ্যমসহ প্রশাসন সব বিষয় শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে খবর প্রকাশে তৎপর হয়ে যায়, ফলে সঠিক এবং নিরপক্ষ তদন্তের অভাবে অনেক সময় নিরীহ জনগণ দোষী হয়ে কারাগার বন্দি হয়, এমনটিও মাঝেমধ্যে নজরে পড়ে। জনগণ, প্রশাসন যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব এবং কর্তব্যের সঙ্গে কাজ করতে না পারে বা যদি সেই ধরনের সুব্যবস্থা একটি দেশে না থাকে তখন দায়িত্ব পালন করা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে।

আমি বহু বছর ধরে সুইডেনে বসবাস করছি। এখানকার ভালোমন্দের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, অন্যদিকে বাংলাদেশের সঙ্গেও একটি ভালোবাসার সেতু তৈরি হয়ে রয়েছে নাড়ির টানে, সে ক্ষেত্রে ভালোমন্দের দিকনির্দেশনার আলোকপাত করি মূলত আমার ‘শেয়ার ভ্যালু’ কনসেপ্ট থেকে। আজ শেয়ার করব সুইডিশ ফায়ারম্যানের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে।

হাঁটতে বেরিয়েছি বন্ধু টোমি লিন্ডকিভিস্তের সঙ্গে। তার সঙ্গে সম্পর্ক শুধু প্রতিবেশী হিসেবেই নয়; তার ছেলে এবং আমার মেয়ে সমবয়সী। তারা নার্সারি থেকে শুরু করে নবম শ্রেণি পর্যন্ত একই সঙ্গে লেখাপড়া করেছে। টোমি স্টকহোম ফায়ার ব্রিগেডে একটি ইউনিটের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে নিয়োজিত। সময় এবং সুযোগ হলে মাঝেমধ্যে হাঁটতে পথে নানা বিষয়ের ওপর তার সঙ্গে আলোচনা করি।

আজ তার ইউনিটের কাজ কী জিজ্ঞেস করলাম। যেমন রাতের ডিউটিতে তারা কী করে ইত্যাদি। উত্তরে বলল, নিরিবিলি সময়ে নানা বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ চলে নতুন চিন্তাচেতনা নিয়ে। যেমন দুই দিন আগে ড্রাইভিংয়ের যন্ত্রপাতি সব ঠিক আছে কিনা, তা চেক করার জন্য রাত আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত তারা স্টকহোম সিটি হলের সামনে (সিটি হলে বার্ষিক নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠান এবং নৈশ ভোজশালা আয়োজন করা হয়) ড্রাইভিং করেছে। এরপরে রাতের খাওয়া সেরে টিম বিল্ডিংয়ের ওপর কাজ করেছে।

আমি বললাম, সে আবার কী? উত্তরে টোমি বলল, যখন অন্যের বিপদে নিজেদের জীবন বাজি রেখে কাজ করতে হয় তখন পরস্পর পরস্পরের ওপর যাতে বিশ্বাস না হারায়, তার জন্যই এই টিম বিল্ডিং। তাছাড়া এক স্টেশনে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাদের থেকে সে বিষয়ের ওপর জানা এবং শেখা বা যদি কিছু জানানোর থাকে তাও জানানো হয়। আবার প্রতিদিনই রাস্তার দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে নানা ধরনের বিপদে তার টিম কাজ করে। শরীর ঠিক রাখার জন্য সব সময় শরীরচর্চা ইত্যাদি করে।

টোমিকে জিজ্ঞেস করলাম, অ্যালার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গে রেডি হয়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে কত সময় লাগে? সে বলল, নির্ভর করে দূরত্বের ওপর। তবে সব মিলে সর্বোপরি সাত মিনিট, এর মধ্যেই আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে থাকি। নানা কথা বলতে বলতে গতকাল সন্ধ্যার একটি ঘটনার কথা তুলে ধরল।

শীতের সময় প্রায়ই শোনা যায় অনেকে লেকের মাঝে হাঁটতে গিয়ে পানিতে ডুবে যায়। বেশ কয়েকদিন ধরে তুষারপাত হচ্ছে সুইডেনে। বাংলাদেশের সেই আষাঢ়–শ্রাবণ মাসের মতো ঝরছে, তবে বৃষ্টি না; তুষার।

তুষার যখন পড়ে, তখন তাপমাত্রা জিরো ডিগ্রির মতো থাকে, তুষার পড়া বন্ধ হলে সাধারণত তাপমাত্রা উঠানামা করে। বর্তমানে সুইডেনের নর্থে তাপমাত্রা মাইনাসে থাকায় পুরো এলাকা বরফে ঢাকা পড়েছে। গাছে কোনো পাতা নেই তবে তুষারে ঢেকেছে পুরো পরিবেশকে। যার ফলে অন্ধকারের চেয়ে কিছুটা আলোময় পরিবেশ বাইরে।

এমন সুন্দর পরিবেশে টিনএজের কিছু ছেলেমেয়ে সন্ধ্যায় বাইরে তুষারে খেলাধুলা করতে করতে হঠাৎ বাল্টিক সাগরের উপশাখার পাশ দিয়ে হাঁটতে পথে সাগরে পা দেয়। তারা মনে করেছে সাগরের পানি জমে গেছে। জমেছে ঠিকই তবে পুরোপুরি শক্ত হয়নি। তারপর তুষারে ঢাকা পড়ার কারণে বোঝার উপায় নেই পানির ওপরের বরফ কতটা শক্ত। এদের মধ্যে একটি ছেলে সাগরের পানিতে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ১১২ ইমারজেন্সিতে ছেলেটির খেলার সাথীরা ফোন করে। ঘটনাটি ঘটেছে টোমির রেঞ্জের। সে তখন তার টিম নিয়ে এসে ছেলেটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে দিয়ে যায়। যা–ই হোক, আজকে টোমি একটি নোটিস দিয়েছে যেন কেউ হাঁটতে পথে বাল্টিক সাগরে না নামে। কারণ, কমপক্ষে চার সেন্টিমিটার বরফ পানির ওপর জমা হতে হবে। তাপমাত্রা কয়েক দিন যাবৎ মাইনাসে থাকার পর বরফের ওপর দিয়ে হাঁটাহাঁটি থেকে শুরু করে স্কি করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের ফায়ার ব্রিগেডের দৈনন্দিন কাজের ওপর কিছুদিন আগে একটি রিপোর্ট নজরে পড়েছিল। যেমন তারা খবর দেওয়ার আধা ঘণ্টা-এক ঘণ্টা পরে আসে। এসে ছাইভস্মের মধ্যে পানি ঢালে। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও আজ অবধি প্রতিটি উপজেলায় ফায়ার স্টেশন স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। যেসব উপজেলায় ফায়ার স্টেশন নেই সেখানে আগুন লাগলে পার্শ্ববর্তী উপজেলার ফায়ার স্টেশনে খবর দিয়ে দমকল বাহিনী আনতে হয়।

তবে অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মোতাবেক প্রতিটি উপজেলায় একটি করে ফায়ার স্টেশন নির্মাণ করে প্রতিটি বিভাগকে আধুনিক ও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে জেনেছি। দেশ এবং দেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে ফায়ার সার্ভিসকে দ্রুত আরও আধুনিকায়ন করা দরকার। বহুতল ভবনের অগ্নিনির্বাপণের জন্য মই থেকে শুরু করে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি থাকা দরকার। শুধু আশ্বাস থাকলে হবে না, বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস সূত্রে যতটুকু জেনেছি, অগ্নিকাণ্ডের সময় সব জায়গায় পানি সহজে পাওয়া যায় না। তাই তারা ওয়াসাকে বিশেষ কিছু স্থানে হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপনের তাগিদ দিয়েছে; কিন্তু আজ পর্যন্ত হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপিত হয়নি।

উন্নত বিশ্ব যেমন সুইডেনে অগ্নিনির্বাপণে ফায়ার মিক্সড যন্ত্রটি ব্যবহার করে, যা দিয়ে অল্প পানি ব্যয়েই অগ্নিনির্বাপণ সম্ভব। এসব যন্ত্র বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসে নেই। কবে সংযোজন হবে, তা এখনো জানা যায়নি।

ফায়ার স্টেশনগুলোতে জনবলেরও ঘাটতি আছে। নতুন স্টেশন চালু হলে প্রশিক্ষিত দমকল কর্মীর ঘাটতি আরও প্রকট হবে। তারপরও প্রশ্ন আছে কর্মরত ফায়ারম্যানদের অনেকের শারীরিক যোগ্যতা নিয়ে। যা–ই হোক ওপরের বর্ণনায় এটাই পরিষ্কার, বাংলাদেশ ফায়ার ব্রিগেডে পর্যাপ্ত পরিমাণ মানসম্মত যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। আবার যন্ত্রপাতির ঠিকমতো যত্ন না নেবার কারণে অনেক যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। দেশের হাসপাতালগুলোরও একই অবস্থা, অথচ কোথাও কেও নেই যে বা যাঁরা যন্ত্রপাতিগুলোর সুব্যবস্থা করতে উঠেপড়ে লেগে আছে!

টোমি বেশ গর্বের সঙ্গে বলল, নাগরিকদের জীবনে স্বস্তি দেয়াই তাদের কাজ। সে ফায়ার ব্রিগেডের ওপর পারদর্শী, তাই নানা বিষয়ের ওপর জানলাম। ভাবনায় এল, শেয়ার করি তার কর্মের অংশটুকু সবার সঙ্গে। বাড়ির পাশে বাল্টিক সাগর ঠান্ডায় জমতে শুরু হয়েছে, কিছু দিনের মধ্যেই হাঁটব তার ওপর দিয়ে, ভাবতেই গা শিউরে উঠছে।