আমার গর্ব মুহাম্মদ ইউনূস
আমরা বাংলাদেশি যাঁরা বাইরে আসি, তাঁদের নিজেদের জাতি হিসেবে পরিচয় দেওয়ার আসলে তেমন কিছু থাকে না। আমরা দেশে থাকলে হয়তো এসব বোধগম্য হয় না। নিজের দেশে নিজেই রাজা হিসেবে থাকি। কিন্তু বাইরে এলে আসলেই জাতিগত তুলনা চলে আসে।
মধ্যপ্রাচ্যে যাঁরা যাই, তাঁদের প্রায় সবটাই শ্রমিক হিসেবে। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যের লোকজনের কাছে আমাদের পরিচয় মূলত শ্রমিক জাতি হিসেবে। আমরা যাঁরা কাছ থেকে তাঁদের সঙ্গে চলি, জানি, তাঁদের মধ্যে আমাদের ছোট করে দেখার একটা প্রবণতা থাকে। কারণ, তাঁরা তাদের দেশে আমাদের শ্রমিক হিসেবেই দেখে আসছেন।
দ্বিতীয়ত, আমাদের গায়ের রং এবং আমরা সংখ্যায় এত কম যে আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কাছে হারিয়ে যাই। কি বিশ্ববিদ্যালয়, কি চাকরি, সব জায়গায় ভারতীয়দের প্রাধান্য। তাদের ভিড়ে আমরা যে বাংলাদেশ বলে একটা দেশ বা বাঙালি বলে একটা জাতি আছি, এটা অনেকে জানেই না। গায়ের রঙের কারণে কেউ কেউ আমাদের ভারতীয় হিসেবে গণনা করে। করবেই না কেন, বাংলাদেশের সেই ভাষা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আমাদের গর্ব করার মতো যে তেমন কিছুই নেই। তাই বাইরের কেউ বাংলাদেশকে জানার তেমন বড় কোনো কারণও নেই। কাজেই, বাংলাদেশের কেউ কেউ নিজেকে ভারতীয় মনে করে গর্ববোধ করলে বা চাকরির বাজারে একটু সুবিধা নিলে অবাক হবারও তেমন কারণ থাকে না। কারণ, ভারতীয়রা বাইরে একটা নিজেদের জাতীয় ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করে ফেলেছে।
আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, সেখানে সবচেয়ে বড় ছাত্র সংগঠন ভারতীয়দের। তারা তাদের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকঢোল পিটিয়ে বড়সড় আকারে করে। সাদা, কালো অনেক অতিথি থাকে। এখানে তাদের একটা ব্র্যান্ডিং হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংগঠনগুলোর বড় বড় পদগুলোতেও তাঁদের আধিক্য থাকে। শুধু আমার বিশ্ববিদ্যালয় না, সারা বিশ্বের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে, সব জায়গায় কম-বেশি একই অবস্থা। একবার বিশ্বের নাম্বার ওয়ান বিশ্ববিদ্যালয় এমআইটি ঘুরতে গেলাম, সেখানেও দেখি স্টুডেন্ট ইউনিয়নের ভাইস-প্রেসিডেন্টে এক ভারতীয়র নাম।
মোটকথা বাইরে আমাদের জাতীয় আত্মপরিচয় সংকটে যে থাকতে হয়, সেটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
এই আত্মপরিচয় সংকটে ভুগতে থাকা অবস্থায় আমি একবার ২০১৮ সালে গেলাম আমেরিকা কনস্যুালেট জেনারেল অফিস, হেলিফ্যাক্স, কানাডাতে। আমেরিকার ভিসা করার জন্য। ইন্টারভিউয়ের জন্য অপেক্ষমাণ কক্ষে বসে থাকার সময় দেখলাম, সেখানকার বড় টিভির পর্দায় বার বার আমাদের নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন দেখানো হচ্ছে। সেখানে টিভির পর্দায় মুহাম্মদ ইউনূসকে দেখার পরই সত্যিকার অর্থেই আমার আত্মবিশ্বাস অনেকখানি বেড়ে যায় এই ভেবে যে আমি মুহাম্মদ ইউনূসের দেশের লোক। আর তাঁরা তাঁকে ভালো করে চেনেন, জানেন। আমি নিজেকে গর্ববোধ করি যে আমি সেই দেশেরই একজন। তাঁরা ইউনূসকে যদি এক সাগর সমান গুরুত্ব দেন, তাহলে আমাকে তো অন্তত তার এক বিন্দু হলেও গুরুত্ব দেবেন। যাহোক, কোনো সমস্যা ছাড়াই সে যাত্রায় আমার ভিসা হয়ে যায়। এই যে আত্মপরিচয়, এই যে আত্মতৃপ্তি এটার মূল্য যে কতখানি, আমরা যারা বাইরে থাকি, তাঁরা অনেক অনেক বেশি অনুভব করি।
লেখক: নূর আলম, পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইক, কানাডা
ইমেইল: [email protected]