দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রটোকল, আমার অভিজ্ঞতা

গাজীপুরের শ্রীপুরে বনভোজনের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে গতকাল শনিবার তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছেফাইল ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়–সম্পর্কিত কোনো খবর চোখে পড়লে মনোযোগ দিয়ে পড়ি। কেননা, একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছিলাম। বেশ কয়েক মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হওয়া নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনে একটি লেখা লিখেছিলাম। অকল্পনীয় সেই ঘটনায় মনে ভীষণ একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। ধর্ষণের ঘটনা প্রতি দেশেই হয়ে থাকে, আবার তার জন্য কঠোর আইনও প্রচলিত আছে; কিন্তু ক্যাম্পাসে এমন নজির খুব একটা নেই।

তারপর ক্যাম্পাসের ভেতর ‘মব জাস্টিস’ কার্যকর করা হয়েছে। তা–ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র অঙ্গনে কাম্য নয়। ক্যাম্পাস শিক্ষার পুণ্যভূমি। এখানে মানুষ গড়ার কারিগর তৈরি করা হয়, বেঁচে থাকার চাবিকাঠি দেওয়া হয়।

অতিসম্প্রতি একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। ডেইলি স্টার লিখেছে, ‘No student should be at risk of death on their campus।’লেখাটা পড়ে কিছুক্ষণের জন্য মনটা বেদনার সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেল।

আফসানা করিম কত আশা নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিল। একনিমেষেই মেয়েটির সব স্বপ্ন চিরতরে হারিয়ে গেল। আমরা ২০০১ সালে তিন মেয়ে নিয়ে এই যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে পা রেখেছিলাম। সৌভাগ্যবশত তারা তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে এসেছে অনেক আগেই। বাবা–মা হয়ে ছেলেমেয়ের জন্য সার্বক্ষণিক চিন্তা তো থাকেই।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধ করার উপায় কী? ‘সেফটি প্রটোকল’ বলে এই যুক্তরাষ্ট্রে বাধ্যতামূলক নির্দেশনা থাকে। তারপরে এখানে দুর্ঘটনা ঘটে না, তেমন নয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশে ডাবল ডেকার বাসে করে পুরো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিল। পথের মধ্যে ঝুলন্ত বিদ্যুতের তার লেগে বাসটি বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়ে। সম্ভাবনাময় তিন শিক্ষার্থী মারা যায়। অবশ্যই হৃদয়বিদারক ঘটনা।

নানা ধরনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বিশ্বজুড়ে। তবু উন্নত বিশ্বে পরবর্তী করণীয় ধাপগুলো লিখিত প্রটোকল থাকে। এ বিষয়ে প্রতিনিয়ত ট্রেনিং হয়।

একবার ড্রাইভিং করার সময়ে পুলিশের টিকিট খেলাম। টাকার অঙ্কটা কমানোর জন্য ডিফেন্সিং কোর্স নিতে হয়েছিল। ট্রেনিংয়ের গুরু বলছিল, ‘স্পিড করে বড়জোর পাঁচ মিনিট আগে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাবে। কিন্তু জীবনের রিস্ক তো থেকে যায়।’

প্রটোকল ব্যাপারটা কী? কোনো অবস্থায় কী করতে হবে অথবা যেকোনো কাজ করার জন্য ধাপগুলো লিপিবদ্ধ থাকে।

এখানে একটা গাছ কাটা কীভাবে স্টেপ বাই স্টেপ করা হয়? আমাদের প্রতিবেশীর বাসার সঙ্গে একটি বিশাল গাছ কাটাতে হবে। কেননা বেশ কয়েকবার টর্নেডোয় অন্য গাছ পড়ে বাড়িঘরের বেশ ক্ষতি হয়েছে। সুতরাং বাড়ির মালিক ঠিক করলেন টিকে থাকা বিশাল গাছটি কাটাতে হবেই। প্রফেশনাল গাছ কাটার কন্ট্রাক্টর ঠিক করা হলো। কন্ট্রাক্টরদের প্রথম প্রটোকল ছিল, একজন অভিজ্ঞ লোক এসে গাছটি পর্যবেক্ষণ করলেন। গাছটির তিন পাশে তিনটি বাড়ি। একটি আমাদের। তারপর একদিন সকাল থেকে কাজ শুরু হয়ে গেল। বিশাল আকারের একটি ক্রেন এল। প্রায় পাঁচ থেকে ছয়জন লোক এলেন। একজন বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে দড়ি বেয়ে গাছে উঠলেন এবং প্রায় চূড়ায় পৌঁছে গেলেন। তারপর ছোটখাটো ডালপালা কাটার আগেই ক্রেনের দড়ির সঙ্গে বেঁধে কাটা শুরু করলেন। ক্রেন সেই ডালপালা তখন নিরাপদ স্থানে ফেলতে লাগল। সেই নিরাপদ স্থান থেকে ট্রাকে উঠিয়ে দিতে লাগলেন একজন। পুরো গাছ কাটা এবং পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করে শেষ করতে প্রায় সাত থেকে আট ঘণ্টা লেগে গেল। অবশ্য কত টাকা খরচ হয়েছে শুনলে অবাক হবেন। যদিও সিটি থেকে কিছু সহায়তা পাওয়া গেছে। তারপরও প্রায় আট–নয় হাজার ডলার খরচ হয়েছে আমাদের প্রতিবেশীর।

আমাদেরও একটি বিশাল পিকানগাছ ছিল। টর্নেডো আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ একদিন গাছটির গুঁড়ি উপড়ে রাস্তায় পড়ে গেল। আমাদের প্রতিবেশীসহ কারও কোনো ক্ষতি হয়নি। আবার সেই পড়ে যাওয়া গাছটি সিটি থেকে এক দিনেই পরিষ্কার করে ফেলল।

যুক্তরাষ্ট্রে সবকিছুতেই একটা লিখিত প্রটোকল থাকে এবং সবাই সেই মতো কাজ করে। বাংলাদেশে কোনো কিছুতে কোনো প্রটোকল নেই। যে যার মতো কাজ করে। ক্যাম্পাস নিরাপত্তা বিষয়ে শুধু কর্মকর্তা আছেন। হয়তো নিয়ম অনুসারে কোনো লিখিত প্রটোকল নেই।

আফসানা করিমের মৃত্যু কি রোধ করা যেত না? অবশ্য অনেক দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। নবীন শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রথম দুই– তিন দিন নিরাপত্তা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা উচিত। ক্যাম্পাসেও হাঁটার রাস্তা থাকা উচিত। ক্যাম্পাসে গাড়ি, অটো কিংবা রিকশা—সব যানবাহনের চলাচলের নির্দেশনা গেটে থাকা উচিত এবং তা দেখার জন্য সার্বক্ষণিক গার্ড থাকবে।

রাস্তায় বিদ্যুতের ১১ কেভি তার ঝুলছে, পল্লী বিদ্যুতের কোনো ইনস্পেকশন নেই। বাসচালকেরও ধীরে চালানো উচিত। গ্রামের রাস্তায় স্পিড লিমিট খুব কম হওয়ার কথা এবং ঝুলন্ত তারটি চোখে পড়ার কথা।

মানুষের জীবনটাই কচুপাতায় এক বিন্দু শিশির। হঠাৎ নাড়া লেগে পড়ে যাওটাই সম্ভাব্য পরিণতি। আফসানা করিমের মা–বাবা, আত্মীয়স্বজনের কষ্টটা বুঝতে পারছি। একইভাবে তিনজন বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থীর অকালে চলে যাওয়ার বেদনাও মনকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। একমাত্র ভরসা ওপরওয়ালা।

*লেখক: জীবেন রায়, অধ্যাপক, বিজ্ঞান ও অঙ্ক বিভাগ, মিসিসিপি ইউিনিভার্সিটি ফর উইমান, কলম্বাস, যুক্তরাষ্ট্র

**দূর পরবাসে লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]