তরুণেরা এখন আর কথায় নয়, কাজেই বিশ্বাস করেন
কিছুদিন যাবৎ ভাবছিলাম, কিছু লিখব। তরুণদের নিয়ে আমার দেখা কিছু কথা, কিছু উপলব্ধি; কিন্তু নানা ব্যস্ততায় হয়ে উঠছিল না।
সম্প্রতি কিছু সভা-সেমিনার ও কর্মশালায় অংশ নিয়ে তরুণদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো। তাঁদের অনুভূতি, স্বপ্ন, চ্যালেঞ্জ—সবকিছু শুনে মনে হলো, এবার না লিখে থাকা যায় না। আমি যত তরুণের সঙ্গে মিশি, ততই বুঝি, তাঁরা গভীরভাবে ভাবতে শিখেছেন, শিখছেন। তাঁরা আশাবাদী ও সাহসী। তাঁরা চান পরিবার, সমাজ, এমনকি বিশ্বে কিছু অবদান রাখতে। তাঁরা চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পান না; বরং চ্যালেঞ্জ তাঁদের শক্তি দেয়। তাঁরা আদর্শ খোঁজেন, আদর্শ হতে চান; কিন্তু অনেক সময় আমি তাঁদের চোখে গভীর হতাশার ছাপ দেখি।
এসব তরুণ প্রশ্ন করেন, মৃদুকণ্ঠে হলেও অনেক গভীর প্রশ্ন। তাঁরা বলেন, যাঁরা আমাদের সামনে পথ দেখান, কথা বলেন, সভা-সেমিনারে যাঁরা ন্যায়ের কথা বলেন, ভালোবাসার কথা বলেন, তাঁদের জীবনে সেসব কতটা বাস্তব?
এসব তরুণের ভাষায়, ‘আমরা তো বোকা না। আমরাও বুঝি। বোঝার চেষ্টা করি। শুধু মিষ্টি কথায় কাউকে বিশ্বাস করি না। আমরা খাঁটি নেতৃত্ব দেখতে চাই, কথার সঙ্গে কাজের মিল আছে। যার মধ্যে আছে সততা আর সাহস।’
তরুণেরা শুধু বক্তৃতা শোনেন না। তাঁরা দেখেন, কে কথায় কাজের মিল রাখেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন চোখ দিয়ে। আমি নিজেও এর ব্যতিক্রম না। একবার পরিবেশ নিয়ে কাজ করার সময় এক তরুণ খুব সাধারণ একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি কি প্লাস্টিক ব্যবহার করেন?’
সেই একটাই প্রশ্ন আমাকে অনেকটা সময় চিন্তায় রেখেছিল। তরুণেরা নিখুঁত চান না, তাঁরা দেখতে চান, আপনি নিজে কতটা আন্তরিক, কতটা দায় নিয়ে নিজের কথা পালন করেন। আপনি হয়তো ভুল করবেন; কিন্তু আপনি দায় নিচ্ছেন কি?
আমরা যাঁরা পরিবার, সমাজ, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা বিভিন্ন সংগঠনে নেতৃত্বের দায়িত্বে আছি, আমাদের জন্য এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি। কারণ, তরুণেরা এখন আর কথায় নয়, কাজেই বিশ্বাস করেন।
তরুণেরা প্রশ্ন করেন। তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁরা দেখতে চান, আপনি যা বলছেন, আপনি নিজেই তা মানছেন কি না। এই লেখার উদ্দেশ্য কারও প্রতি অভিযোগ নয়; বরং এটি একটি আন্তরিক আহ্বান, আমাদের সবার নিজের দিকে ফিরে তাকানোর সুযোগ। আমরা কি এমন এক বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে তুলতে পারছি, যা তরুণদের আস্থা ও আশার জায়গা হতে পারে?
তরুণদের সামনে বিশ্বাসযোগ্য উদাহরণ দেওয়ার সময় এখনই। তাঁরা শুনেছেন অনেক প্রতিশ্রুতি, বক্তৃতা, আদর্শের কথা। এখন তাঁরা দেখতে চান, কে সত্যিই দায়িত্ব নিচ্ছেন, কে নিজের অবস্থান ব্যবহার করছেন অন্যের পাশে দাঁড়াতে। তাঁরা মুখের কথা নয়, জীবনের আচরণে নেতৃত্ব খোঁজেন। তাঁরা চান স্বচ্ছতা, চান জবাবদিহি, চান এমন মানুষ, যাঁদের বিশ্বাস করা যায়।
আমি বিশ্বাস করি, যদি আমরা কথার চেয়ে বেশি জীবনের মাধ্যমে নেতৃত্ব দিই, তরুণেরা আমাদের পাশে আসবেন। তাঁরা শুধু শুনবেন না, নিজেরাও এগিয়ে আসবেন। তাঁরা চিন্তা করবেন, প্রশ্ন করবেন এবং একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটি বিশ্বাসযোগ্য, ন্যায্য ও মানবিক সমাজ গড়বেন।
সবশেষে বলি, তরুণেরা এখন আর কথার মোহে পড়েন না। তাঁরা দেখতে চান, আপনি যা বলছেন, তা আপনি নিজেই কতটা পালন করছেন। তাঁদের বিশ্বাস গড়ে ওঠে কাজ দেখে, জীবনের সত্যতা দেখে। আর সেই বিশ্বাস, তৈরি করতে হয় নিজের জীবন দিয়ে প্রতিদিন, প্রতিটি আচরণে, নীরবে।
* লেখক: উইলয়িাম নকরেক, সভাপতি, ইন্টারন্যাশনাল মুভমেন্ট অব ক্যাথলিক স্টুডেন্টস-পাক্স রোমানা; জেনেভা, সুইজারল্যান্ড
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]