পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের মাস ডিসেম্বর
১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হলেও পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর দমনমূলক রাজনীতি শুরু করে। বাঙালিদের দাবিয়ে রাখতে সচেষ্ট ছিল। তাদের ওপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর মুহম্মদ আলী জিন্না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ঘোষণা দেন, ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা।’ মাতৃভাষার প্রতি এমন আক্রমণ সহ্য করতে পারেননি অগণিত বাঙালি। তাঁরা প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। বাঙালির আত্মমর্যাদার প্রতি জিন্নার এই আঘাত মেনে নিতে না পেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে শামিল হন। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকেই বাঙালি সেদিন অহিংস আন্দোলনে নেমেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র প্রতিবাদীদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায়।
শহীদ হন ভাষাসংগ্রামীরা। এর ফলে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়। এই দিনের স্মরণে সারা বিশ্বে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপন করা হয়।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অবিভক্ত পাকিস্তানে ১৯৭০ সালে জয়লাভ করলেও সেখানেও ভয়ংকর চক্রান্তের শিকার হতে হয়। এরপর বাঙালি জাতিকে শেষ করে দেওয়ার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শুরু হয় গণহত্যা। পাকিস্তানিদের বর্বরতায় ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে শহীদ হন ৩০ লাখও বেশি বাঙালি। লাখ লাখ নারী বীভৎসতম ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হন।
এক কোটিরও বেশি মানুষ বাধ্য হন দেশ ছাড়তে হয়। ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরো বাংলাদেশ পরিণত হয় বধ্যভূমিতে। এতে সহযোগিতা করে এ দেশের দোসর রাজাকার, আলবদর বাহিনী। কিন্তু মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনার বীরত্বের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। মিত্রবাহিনীর কাছে মাত্র ১২ দিনের যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়। আত্মসমর্পণ করে ৯০ হাজার পাকিস্তানি। এত বড় আত্মসমর্পণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হয়নি।
গত ১৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন কংগ্রেসম্যান হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। সেই প্রস্তাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জো বাইডেনকে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সংঘটিত নৃশংসতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার অনুরোধ করা হয়। মার্কিন কংগ্রেসম্যান স্টিভ চ্যাবট (রিপাবলিকান), ভারতীয় বংশোদ্ভূত কংগ্রেসম্যান রো খান্নার (ডেমোক্র্যাট) সঙ্গে মানবতা, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে অপরাধকেও যুক্ত করার দাবি তুলেছেন।
আট পৃষ্ঠার প্রস্তাবটির শিরোনাম—‘১৯৭১ সালের বাংলাদেশ গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়া’। প্রস্তাবটি প্রাথমিকভাবে ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণধর্ষণ ও গণহত্যায় সক্রিয় জড়িত থাকার ক্ষেত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সক্রিয় ভূমিকার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন কংগ্রেসম্যান রো খান্না বলেন, ‘১৯৭১ সালের বাঙালি গণহত্যার স্মরণে প্রথম প্রস্তাব উপস্থাপন করার জন্য রিপাবলিক স্টিভ চ্যাবোটের সঙ্গে যোগ দিতে পেরে আমি গর্বিত। সেখানে লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যা এবং বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল।’ রেজল্যুশন জমা দেওয়ার পরে তিনি একাত্তরের পাকিস্তানি বর্বরতা প্রসঙ্গে টুইট করেন, ‘আমাদের সময়ের সবচেয়ে ভুলে যাওয়া গণহত্যার একটি।’
অপর একটি টুইটে রিপাবলিকান পার্টির সদস্য চাবোট লেখেন, ‘আমাদের বছরের পর বছর ধরে গণহত্যা করা লাখ লাখ মানুষের স্মৃতি মুছে দিতে দেওয়া উচিত নয়। গণহত্যার স্বীকৃতি ঐতিহাসিক রেকর্ডকে শক্তিশালী করে, আমাদের শিক্ষিত করে এবং অপরাধীদের বুঝিয়ে দেয় যে এই ধরনের অপরাধ মানুষ কখনো সহ্য করবে না বা ভুলে যাবে না।’
এবার ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হাউস, জাতিসংঘের জেনেভা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট ব্রাসেলসের মতো গ্লোবাল বেঞ্চমার্ক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে।
১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিপরীত রাজনৈতিক অবস্থানে ছিল। তখন তারা পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে সক্রিয় সমর্থন করেছিল। অবশেষে ৫০ বছর পরে তাদের বিবেক জাগ্রত হয়েছে। রেজল্যুশনটি তাই শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধেরই নয়, সেই সময়ে সংগঠিত গণহত্যা ও গণধর্ষণের ভয়াবহতার কথা স্মরণ করে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছে।
আমেরিকান কূটনীতিক আর্চার ব্লাডস টেলিগ্রামে সম্ভবত সেই বর্বর রাতে যা ঘটেছিল, তার সবচেয়ে সঠিক কালানুক্রমিক বিবরণী পাঠিয়েছিলেন। অবশেষে ৫০ বছর পর অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার সময় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়ায় ডেমোক্রেটিক পার্টির তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠানে পাকিস্তানকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করেছেন। তবে রেজল্যুশনের যৌক্তিক উপসংহারে মার্কিন প্রশাসনকে পাকিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়াটা জরুরি।
বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম স্থিতিশীল এবং দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে।
দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই একসঙ্গে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য কাজ করছে।
দেশের নাগরিকদের জন্য একটি উজ্জ্বল ও উন্নত ভবিষ্যতের স্বার্থে বাংলাদেশ এবং ভারত প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক বন্ধনে আবদ্ধ। সেই সঙ্গে বন্ধুত্বকে চিরস্থায়ী করতে উভয় দেশই দায়িত্বশীল।
প্রিয়জিৎ দেবসরকার : গবেষক ও লেখক