ভালোবাসা ও রাতযাপনের গল্প

মাউন্ট ইডেন, অকল্যান্ডছবি: সংগৃহীত

নিউজিল্যান্ডে আসার পর অকল্যান্ড যখন ছিলাম, একটা উল্লেখযোগ্য সময় আমি জাকারান্ডা লজে থাকি। ব্যাচেলর জীবনে জাকারান্ডা লজের মতো বসবাসের জন্য উত্তম স্থান আর পাইনি। জাকারান্ডা লজ ছিল মাউন্ট ইডেন সাবার্বের ভিউ রোডে। ভিউ রোডের মাথায় ছিল ইডেন পাহাড়। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে গাড়ি নিয়ে একেবারে চূড়ায় ওঠা যায়। চূড়া থেকে পুরো অকল্যান্ড শহর দেখতে কী যে ভালো লাগে! আমি প্রায়ই বিকেলে গিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় বসে থাকতাম।

নিউজিল্যান্ডে আসার পর থেকেই আমি কবি বা লেখক খুঁজছিলাম। হয়তো আমি দু-কলম লিখতাম বলেই আমার সেই কবি–সাহিত্যিক খোঁজার আগ্রহটা জেগেছিল। দু-একজনকে যে পাইনি, তা নয়।

হয়তো দুই-চারটা কথা হয়েছে, কিন্তু তেমনভাবে মেশার সুযোগ হয়নি। একবার হেস্টিংস গিয়ে বিখ্যাত লেখক এলেন ডাফ-এর ঠিকানা খুঁজে পাই। তার ‘ওয়ানস ওয়ের ওয়ারিয়র’ উপন্যাস তখন নিউজিল্যান্ডে তুমুল বিখ্যাত। এ নিয়ে পরে সিনেমাও হয়। আমার বন্ধু মারামা লিডিয়াকে নিয়ে তার বাসায় গিয়ে জার্মান শেফার্ড কুকুরের যে দৌড়ান খাই, তা আজও ভুলতে পারি না। কুকুর আমি তেমন ভয় পাই না।

কিন্তু সেদিন কেন এত ভয় পেয়েছিলাম, তা বলতে পারব না। তার বাসাটা ছিল হেস্টিংস শহরের অদূরে হেভলুক নর্থ নামে একটা ছোট্ট শহরে। আসলে হেভলুক নর্থকে বলা যায় হেস্টিংস শহরেরই একটা শহরতলি। চারিদিকে শুধু আপেল আর আঙুরের বাগান। মাঝখানে শহর। টি-মাতা পিক থেকে শহরটা দেখলে একটা স্বপ্নপুরির মতো মনে হয়। শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে টুটুকারি নদী। সেখানে মূলত কৃষকেরা বসবাস করেন। যাদের বাড়ির সামনে শুধু চারটা-পাঁচটা গাড়ি নয়, কারও কারও নিজস্ব হেলিকপ্টারও আছে।

এলেন ডাফ হেভলুক নর্থ শহরের কৃষকদের মতো ধনী ছিলেন না। তাঁর কৃষি কাজের সঙ্গে সংযুক্তিও ছিল না। তিনি মূলত লেখালেখি করতেন আর হকসবে টাইমস পত্রিকায় চাকরি করতেন বলে খুব সাধারণ জীবনযপন করতেন। তবে তিনি পৈতৃকভাবে পান আর নিজে কিনে থাকেন, তাঁর বাড়িটা ছিল কয়েক একর জমির ওপরে। অপূর্ব সুন্দর একটা ঝরনার ধারে তাঁর ঘরটা ছিল। দুর্ভাগ্য বশত তাঁর কুকুরের দৌড় খেয়ে গাড়িতে ওঠার পর জানতে পারি, তিনি বাড়িতে নেই। তখন তো আর মোবাইল ছিল না।

সেটা ১৯৯৮ সালের গল্প। পরে অবশ্য তাঁর সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল, সেটা অন্য গল্প।

২.

গল্পটা শুরু করেছিলাম জাকারান্ডা লজ দিয়ে। হ্যাঁ, সেই জাকারান্ডা লজে একদিন এক উঠতি কবি পেয়ে যাই। স্টিভ ল্যাংটন। বয়স ২৭ কি ২৮। তখন ঠিক আমারই বয়সী ছিল। গল্পটা ১৯৯৮ বা ৯৯ সালের।

হ্যাঁ, স্টিভ ল্যাংটনের গল্পটা বলার আগে দু-তিনটা বাক্য না বললেই নয়। আমার গল্পটা ২৫ বছর আগের।

তখন বাংলাদেশে প্রেম-ভালোবাসা বা দাম্পত্যজীবন এখনকার মতো ছিল না। এখনকার মতো এত বিবাহ বিচ্ছেদও হতো না।

স্টিভ ল্যাংটন থাকত ১২ নম্বর রুমে, আর আমি থাকতাম ৯ নম্বর রুমে। জাকারান্ডা লজে মোট ২৪টা রুম থাকলেও টিভি রুম, লন্ড্রি ও কিচেন ছিল কমন। একদিন টিভি রুমেই পাশাপাশি সোফায় বসে টিভি দেখতে গিয়ে কথায় কথায় পরিচয়। পরিচয় পর্বের পর আমরা আস্তে আস্তে বন্ধু হয়ে উঠি। দুজনই লেখালেখি করি বলেই আমাদের বন্ধুত্ব ক্রমাগত গভীর হয়ে ওঠে। আমরা মাঝেমধ্যে বিকেলে ইডেন পাহাড়ের চূড়ায় হাঁটতে যেতাম। সে জীবনের গল্প বলত, আমি আমার জীবনের গল্প বলতাম। তবে বেশির ভাগই আমাদের লেখালেখি নিয়ে গল্প হতো।

একদিন স্টিভ ল্যাংটন জিজ্ঞাসা করে, বন্ধু, তোমাদের দেশে ভালোবাসা মানে কী?

আমি বলি, আমাদের দেশে ভালোবাসা মানে চোখে চোখে দেখা, একটু স্পর্শ করা, বড়জোড় গায়ে গা ঘেঁষে বসা।

—এটা আবার কী ধরনের ভালোবাসা?

—এটাই প্রকৃত ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার পরিণতি হিসেবে ওরা বিয়ে করে।

—বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক?

—সেটা সাধারণত বিয়ের আগে কখনো হয় না। বিয়ের পর হয়।

—এটা একটা অপ্রকৃত ভালোবাসা। বুলশিট ব্যাপার।

—তোমার কাছে তা মনে হতে পারে। কেন মনে হতে পারে, আমি জানি। তোমাদের নিউজিল্যান্ডে ভালোবাসা মানে ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড, ওয়ান উইক স্ট্যান্ড। কারও ভালোবাসা এক বছর টিকে গেলে সেটা অন্য ব্যাপার। তিরিশের আগে তোমরা কেউ স্থায়ীভাবে সম্পর্ক গড়তেই চাও না। কিন্তু সেই ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড, ওয়ান উইক স্ট্যান্ড ভালোবাসায় তোমরা একজন আরেকজনকে কতবার যে আই লাভ ইউ বলো, বলাই বাহুল্য। আর আমরা সারাজীবন ভালোবেসে ও সংসার করে একবারে জন্যও বলি না, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমরা মনে করি, ভালোবাসা সম্পূর্ণ অনুভূতির।

—আর শারীরিক সম্পর্ক?

—আমি জানি, তুমি এ প্রশ্নটা করবে। তোমাদের ভালোবাসা মানেই তো সেটা। শারীরিক সম্পর্ক আর ফিলিংসের মধ্যে তোমরা পার্থক্যই বোঝো না।

স্টিভ ল্যাংটন হাসে। বলে, বিধাতা ভালোবাসা কেন দিয়েছে, জানো?

আমি জিজ্ঞাসা করি, কেন?

স্টিভ ল্যাংটন জোর দিয়ে বলে, শারীরিক সম্পর্কের জন্য। সেখান থেকেই ভালোবাসার উৎপত্তি।
আমি এর কোনো জবাব দিই না।

টি মাতা পিক, হেভলুক নর্থ, হকস বে
ছবি: সংগৃহীত

৩.

লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকত হয় বলে ঘুরে ঘুরে ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড, ওয়ান উইক স্ট্যান্ড ভালোবাসার মানুষ খুঁজে নেওয়ার মতো স্টিভ ল্যাংটনের সময় ছিল না। তাই সে যে কয়টা মেয়েকে ভালোবেসেছে, সেটা একটু দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। অন্তত কয়েক মাসের জন্য। সে আগের মেয়েটাকে যে ভালোবাসত, সেটা এক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। সেটা ভেঙে যাওয়ার পরই মাস তিনেক আগে সে জাকারান্ডা লজে এসে ওঠে।

স্টিভ ল্যাংটন একদিন জাকারান্ডা লজের লন্ড্রিতে কাপড় ধুইতে গিয়ে আমাকে দেখে খুশিতে আটখানা হয়ে বলেন, ‘সে আরেকটা নতুন মেয়ের প্রেমে পড়েছে। মেয়েটার নাম স্ট্রেসি। এক বিকেলে সে স্ট্রেসিকে নিয়ে ইডেন পাহাড়ের ওপরে আসে। আমাদের দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়। রাতে আমরা একটা রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে ডিনার করি।’

এক সপ্তাহের মাথায় স্ট্রেসি জাকারান্ডা লজের ১২ নম্বর রুমে উঠে আসে। স্টিভ ল্যাংটনের কী উচ্ছ্বাস! সে তার রুমটা নতুন করে সাজায়। সিঙ্গেল খাটের বদলে ডবল খাট কিনে এনে বসায়। নোয়েল ল্যামিং ইলেকট্রনিকস স্টোর থেকে টিভি কিনে নিয়ে আসে। রুমের জন্য একটা ছোট্ট ফ্রিজও কিনে।

স্টিভ ল্যাংটনের পাশাপাশি স্ট্রেসির সঙ্গেও আমার দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আসলে আমি তাদের দুজনের পারিবারিক জীবনেরও বন্ধুই হয়ে উঠি। ওরা ওদের ছোটখাটো অনুভূতিগুলোও আমার সঙ্গে শেয়ার করত। আমি দু-তিনবার ইন্ডিয়ান রেস্তোরায় গিয়ে ডিনার করিয়েছি।

এভাবে ছয় মাসের মতো চলে যায়। একদিন খুশিতে ডগমগ হয়ে স্টিভ ল্যাংটন আমার রুমে এসে বলে, বন্ধু, আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

আমি জিজ্ঞাসা করি, তাই নাকি?

স্টিভ ল্যাংটন বলে, হ্যাঁ। স্ট্রেসি খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে।

—এখনি?

—না, নতুন বছরের শুরুতে। একটু গোছগাছের ব্যাপার আছে তো। তবে স্ট্রেসি চাচ্ছে, এখনই এনগেজমেন্টটা সেরে নিতে।

স্টিভ ল্যাংটন ও স্ট্রেসি বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আমি খানিকটা অবাক হই। যদিও অবাক হওয়ার কিছু নেই। প্রায় ছয় মাস ওরা একসঙ্গে থাকছে। স্টিভের বয়স আটাশ হলেও স্ট্রেসি স্টিভের চেয়ে দুই বছরের বড়, ৩০ বছর। ৩০ বছর বয়সে সাধারণত নিউজিল্যান্ডে মেয়েরা স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে সেটেল্ড হতে চায়।

স্টিভ লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকত আর খণ্ডকালীন একটা চাকরি করত। খুব বেশি ইনকাম ছিল না।

ওদিকে স্ট্রেসি নার্সিংহোমের নার্স ছিল। বেতন ভালোই ছিল।

একদিন স্টিভ ল্যাংটন আমাকে নিয়ে স্ট্রেসির জন্য দারুণ একটা হীরের আংটি কিনে নিয়ে আসে। এক সন্ধ্যায় এক রেস্তোরাঁয় তাদের বাগদান হয়ে যায়। তারপর আরও দুই মাস চলে যায়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, বিয়ের পর জাকারান্ডা লজ ছেড়ে ওরা বড় একটা বাসা নেবে।
তখন নভেম্বর মাস চলছিল।

৪.

নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি স্টিভ ল্যাংটন অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে কবিসাহিত্যিকদের একটা সাহিত্য সম্মেলনের আমন্ত্রণ পায়। সেবারই প্রথম। পাঁচ দিনের সম্মেলন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। থাকা-খাওয়া ফ্রি। এমনকি প্লেনের আসা-যাওয়ার টিকিটটাও দেবে।

স্টিভ ল্যাংটন সেই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায়নি। তাই এক সকালে সে অকল্যান্ড বিমানবন্দর থেকে সিডনির উদ্দেশ্যে বিমান ধরে। আমি আর ট্রেসি গিয়ে স্টিভ ল্যাংটনকে অকল্যান্ড বিমানবন্দরে নামিয়ে দিয়ে আসি।

স্টিভ ল্যাংটন সিডনি যাওয়ার চার দিনের মাথায় মধ্যরাতে কিসের একটা শোরগোলে আমার ঘুম ভেঙে যায়। জাকারান্ডা লজ এমনিতে খুব নিরিবিলি। এখানকার বোর্ডাররা সহজে কাউকে বিরক্ত করতে চায় না। কেউ হয়তো সকালে কাজ করে, রাতে তাদের ঘুমাতে হয়। কেউ নাইটশিফট করে, তাদের ঘুমাতে হয় দিনে। এ ছাড়া এই লজের ম্যানেজার প্যাম ব্যানেট লজের শান্তি রক্ষার ব্যাপারে খুব কড়া। যদিও প্যাম ব্যানেট খুব হাসিখুশি প্রাণবন্ত মহিলা।

লজের ভেতর শোরগোল শুনে আমিসহ প্রায় সবাই দরজা খুলে বেরিয়ে আসি। আমি দরজা খুলে বেরোতেই দেখি, শোরগোলটা স্টিভ ল্যাংটন ও স্ট্রেসির রুম থেকে আসছে। অবাক হয়ে তাদের রুমের দিকে এগিয়ে যাই।

তাঁদের রুমে গিয়ে তো আমার চক্ষু একেবারে কপালে উঠে যায়। স্টিভ ল্যাংটন ও স্ট্রেসি রীতিমতো হাতাহাতি করছে। জাকারান্ডা লজের ২৩ নম্বর রুমের এক বোর্ডার তাদের ডবল বেডের মাথায় ঘাড় নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতাহাতি করতে করতে স্টিভ ল্যাংটন কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। আর স্ট্রেসি তাকে বারবার থামিয়ে দিতে দিতে বলছে, তোর মতো কুঁজোর সঙ্গে যে এত দিন আমি থেকেছি, সেটাই তো বড় কথা। তোর কপাল যে আমি তোর সঙ্গে বাগদানও করেছিলাম। কুঁজো, ইডিয়েট, বাস্টার্ড...। স্টিভ ল্যাংটন খুব লম্বা ও হ্যাংলাপাতলা গড়নের বলে হাঁটতে গেলে সত্যি তাকে কুঁজোর মতোই দেখাত।

স্টিভ ল্যাংটন ও স্ট্রেসির বিষয়টা রাতেই আমার কাছে খোলাসা হয়ে যায়। সিডনিতে সাহিত্য সম্মেলন চতুর্থ দিনেই শেষ হয়ে যায়। পঞ্চম দিন ছিল কবি–সাহিত্যিকদের ঘোরাঘুরি আর ব্যক্তিগত সময় কাটানোর দিন। স্ট্রেসির কথা খুব মনে পড়ছিল বলে স্টিভ ল্যাংটন সিডনিতে পঞ্চম দিন আর না থেকে চতুর্থ দিনেই কিছু বাড়তি টাকা খরচ করে টিকিট এগিয়ে এনে, হোটেলে ফিরে গোছগাছ করে রাতের ফ্লাইট ধরে। বিমানে সিডনি থেকে অকল্যান্ড মাত্র আড়াই ঘণ্টার পথ। স্ট্রেসিকে চমকে দিবে বলে সিডনিতে বিমানে ওঠার আগে বা অকল্যান্ড বিমানবন্দরে নেমে কোনো ফোন করেনি। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি ট্যাক্সি নিয়ে জাকারান্ডা লজে এসে হাজির হয়। ১২ নম্বর রুমে এসে নিজের চাবি দিয়ে দরজা খুলে লাইট জ্বালিয়ে যেই হেসে ওঠে, তখনই সে দেখে, তার কেনা ডবল বেডে দুই পায়ের বদলে চার পা।

স্ট্রেসি ও ২৩ নম্বর রুমের বোর্ডার স্টিফেন বিছানা ছেড়ে তখনই লাফিয়ে ওঠে। স্ট্রেসি জিজ্ঞাসা করে, আরে তুমি! তোমার না আগামীকাল আসার কথা...?

৫.

পরদিন আমার ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে যায়। আমি স্টিভ ল্যাংটনের রুমে যখন যাই, তখন প্রায় ১০টা বেজে গেছে। তার রুমে গিয়ে দেখি, সে ডবল খাটের একপাশে কুঁজো হয়ে বসে জানালা দিয়ে বাইরে কী যেন দেখছে। জানালা গলা এক চিলতে রোদ তার চেহারায় পড়ছে। সে কাঁদছে। স্ট্রেসি রাতেই জাকারান্ডা লজ ছেড়ে সেন্ড্রিংহ্যামে তার এক আত্মীয়ের বাসায় চলে গিয়েছিল। সকালে নাকি সাতটা-সাড়ে সাতটার দিকে একবার এসে নির্বিকারে তার সব জিনিসপত্র নিয়ে গেছে।

স্টিভ ল্যাংটন জানালার পাশে এভাবে কাঁদছে দেখে আমার সত্যি খুব মায়া হয়। আমি তার পাশে বসে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কিছু বলার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুই বলতে পারি না। শুধু কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকি।

একসময় স্টিভ ল্যাংটনই কান্না থামায়। সে বলে ওঠে, আমি স্ট্রেসিকে নিয়ে কতই না স্বপ্ন দেখেছি, তাকে নিয়ে কত কী কবিতা লিখেছি। ভেবেছিলাম, আরও কবিতা লিখে প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে একটা কবিতার বই বের করে তাকে উপহার দেব। আরও কত কী পরিকল্পনা। আমার অত টাকাপয়সা নেই। তারপরও বাগদানের জন্য প্রায় দেড় হাজার ডলার দিয়ে ওর পছন্দের হীরার আংটিটা কিনে এনেছিলাম। কিন্তু এদিকে স্ট্রেসি আমার সঙ্গে এটা কী করল...!

আমি আবারও সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কিছু বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এবারও কিছু বলতে পারলাম না।

এটা তো সত্য যে নিউজিল্যান্ডের তরুণ-তরুণীর ভালোবাসা আমাদের বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের ভালোবাসার মতো চোখে চোখে নয়, এখানে একজন অন্যজনের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকে না।

এখানকার ভালোবাসা ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড, ওয়ান উইক স্ট্যান্ড। সে ক্ষেত্রে স্টিভ ল্যাংটন তো ভাগ্যবান যে সে তার ভালোবাসা ৯ মাসের মতো টেনে নিয়ে গেছে। অতি আবেগে বাগদান পর্যন্ত করে ফেলেছে। কিন্তু তারপরও স্টিভ ল্যাংটনের সেই কান্না ও কান্নামিশ্রিত কণ্ঠ সেদিন আমার মন ভারী হয়ে উঠেছিল।

তারপর স্টিভ ল্যাংটন এক দিন জাকারান্ডা লজ ছেড়ে কোথায় যে চলে যায়!  

  • লেখক: মহিবুল আলম, গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া।

দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]