দ্য হ্যাংম্যান

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

৩২ বছর জেল খাটার পর জল্লাদ দুলাল শিকদারের কাল মুক্তি। আজ রাতে দুলাল তার শেষ ফাঁসি সম্পন্ন করবে। ফাঁসির আসামি একজন তিরিশ–পঁয়ত্রিশ বছরের যুবক, যাকে খুন ও ডাকাতির কারণে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে।

যথারীতি রাতে ফাঁসি শেষ হলো। মুক্ত হয়ে পরদিন সকালে বাসে করে বাড়ির দিকে রওনা দেয় দুলাল। বত্রিশ বছর পর মুক্তি পেল সে। এদিকে রাতে ফাঁসিতে মারা যাওয়া যুবকটির লাশও অ্যাম্বুলেন্সে করে সকালবেলা রওনা হয় তার বাড়ির দিকে। দুজনের গন্তব্য এক জায়গায়, একই বাড়িতে...

একটু অতীতে ফেরা যাক। বিখ্যাত ভাড়াটে খুনি নান্দাইলের কুদ্দুস পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়ার পর তার জায়গা নেয় কুদ্দুসেরই সাগরেদ দুলাল শিকদার। দুলালের বাড়িও নান্দাইল। বিয়ে করেছে কয়েক মাস হলো। ঘরে তার পোয়াতি বউ।

দুলাল এ পর্যন্ত কয়েকটা খুন করে হাত পাকিয়ে নিয়েছে।

মানুষ মারতে দুলালকে ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামে দুলাল তার হাতের কাজ দেখিয়ে এসেছে। নিজ এলাকায় দুলাল কখনো এ অপরাধ করে না। যদিও এলাকার মানুষজন তার সঙ্গে দেখা হলে কৌতূহলী দৃষ্টি দেয়। তাকে নিয়ে কানাঘুষা করে। এদিকে পুলিশও প্রমাণের অভাবে দুলালকে আইনের আওতায় আনতে পারছে না।

দুলালকে বরাবরই বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ভাড়া করে নিয়ে গেছে মানুষ খুনের জন্য। এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার, স্কুলের হেডমাস্টারসহ অনেকেই দুলালকে দিয়ে তাদের পথের কাঁটা দূর করিয়েছে।

দুলাল এবার কন্ট্রাক্ট পেয়েছে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায়। কুলাউড়ার তেলিবিল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রমিজ আলী দুলালকে ভাড়া করেছেন তারই স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক চন্দ্রনাথ বাবুকে মেরে ফেলার জন্য। রমিজ আলীর ইচ্ছা ছিল তার ভাগনেকে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে স্কুলে ঢুকিয়ে দেবেন। কিন্তু চন্দ্রনাথ বাবুর যোগ্যতা বেশি থাকায় স্কুলের গভর্নিং বডি রমিজ আলীর ভাগনেকে বাদ দিয়ে দেয়। সেদিন থেকে রমিজ আলীর মনে বেজায় ক্ষোভ। তিনি পণ করেছেন, যেভাবেই হোক তার ভাগনেকে এই স্কুলে চাকরিতে ঢোকাবেনই। রমিজ আলী চন্দ্রনাথ বাবুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র শুরু করেন। ক্লাসে ঠিকমতো পড়ান না, স্কুল ফাঁকি দেন, দেরিতে স্কুলে আসেন ইত্যাদি বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে চন্দ্রনাথ বাবুকে ফাঁসানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কারণ, বিজ্ঞান পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীরা আগের বছরের চেয়ে ভালো রেজাল্ট করে। রমিজ আলী শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলেন এই পথের কাঁটাকে চিরদিনের জন্য সরিয়ে দেবেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নান্দাইলের দুলাল শিকদারের সন্ধান পেয়ে তাকে ভাড়া করলেন চন্দ্রনাথ বাবুকে খুন করার জন্য।

দুলালের একটা বৈশিষ্ট্য হলো সে যে মানুষটিকে খুন করে, তাকে বলে দেয় যে কে তাকে খুন করার জন্য পাঠিয়েছে। দুলাল শিকদারের খুন করার তরিকাও ভিন্ন। চন্দ্রনাথ বাবুর বাড়িতে ঠিক এশার নামাজের পরে গিয়ে দুলাল উপস্থিত হয়। ঘরের ভেতরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলে আমি নান্দাইলের দুলাল। আমাকে তোমার স্কুলের হেডমাস্টার পাঠিয়েছেন তোমাকে মেরে ফেলার জন্য। আমি তোমাকে খুন করতে এসেছি। বলেই ব্যাগ থেকে একটি ছুরি বের করে হাতে নেয়।

ঘরের সবাই কান্নাকাটি শুরু করলে দুলাল বলে, কেউ কান্নাকাটি কিংবা চিল্লাচিল্লি করবে না। বাইরে আমার আরও চার–পাঁচজন লোক বাড়ি ঘিরে আছে। কোনো রকম আওয়াজ বাইরে গেলে ঘরের সবাইকে মেরে ফেলব। তবে যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, তাহলে আমার কথামতো কাজ করতে হবে। চন্দ্রনাথ বাবু যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। বললেন, বলেন কী করতে হবে। আমি আপনার সব কথা শুনব।

—ঘরে টাকাপয়সা–সোনাদানা যা আছে সব নিয়ে এসো। কথামতো ঘরের সব টাকা ও সোনা এনে দুলালের হাতে দিলেন চন্দ্রনাথ বাবু।

—আমার ভীষণ খিদে লেগেছে। ঘরে ডিম থাকলে ভাজি করে দেন আর সঙ্গে দুইটা শুকনো মরিচ পুড়িয়ে দেবেন।

চন্দ্রনাথ বাবুর স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে গরম ভাত আর ডিম ভাজি করে দুলালকে খেতে দিলেন। ভাত খাওয়ার পর দুলাল জর্দা দিয়ে পান খেলো। এরপর একটা সিগারেট ধরিয়ে চন্দ্রনাথ বাবুকে বলল, টর্চ লাইট নিয়ে আসেন আমারে আপনার বাড়ির রাস্তার মাথা পর্যন্ত এগিয়ে দেন। দুলালকে নিয়ে চন্দ্রনাথ বাবু বের হয়ে গেলেন তাকে এগিয়ে দিতে।

নিশ্চুপ অন্ধকার রাস্তা, আশপাশের ঘরবাড়ির মানুষজন ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাড়ির রাস্তার মাথায় যাওয়ার আগেই দুলাল ছোরা বসিয়ে দেয় চন্দ্রনাথ বাবুর বুকে। চন্দ্রনাথ বাবু ঢলে পড়েন রাস্তার পাশে। আর ঘরে ফিরে আসতে পারলেন না। দুলাল শিকদার চন্দ্রনাথ বাবুর হাতের টর্চ লাইটটি নিয়ে সিগারেটের বাকি অংশ টানতে টানতে নান্দাইলের উদ্দেশে রওনা দিল।

কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করে এসে দুলালের মেজাজ ফুরফুরে। হাতে টাকাপয়সা অনেক। নান্দাইলের নরসুন্দা নদীর পাড়ে বার্ষিক মেলা বসেছে। সন্ধ্যার পর পালাগানের আসর হবে। আক্কাস বয়াতির দল আসবে। দুলাল গান শুনতে মেলায় গেল।

কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে গানের আসর থেকে দুলাল শিকদারকে গ্রেপ্তার করল। পুলিশ দুলালকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। মেলায় আগত মানুষ সেই দৃশ্য অবাক হয়ে দেখছে। এই সময় পেছনে পালাগানের আসর থেকে গান ভেসে আসে—

‘তুমি হাকিম হইয়া হুকুম করো, পুলিশ হইয়া ধরো

সর্প হইয়া দংশন করো ওঝা হইয়া ঝাড়ো...’

কয়েক মাস পর দুলালের বউ একটি পুত্রসন্তান জন্ম দেয়। দুলাল গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুলালের সঙ্গে তার বাড়ি থেকে কেউ আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি। সবাই ধরে নিয়েছে দুলালের নিশ্চিত ফাঁসি হয়ে যাবে। দুলাল কোথায় কোন হাজতে আছে কেউ কিছু জানে না। দুলাল ফিরে আসবে না ভেবে দুলালের বউয়ের সঙ্গে দুলালের ভাই আলালের বিয়ে দিয়ে দেয় পরিবার। দুলালের ছেলে আলালের ঘরে বড় হতে থাকে।

ময়মনসিংহ জেলে কিছুদিন রাখার পর দুলালকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। খুন–ডাকাতির অনেকগুলো মামলা হয় দুলালের বিরুদ্ধে। সব মামলায় দুলালের সর্বমোট বিয়াল্লিশ বছরের সাজা হয়। চাক্ষুষ সাক্ষী না থাকায় দুলাল মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেয়ে যায়। কারাগারে দুলালকে জল্লাদ হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং তাকে বলা হয়, প্রতিটি ফাঁসি কার্যকর বাবদ তার দুই মাসের সাজা কমিয়ে দেওয়া হবে। দুলাল রাজি হয়। আসামি দুলাল জেলখানার বর্তমান জল্লাদের কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়ে বনে যায় জল্লাদ দুলাল শিকদার।

জল্লাদ দুলাল শিকদার তার কারাগার–জীবনে বহু আসামির ফাঁসি দেয়। সাধারণ খুনের আসামি থেকে শুরু করে অনেক নামীদামি ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের ফাঁসি সে তার নিজ হাতে সম্পন্ন করে। ফাঁসি দেওয়া ও অন্যান্য কারণে জল্লাদ দুলালের সাজা কমে বত্রিশ বছর হয়ে যায়।

বত্রিশ বছর জেল খাটার পর জল্লাদ দুলাল শিকদারের কাল মুক্তি। আজ রাতে দুলাল তার শেষ ফাঁসি সম্পন্ন করবে। ফাঁসির আসামি একজন তিরিশ–পঁয়ত্রিশ বছরের যুবক, যাকে খুন ও ডাকাতির কারণে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে।

এই প্রথম ফাঁসি দিতে দুলালের হাত কাঁপল। যুবকটির জন্য তার মায়া লাগল। জল্লাদজীবনের শেষ ফাঁসি বলেই কি এমন হচ্ছে দুলালের? অবশেষে রাতে সময়মতো ফাঁসি সম্পন্ন হলো।

মুক্ত হয়ে সকালে বাসে করে বাড়ির দিকে রওনা দেয় দুলাল। রাতে ফাঁসিতে মারা যাওয়া সেই যুবকটির লাশও অ্যাম্বুলেন্সে করে সকালবেলা রওনা হয় তার বাড়ির দিকে। দুজনের গন্তব্য ময়মনসিংহের নান্দাইল, একই বাড়িতে।

দুলালের বাসকে পেছনে ফেলে যুবকের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছে যায় বাড়িতে। দুলাল নান্দাইল এসে পৌঁছে সন্ধ্যায়। বছর ঘুরে আবারও নরসুন্দা নদীর পাড়ে মেলা বসেছে। সঙ্গে আছে পালাগান। মেলার পাশ দিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় দুলালের মনে পড়ে যায় প্রায় তিন দশক আগে এই মেলা থেকেই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছিল।

বাড়ি পৌঁছে দেখে উঠানে মানুষের ভিড়। ভিড় ঠেলে সামনে গেলে দেখে খাটিয়ায় শোয়ানো একটি লাশ। দুলালকে দেখে তার ভাই আলাল অবাক ও বিস্মিত হয়! কাছে এসে বলে, ভাই, তুমি বেঁচে আছো?

দুলাল জিজ্ঞেস করে কে মারা গেছে? এ লাশ কার?

আলাল বলে, ভাই এ তোমার ছেলে জালালের লাশ। খুন ও ডাকাতি মামলায় ফাঁসির আদেশের পর কাল রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তোমার ছেলের ফাঁসি হয়। আজ তার লাশ এসেছে। দুলালের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। চোখ ছলছল করে উঠল। বাক্‌রুদ্ধ হয়ে গেল। কারাগারে দুলালের দেওয়া শেষ ফাঁসি যে তার নিজের ছেলের ছিল! অবশেষে নিজ হাতে সে তার ছেলেকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সাজামুক্ত হয়ে ফিরে এসেছে!

নরসুন্দার পাড়ে মেলা জমে উঠেছে। বয়াতিরা গান ধরেছেন—

‘আমার পাগলা ঘোড়া রে

কইর মানুষ কই লইয়া যাস’

*লেখক: অপু ইসলাম, লন্ডন, যুক্তরাজ্য