রাজকুমারী হাসে-হিমে
বহু বহু বছর আগে, জাপানের প্রাচীন রাজধানী নারাতে প্রিন্স টয়োনারি ফুজিয়ারা নামের এক জ্ঞানী রাজমন্ত্রী বাস করতেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল প্রিন্সেস মুরাসাকি (বেগুনি), যিনি ছিলেন এক মহৎ, গুণী ও সুন্দরী নারী। জাপানি প্রথা অনুসারে, খুব অল্প বয়সে নিজ নিজ পরিবারের দ্বারা তাঁদের বিবাহ হয়েছিল এবং তার পর থেকে তাঁরা সুখে–শান্তিতে বসবাস করছিলেন। তবে তাঁদের একটা গভীর দুঃখের কারণ ছিল—বহু বছর কেটে গেলেও তাঁদের কোনো সন্তান হয়নি। এটি তাঁদের অত্যন্ত ব্যথিত করত। কারণ, তাঁরা দুজনেই নিজেদের একটি সন্তানের মুখ দেখতে চাইতেন, যে তাঁদের বার্ধক্যে আনন্দ দেবে, পারিবারিক নাম রক্ষা করবে এবং তাঁদের মৃত্যুর পরে পূর্বপুরুষদের আরাধনার রীতিনীতি বজায় রাখবে।
দীর্ঘ আলোচনা ও চিন্তাভাবনার পর প্রিন্স এবং তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী, হাসে-নো-কাওননের (হাসের করুণার দেবী) মন্দিরে তীর্থযাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ, তাঁদের ধর্মের সুন্দর ঐতিহ্য অনুসারে তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে করুণার দেবী কাওনন মানুষের প্রার্থনা পূরণ করতে তাঁদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় রূপটি নিয়ে আবির্ভূত হন। নিশ্চয়ই এত বছরের প্রার্থনার পর এই বিশেষ তীর্থযাত্রার উত্তরে তিনি তাঁদের কাছে একটি প্রিয় সন্তানের রূপে আসবেন। কারণ, এটাই ছিল তাঁদের দুজনের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। জীবনের আর সবকিছুই তাঁদের ছিল, কিন্তু হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থাকায় সবকিছুই অর্থহীন মনে হতো।
তাই প্রিন্স টয়োনারি এবং তাঁর স্ত্রী হাসে-নো–কাওননের মন্দিরে গেলেন এবং দীর্ঘকাল সেখানে অবস্থান করলেন। তাঁরা প্রতিদিন ধূপ নিবেদন করে স্বর্গীয় জননী কাওননের কাছে তাঁদের সারা জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য প্রার্থনা করতেন। এবং তাঁদের প্রার্থনা পূর্ণ হলো।
অবশেষে প্রিন্সেস মুরাসাকির একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হলো, এবং তাঁর হৃদয়ে অপার আনন্দ হলো। শিশুটিকে স্বামীর কাছে উপস্থাপন করার পর তাঁরা দুজনে মিলে তার নাম রাখলেন হাসে-হিমে, বা ‘হাঁসের রাজকুমারী’। কারণ, সে ছিল সেই স্থানের কানন দেবীর দান। তাঁরা উভয়েই তাকে অত্যন্ত যত্ন ও স্নেহ দিয়ে লালন-পালন করলেন এবং মেয়েটি স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যে বেড়ে উঠতে লাগল।
যখন ছোট মেয়েটির বয়স পাঁচ বছর, তখন তার মা মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং কোনো ডাক্তার বা ওষুধ তাঁকে বাঁচাতে পারল না। শেষনিশ্বাস ত্যাগের কিছুক্ষণ আগে, তিনি তাঁর মেয়েকে কাছে ডাকলেন এবং আলতো করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন: ‘হাসে-হিমে, তুমি কি জানো, তোমার মা আর বেশি দিন বাঁচবেন না? যদিও আমি মারা যাচ্ছি, তোমাকে অবশ্যই একজন ভালো মেয়ে হয়ে বড় হতে হবে। তোমার ধাত্রী বা পরিবারের অন্য কাউকে কোনো কষ্ট না দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। সম্ভবত তোমার বাবা আবার বিয়ে করবেন এবং কেউ একজন তোমার মায়ের স্থান নেবে। যদি তাই হয়, তবে আমার জন্য দুঃখ করো না, বরং তোমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীকে তোমার প্রকৃত মা হিসেবে দেখবে এবং তাঁর ও তোমার বাবার প্রতি বাধ্য ও কর্তব্যপরায়ণ হবে। মনে রাখবে, যখন তুমি বড় হবে, তখন যাঁরা তোমার ঊর্ধ্বতন, তাঁদের প্রতি বিনীত হবে এবং যাঁরা তোমার অধীন, তাঁদের প্রতি সদয় হবে। এটা ভুলে যেও না। তুমি একজন আদর্শ নারী হিসেবে বড় হবে—এই আশা নিয়ে আমি বিদায় নিচ্ছি।’
হাসে-হিমে তাঁর মায়ের কথাগুলো অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে শুনলেন এবং তাঁকে বলা সবকিছু করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। একটি প্রবাদ আছে, ‘তিন বছর বয়সে আত্মা যেমন, একশ বছর বয়সেও তেমন’ (অর্থাৎ, ছোটবেলার স্বভাব আমৃত্যু থাকে), এবং সেই অনুসারে হাসে-হিমে তাঁর মায়ের ইচ্ছানুযায়ী একজন ভালো ও বাধ্য রাজকুমারী হিসেবে বড় হয়ে উঠলেন, যদিও তখন তিনি তাঁর মায়ের হারানোর কষ্ট বোঝার জন্য খুব ছোট ছিলেন।
প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর কিছুদিন পর, প্রিন্স টয়োনারি আবার বিবাহ করলেন প্রিন্সেস তেরুতে–কে। দুঃখের বিষয় হলো, তিনি স্বভাবের দিক থেকে গুণী ও জ্ঞানী প্রিন্সেস মুরাসাকির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিলেন। প্রিন্সেস তেরুতের হৃদয় ছিল নিষ্ঠুর ও মন্দ। তিনি তাঁর সৎ-কন্যাকে একেবারেই ভালোবাসতেন না এবং ছোট মা-হারা মেয়েটির প্রতি খুব খারাপ ব্যবহার করতেন; নিজের মনে বলতেন—‘এ আমার সন্তান নয়! এ আমার সন্তান নয়।’
কিন্তু হাসে-হিমে সব নির্দয়তা ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করতেন, এমনকি তাঁর সৎমায়ের সেবা করতেন ও সব দিক দিয়ে তাঁকে মান্য করে চলতেন এবং কখনো কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতেন না, ঠিক যেমনটি তাঁকে তাঁর নিজের ভালো মা শিখিয়েছিলেন। ফলে লেডি তৈরিতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কোনো সুযোগ পেতেন না।
ছোট রাজকুমারীটি খুব মনোযোগী ছিলেন এবং তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল সংগীত ও কবিতা। তিনি প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা অনুশীলন করতেন এবং তাঁর বাবা কোটো (জাপানি, বিনা), চিঠি লেখা ও কবিতা রচনার শিল্প শেখানোর জন্য সেরা শিক্ষকদের নিযুক্ত করেছিলেন। যখন তাঁর বয়স ১২ বছর, তিনি এতটাই সুন্দরভাবে কোটো বাজাতে পারতেন যে তাঁকে ও তাঁর সৎমাকে সম্রাটের সামনে বাজানোর জন্য রাজদরবারে তলব করা হয়েছিল।
সেটি ছিল চেরি ফুলের উৎসব এবং রাজদরবারে বিশাল উৎসবের আয়োজন চলছিল। সম্রাট সেই উৎসবের আনন্দ উপভোগ করতে আগ্রহী ছিলেন এবং নির্দেশ দিলেন যে প্রিন্সেস হাসে যেন তাঁর সামনে কোটো বাজান এবং তাঁর মা, প্রিন্সেস তেরুতে যেন বাঁশিতে তাঁর সংগত করেন।
সম্রাট একটি উঁচু মঞ্চে বসেছিলেন, যার সামনে সূক্ষ্মভাবে কাটা বাঁশ ও বেগুনি ঝালরযুক্ত একটি পর্দা ঝোলানো ছিল, যাতে তাঁর মহামান্য সবকিছু দেখতে পান, কিন্তু তাঁকে দেখা না যায়; কারণ, কোনো সাধারণ প্রজার পবিত্র মুখ দর্শন করার অনুমতি ছিল না।
হাসে-হিমে এত কম বয়সেও একজন দক্ষ সংগীতশিল্পী ছিলেন, এবং প্রায়শই তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও প্রতিভা দিয়ে তাঁর শিক্ষকদের অবাক করে দিতেন। এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে তিনি খুব ভালোভাবে কোটো বাজালেন। কিন্তু তাঁর সৎমা প্রিন্সেস তেরুতে একজন অলস নারী ছিলেন এবং প্রতিদিন অনুশীলন করার কষ্ট করতেন না; তাই তিনি তাঁর সংগত বাজাতে গিয়ে থেমে গেলেন এবং রাজদরবারের একজন নারীকে তাঁর স্থান নিতে অনুরোধ করতে হলো।
এটি ছিল এক বিরাট অপমান এবং তিনি চরম ঈর্ষান্বিত হলেন যে তাঁর সৎকন্যা যেখানে সফল হলো, তিনি সেখানে ব্যর্থ হলেন। পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে, সম্রাট রাজবাড়িতে এত সুন্দরভাবে বাজানোর পুরস্কারস্বরূপ ছোট রাজকুমারীকে অনেক সুন্দর উপহার পাঠালেন।
প্রিন্সেস তেরুতে তাঁর সৎকন্যাকে ঘৃণা করার আরও একটা কারণ ছিল, সেটা হলো তাঁর সৌভাগ্যক্রমে এক পুত্রসন্তান হয়েছিল এবং তিনি মনে মনে বারবার বলতেন—‘যদি হাসে-হিমে এখানে না থাকত, তবে আমার পুত্র তার বাবার সব ভালোবাসা পেত?’
এবং যেহেতু তিনি কখনো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখেননি, তাই এই দুষ্ট চিন্তাটি তাঁর সৎকন্যার জীবন নেওয়ার ভয়ংকর আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হলো।
তাই এক দিন তিনি গোপনে কিছু বিষের ব্যবস্থা করলেন এবং কিছু মিষ্টি পানীয়তে সেই বিষ মিশিয়ে দিলেন। এই বিষ মেশানো পানীয় তিনি একটি বোতলে রাখলেন। একই ধরনের অন্য একটি বোতলে তিনি ভালো পানীয় রাখলেন। সেটা ছিল ৫ মে-এর বালক উৎসবের দিন, এবং হাসে-হিমে তাঁর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে খেলছিলেন। তাঁদের বীর যোদ্ধাদের খেলনাগুলো সব ছড়ানো ছিল এবং হাসে-হিমে তাঁকে সেই প্রতিটি খেলনা সম্পর্কে চমৎকার গল্প শোনাচ্ছিলেন। তাঁরা উভয়েই খুব আনন্দ করে এবং হাসতে হাসতে সময় কাটাচ্ছিলেন, এমন সময় তাঁদের মা দুটি বোতল পানীয় এবং কিছু সুস্বাদু পিঠা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন।
‘তোমরা দুজনেই এত ভালো আর খুশি আছো’, দুষ্ট প্রিন্সেস তেরুতে হেসে বললেন, ‘আমি তোমাদের পুরস্কার হিসেবে কিছু মিষ্টি পানীয় নিয়ে এসেছি—আর এই নাও, আমার ভালো বাচ্চাদের জন্য কিছু চালের পিঠা।’ এবং তিনি ভিন্ন ভিন্ন বোতল থেকে দুটি পানপাত্র ভর্তি করলেন। হাসে-হিমে, তাঁর সৎমা যে এমন ভয়ানক কাজ করছেন, সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণাও না করে, পানীয়ের একটি কাপ নিলেন এবং অন্য কাপটি তাঁর ছোট সৎ-ভাইকে দিলেন, যা তার জন্য ঢালা হয়েছিল।
দুষ্ট মহিলাটি বিষ মেশানো বোতলটি সতর্কতার সঙ্গে চিহ্নিত করেছিলেন, কিন্তু ঘরে আসার সময় তিনি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন এবং তাড়াহুড়ো করে পানীয় ঢালার সময় অজান্তেই বিষযুক্ত কাপটি নিজের সন্তানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এই পুরো সময় ধরে তিনি উদ্বেগ নিয়ে ছোট রাজকুমারীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন, কিন্তু তাঁর অবাক লাগল মেয়েটির মুখে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। হঠাৎ ছোট ছেলেটি চিৎকার করে উঠল এবং যন্ত্রণায় কুঁকড়ে মেঝেতে পড়ে গেল। তার মা দ্রুত তার কাছে ছুটে গেলেন, ঘরে আনা পানীয়ের দুটি ছোট পাত্রই সতর্কতার সঙ্গে দেখলেন। পরিচারকেরা ডাক্তারের জন্য ছুটে গেল, কিন্তু কেউ শিশুটিকে বাঁচাতে পারল না—এক ঘণ্টার মধ্যেই সে তার মায়ের কোলে মারা গেল। সেই প্রাচীনকালে ডাক্তাররা খুব বেশি কিছু জানতেন না, তাই মনে করা হয়েছিল যে পানীয়টি ছেলেটির সহ্য হয়নি, যার কারণে তার খিঁচুনি হয়েছিল এবং সে মারা গিয়েছিল।
এভাবে দুষ্ট মহিলাটি তাঁর সৎকন্যাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করার সময় নিজের সন্তানকে হারিয়ে শাস্তি পেলেন। কিন্তু নিজের ওপর দোষারোপ করার পরিবর্তে, তিনি তাঁর হৃদয়ের তিক্ততা ও কষ্টে হাসে-হিমেকে আরও বেশি ঘৃণা করতে শুরু করলেন এবং তাঁকে ক্ষতি করার সুযোগ খুঁজতে লাগলেন। তবে সেই সুযোগ আসতে অনেক দেরি হয়েছিল। যখন হাসে-হিমের বয়স তেরো বছর, তখন তিনি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট গুণসম্পন্ন একজন কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। প্রাচীন জাপানের নারীদের মধ্যে এই গুণটি খুব চর্চিত ও অত্যন্ত সম্মানিত ছিল।
তখন ছিল নারাতে বর্ষাকাল এবং প্রতিদিন আশেপাশে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির খবর আসছিল। রাজপ্রাসাদের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া তাত সুতা নদী কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং সংকীর্ণ পথ ধরে জলের গর্জনময় স্রোতের আওয়াজ দিনরাত সম্রাটের বিশ্রামে এমনভাবে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল যে এর ফলস্বরূপ তাঁর গুরুতর স্নায়বিক অসুস্থতা দেখা দিল। সব বৌদ্ধমন্দিরে রাজকীয় ফরমান পাঠানো হলো, যেখানে পুরোহিতদের নির্দেশ দেওয়া হলো যেন তাঁরা বন্যা থামানোর জন্য স্বর্গের কাছে অবিরাম প্রার্থনা করেন। কিন্তু এতে কোনো ফল হলো না।
তখন রাজদরবারের মহলে ফিসফিস করে কথা শুরু হলো—কোর্টের দ্বিতীয় মন্ত্রী প্রিন্স টয়োনারি ফুজিওয়ারার কন্যা প্রিন্সেস হাসে, এত কম বয়সেও এই সময়ের সবচেয়ে প্রতিভাবান কবি এবং তাঁর শিক্ষকেরাও এই খবর নিশ্চিত করলেন। বহু আগে, একজন সুন্দরী ও প্রতিভাবান কুমারী কবি কবিতা দিয়ে প্রার্থনা করে স্বর্গকে প্রভাবিত করেছিলেন এবং খরায় জর্জরিত দেশে বৃষ্টি নামিয়েছিলেন, যেমনটি কবি ওনো-নো-কোমাচির প্রাচীন জীবনীকারেরা বলেছিলেন। যদি প্রিন্সেস হাসে একটি কবিতা লিখে প্রার্থনা হিসাবে নিবেদন করেন, তবে কি বন্যা বন্ধ হবে না এবং সম্রাটের অসুস্থতার কারণ দূর হবে না? রাজদরবারের এই কথা শেষ পর্যন্ত সম্রাটের কানে পৌঁছাল এবং তিনি এই মর্মে মন্ত্রী প্রিন্স টয়োনারিকে একটি আদেশ পাঠালেন।
তাঁর বাবা যখন তাঁকে ডেকে পাঠালেন এবং তাঁর কাছে কী চাওয়া হয়েছে, তা বললেন, তখন হাসে-হিমের ভয় ও বিস্ময় ছিল সীমাহীন। তাঁর তরুণ কাঁধে যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল, তা ছিল সত্যিই গুরুতর—তাঁর কবিতার গুণের মাধ্যমে সম্রাটের জীবন রক্ষা করা। অবশেষে সেই দিন এল এবং তাঁর কবিতা লেখা শেষ হলো। এটি সোনার গুঁড়ো দিয়ে ভারিভাবে ছেটানো কাগজের একটি পাতায় লেখা হয়েছিল। তাঁর বাবা, পরিচারক এবং কিছু রাজকর্ম কর্তার সঙ্গে তিনি গর্জনরত নদীর তীরে গেলেন এবং তাঁর হৃদয়কে স্বর্গের দিকে তুলে ধরে, তিনি তাঁর রচিত কবিতাটি জোরে পড়লেন, দুই হাত দিয়ে সেটি স্বর্গের দিকে তুললেন।
আশপাশের সবার কাছে এটি সত্যিই অদ্ভুত মনে হলো। তাঁর প্রার্থনার সরাসরি উত্তর দিয়ে নদীর জল তার গর্জন বন্ধ করল এবং নদী শান্ত হলো। এরপরে সম্রাট শিগগিরই সুস্থ হয়ে উঠলেন।
সম্রাট এই কাজে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন ও তাঁকে রাজপ্রাসাদে ডেকে পাঠালেন এবং তাঁকে বিশেষ সম্মান দিতে চিন জো—অর্থাৎ লেফটেন্যান্ট-জেনারেলের পদে পুরস্কৃত করলেন। সেই সময় থেকে তাঁকে চিন-হিমে বা লেফটেন্যান্ট-জেনারেল রাজকুমারী বলা হতো এবং তিনি সবার দ্বারা সম্মানিত ও ভালোবাসার পাত্রী হয়েছিলেন।
হাসে-হিমের এই সাফল্যে খুশি হননি কেবল একজনই। তিনি ছিলেন তাঁর সৎমা। সৎকন্যাকে বিষ দেওয়ার চেষ্টা করার সময় নিজের সন্তানকে হারানোর শোকে তিনি সর্বদা আচ্ছন্ন থাকতেন; এর মধ্যে রাজকীয় অনুগ্রহ এবং পুরো দরবারের প্রশংসায় তাঁর সৎকন্যার ক্ষমতা ও সম্মানের উত্থান দেখে তাঁর যন্ত্রণা আরও বাড়ল। তাঁর হিংসা ও বিদ্বেষ আগুনের মতো হৃদয়ে জ্বলতে থাকল। তিনি হাসে-হিমে সম্পর্কে অনেক মিথ্যা কথা তাঁর স্বামীকে শোনাতেন, কিন্তু সবই বৃথা যেত। তিনি তাঁর কোনো কথাই শুনতেন না, বরং কড়াভাবে বলতেন যে তাঁর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।
অবশেষে সৎমা তাঁর স্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাঁর একজন পুরোনো ভৃত্যকে আদেশ দিলেন যে সে যেন সেই নিরীহ মেয়েটিকে দেশের সবচেয়ে বন্য অঞ্চল হিবরি পর্বতমালায় নিয়ে গিয়ে সেখানে তাঁকে হত্যা করে। তিনি ছোট রাজকুমারী সম্পর্কে একটি ভয়ংকর গল্প বানালেন, বললেন যে এই অপমানের হাত থেকে পরিবারকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হলো তাঁকে হত্যা করা।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
ভৃত্য তাঁর কর্ত্রীর আদেশ মানতে বাধ্য ছিল। তবে সে দেখল যে রাজকুমারীর বাবার অনুপস্থিতিতে আদেশ মান্য করার ভান করাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে, তাই সে হাসে-হিমেকে একটি পালকিতে বসিয়ে বন্য অঞ্চলের সবচেয়ে নির্জন স্থানে নিয়ে গেল। অসহায় মেয়েটি বুঝতে পারলেন যে তাঁকে এই অদ্ভুতভাবে দূরে পাঠিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তাঁর নিষ্ঠুর সৎমায়ের কাছে প্রতিবাদ করে কোনো লাভ হবে না, তাই তিনি যেভাবে বলা হয়েছিল, সেভাবেই গেলেন।
কিন্তু বৃদ্ধ ভৃত্যটি জানত যে রাজকুমারীর সৎমা তাঁর অযৌক্তিক আদেশের কারণ হিসেবে যেসব কথা বানিয়েছিলেন, তার সব থেকেই মেয়েটি সম্পূর্ণ নির্দোষ। তাই সে তার জীবন বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিল। তবে তাঁকে হত্যা না করলে সে তার নিষ্ঠুর কর্ত্রীর কাছে ফিরতে পারত না, তাই সে সেই নির্জন স্থানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিল। কিছু কৃষকের সহায়তায় সে শিগগিরই একটি ছোট কুটির তৈরি করল এবং গোপনে তার স্ত্রীকে আসতে বলে, এই দুই ভালো বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাদের সাধ্যমতো সেই দুর্ভাগ্যজনক রাজকুমারীর যত্ন নিতে লাগল। হাসে-হিমে সব সময় তাঁর বাবার ওপর আস্থা রাখতেন। কারণ, তিনি জানতেন যে বাবা বাড়ি ফিরে তাঁকে অনুপস্থিত দেখলে অবশ্যই তাঁর খোঁজ করবেন।
কয়েক সপ্তাহ পর, প্রিন্স টয়োনারি বাড়ি ফিরলেন এবং তাঁর স্ত্রী তাঁকে বললেন যে তাঁর কন্যা হিমে কোনো ভুল করেছে এবং শাস্তির ভয়ে পালিয়ে গেছে। তিনি উদ্বেগে প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বাড়ির প্রত্যেকেই একই গল্প বলল—যে হাসে-হিমে হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে, কেন বা কোথায় গেছে, তা কেউই জানে না। দুর্নামের ভয়ে তিনি বিষয়টি গোপন রাখলেন এবং তাঁর পক্ষে সম্ভব সব জায়গায় খোঁজ করলেন, কিন্তু কোনো ফল হলো না।
একদিন নিজের অসহনীয় দুশ্চিন্তা ভোলার চেষ্টা করে, তিনি তাঁর সব লোককে একত্রিত করলেন এবং তাঁদের পাহাড়ে কয়েক দিনের শিকারের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। তারা শিগগিরই প্রস্তুত হয়ে ঘোড়ায় চড়ে তাঁদের প্রভুর জন্য গেটে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি দ্রুতগতিতে হিবরি পর্বতমালা অঞ্চলের দিকে ছুটলেন, তাঁর পেছনে বিশাল এক দল ছিল। তিনি শিগগিরই সবার থেকে অনেক এগিয়ে গেলেন এবং অবশেষে নিজেকে একটি সংকীর্ণ, মনোরম উপত্যকায় খুঁজে পেলেন।
চারপাশে তাকিয়ে দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হওয়ার সময় তিনি কাছেই পাহাড়ের ওপর একটি ছোট ঘর দেখতে পেলেন এবং তারপর তিনি স্পষ্টভাবে একটি সুন্দর, পরিষ্কার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন, যা জোরে জোরে পাঠ করছিল। এত নির্জন স্থানে কে এমন একাগ্রভাবে পড়াশোনা করছে, এই কৌতূহল তাঁকে পেয়ে বসল। তিনি ঘোড়া থেকে নেমে তাঁর ঘোড়সওয়ারের কাছে ঘোড়াটি রেখে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে হেঁটে কুটিরটির কাছে গেলেন। তিনি যত কাছে এলেন, তাঁর বিস্ময় তত বাড়ল। কারণ, তিনি দেখতে পেলেন পাঠক একজন সুন্দরী মেয়ে। কুটিরটির দরজা খোলা ছিল এবং মেয়েটি দৃশ্যপটের দিকে মুখ করে বসেছিল। মনোযোগ দিয়ে শুনে তিনি শুনতে পেলেন যে সে গভীর ভক্তির সঙ্গে বৌদ্ধশাস্ত্র পাঠ করছে। আরও বেশি কৌতূহলী হয়ে তিনি ছোট গেটের দিকে দ্রুত হাঁটলেন এবং ছোট বাগানে প্রবেশ করলেন এবং ওপরে তাকিয়ে দেখলেন তাঁর হারানো কন্যা হাসে-হিমেকে। মেয়েটি তার পাঠে এতটাই মগ্ন ছিল যে তার বাবা কথা না বলা পর্যন্ত সে তাঁকে শুনতে বা দেখতে পায়নি।
‘হাসে-হিমে!’ তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘এ তুমি আমার হাসে-হিমে?’
হঠাৎ এমন চমকে যাওয়ায় সে হয়তো বিশ্বাস করতে পারছিল না যে ‘আমার বাবা, আমার বাবা! সত্যিই আপনি—ওঃ, আমার বাবা!’ এর বাইরে সে আর কিছুই বলতে পারল না, এবং তাঁর দিকে ছুটে গিয়ে বাবার মোটা আস্তিন ধরে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
তার বাবা তার কালো চুলে হাত বুলিয়ে আলতো করে জিজ্ঞেস করলেন যে কী ঘটেছে, কিন্তু সে শুধু কেঁদেই চলল এবং তিনি ভাবলেন যে তিনি কি সত্যিই স্বপ্ন দেখছেন না তো? তখন বিশ্বস্ত বৃদ্ধ ভৃত্য বেরিয়ে এল এবং তার প্রভুর সামনে মাটিতে মাথা নিচু করে অন্যায়ের দীর্ঘ কাহিনিটি বিস্তারিতভাবে জানাল—কী হয়েছিল এবং কীভাবে তিনি তাঁর মেয়েকে এমন বন্য ও জনমানবহীন জায়গায়, মাত্র দুজন পুরোনো ভৃত্যের তত্ত্বাবধানে খুঁজে পেয়েছেন।
প্রিন্সের বিস্ময় ও ক্ষোভের সীমা ছিল না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে শিকার বাতিল করলেন এবং তাঁর মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে গেলেন। দলের একজন দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে বাড়িতে আনন্দ সংবাদ জানাতে গেল। আর সৎমা এই খবর শুনে ও তাঁর কুকর্ম ধরা পড়ায়, স্বামীর মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন এবং অপমানে তাঁর বাবার বাড়িতে ফিরে গেলেন। এরপর আর তাঁর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
বৃদ্ধ ভৃত্য তার প্রভুর চাকরিতে সর্বোচ্চ পদোন্নতি পেল এবং তার শেষ দিন পর্যন্ত সুখে বসবাস করল; ছোট রাজকুমারীর প্রতি সে ছিল নিবেদিতপ্রাণ। প্রিন্স টয়োনারির কোনো পুত্র না থাকায়, তিনি রাজদরবারের এক অভিজাত ব্যক্তির ছোট ছেলেকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে এবং তাঁর কন্যা হাসে-হিমের সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার জন্য দত্তক নিলেন। কয়েক বছরের মধ্যে তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হলো। হাসে-হিমে দীর্ঘকাল বেঁচে ছিলেন এবং সবাই বলতেন যে তিনি ছিলেন প্রিন্স টয়োনারির প্রাচীন বাড়িতে রাজত্ব করা সবচেয়ে জ্ঞানী, সবচেয়ে ধার্মিক এবং সবচেয়ে সুন্দরী কর্ত্রী। সক্রিয় জীবন থেকে অবসর নেওয়ার ঠিক আগে তিনি তাঁর পুত্র, যিনি ভবিষ্যতে পরিবারের প্রভু হবেন, তাঁকে বাবার সামনে উপস্থাপন করার আনন্দ পেয়েছিলেন।
আজও কিয়োটোর একটি বৌদ্ধ মন্দিরে সূচিকর্মের একটি নমুনা সংরক্ষিত আছে। এটি পদ্মের কাণ্ড থেকে টানা সিল্কি সুতো দিয়ে বুদ্ধের চিত্র এমব্রয়ডারি করা একটি সুন্দর নকশি। বলা হয় যে এটিই সেই গুণী প্রিন্সেস হাসে-র হাতের কাজ ছিল।