বাবাদের কার্পণ্য!

অলংকরণ: আরাফাত করিম

সারা দিন রোজা রেখে ইফতার শেষে একটু চাঙা হতে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে পরিবারের সবাই বৈঠকখানায় গল্পে মত্ত। আলোচনার বিষয় ঈদবাজার! বাইরে ভ্যাপসা গরম, যখন-তখন বৃষ্টির হানা, শপিং মলে বাজে রকম ভিড়—এসব সাতপাঁচ চিন্তা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত হলো সবাই মিলে ঈদের কেনাকাটায় বের হব। ঠিক করা হচ্ছে, কার জন্য কী কেনা হবে, কোথায় ভালো হবে ইত্যাদি। প্রতিবারের মতো এবারও আব্বার প্রতিবাদস্বরূপ কণ্ঠস্বর ভেসে এল! শোবার ঘর থেকে বের হয়ে বৈঠকখানার দরজায় দাঁড়িয়ে আমাদের উদ্দেশে জানতে চাইলেন, ‘তোমরা কী নিয়ে কথা বলছো?’

বললাম, ‘এই তো আব্বা, ঈদের কেনাকাটা নিয়ে। কার জন্য কী কেনা হবে এসব।’

দৃঢ়ভাবে আমাদের শাসিয়ে বললেন, ‘শোনো, তোমাদের সবাইকে বলে দিচ্ছি, আমরা জন্য কেউ কিছু কিনবে না। আলমারি খুলে দেখো, কত কাপড় পড়ে আছে। এগুলো কে পরবে? অনর্থক টাকা নষ্ট করবে না।’

শান্তভাবে বললাম, ‘অনর্থক কেন হবে আব্বা, ঈদে টুকটাক কিছু কিনতে হয়। আমাদেরও তো ইচ্ছা করে কিছু কিনে দিতে।’ যেই বলা সেই উত্তর, ‘আমার কিছু লাগবে না।’—এই বলে হনহন করে অজু করতে চলে গেলেন। একটু পর তারাবিহর নামাজ পড়তে মসজিদে যাবেন। কিন্তু আলমারিতে এতগুলো নতুন পাঞ্জাবি থাকতেও গায়ে জড়াবেন সেই একই পুরোনো মলিন পাঞ্জাবিটা; আর নতুন জুতাগুলো বাক্সবন্দী রেখে, প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া জুতাজোড়াতে পা গলিয়ে রওনা দেবেন। এ নিয়ে যদি কিছু বলা হয়, তাহলে অল্প কথায় উত্তর ‘এগুলোতেই আরাম!’

আচ্ছা সে কথা যাক, ঈদের কেনাকাটা নিয়ে আব্বার এমন প্রতিক্রিয়া আসবে আমরা আগে থেকেই জানতাম, তাই আমরা একজন আরেকজনের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করে যে যার মতো কেনাকাটা করতে চলে গেলাম। যদিও জানি পরবর্তী সময় আব্বার কেনাকাটা নিয়ে হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে—কেন কিনেছ, কত হয়েছে, এটা আমার হচ্ছে না, ফেরত দিয়ে আসো, রসিদ আছে তো! ও খোদা, হাজারটা বায়না—সে এক ইতিহাস! আর এই প্যাঁচালের সম্মুখীন প্রতিবারই হতে হয়, যতবার তাঁকে কিছু কিনে দেওয়া হয় বা কেনাকাটার কোনো উপলক্ষ আসে।

আর যদি সৌভাগ্যক্রমে সঙ্গে নিয়ে কেনাকাটা করতে যাওয়া যায়, আর পছন্দের জিনিসের দাম তাঁর কাছে একটু বেশি মনে হয় তাহলে তো আর কথাই নেই, হাত টেনে ধরে দোকান থেকে বের হয়ে যাবেন। কি মুশকিল! কেন এত কার্পণ্য নিজের বেলায়!

বাবাদের কি কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় না? কোনো শখ–আহ্লাদ কি নেই? কোন মাটি দিয়ে গড়া এসব মানুষ! শুধু নিজেদের বঞ্চিত করতেই ভালোবাসে। আর নিজের সঙ্গেই সব কার্পণ্য। এমন নিঃস্বার্থ হয় কীভাবে? নিজের সব ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে, যেন উজাড় করে দিতে পারাতেই সব আনন্দ।

কিন্তু সন্তানের বেলায় তো ‘বাবা’ মানুষটি এক বিন্দু কার্পণ্য দেখান না। কোথায় থাকে তখন সেই কার্পণ্য? সংসার নামের প্রতিষ্ঠানে সারা জীবন সন্তানদের পেছনেই ব্যয় করেন। জীবনসায়াহ্নে বাকি সঞ্চয়টুকুও সন্তানদের উদ্দেশ্যেই বিলিয়ে দেন। বিনিময়ে শুধু চান, তাঁর সন্তানেরা মানুষের মতো মানুষ হোক। কিন্তু দিন শেষে এই ‘বাবা’ চরিত্রটিকে আমরা কতটুকু মূল্যায়ন করি? তেমন করে কি কখ‌নো চিন্তা করে দেখি? জানতে কি চাই কখনো তাঁদের চাওয়াগুলো?

সেই ভূমিষ্ঠ থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত এতটা পথ চলাতে সন্তানের ভরণ-পোষণ, নিত্যদিনের চাহিদা মেটানো, অসুখে-বিসুখে চিকিৎসা, আর্থিক নিরাপত্তা দান, পরিবারকে সময় দেওয়া, সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে— কখনো কার্পণ্য, ক্লান্তি বা বিরক্তির আভাস পাওয়া যায় না। যদিও আমাদের সময়ে খুব বেশি চাওয়া ছিল না। খুব ছোট থেকেই চাওয়ার মাত্রার সীমারেখা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম, অবচেতনভাবেই সেই মাত্রা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। চাহিদা ছিল কম, কিন্তু কোনো কিছু পাওয়ার আনন্দ ছিল বিশাল।

মার্কিন মুল্লুকে ‘বাবা’ চরিত্রটির সঙ্গে তেমন পরিচিত নই; অতি নিকট থেকেও কখনো প্রত্যক্ষ করা হয়নি। তাই এখানকার ‘বাবা’ চরিত্রটি নিয়ে কিছু বলার অবকাশ নেই। তবে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোগত কারণে ‘বাবা’ একটি মুখ্য চরিত্র। এখানে বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারের মোটামুটি সব ‘বাবা’র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমার বর্ণনামাফিক একই রকম। আমার চারপাশে দেখা সব কটি ‘বাবা’ চরিত্রকে সেই চেহারায় আমি দেখেছি বা দেখছি।

বলা হয়, মেয়েরা নাকি বাবার খুব কাছাকাছি থাকে। বাবা ও মেয়ের সম্পর্ক একটু বেশি মিষ্টি হয়, যার সঙ্গে অন্য কোনো সম্পর্কের তুলনা হয় না। এখনো স্মৃতির পাতায় চোখ রাখলে আবছা দেখতে পাই—আব্বার আঙুল ধরে ভীরু মনে প্রথম স্কুলের গণ্ডিতে পা রাখা; স্কুলে রেখে চলে আসার সময় জড়িয়ে ধরে কপালে একটা আদর দিয়ে বিদায় জানিয়েছিলেন। জানি না, তখন তাঁর মনের অবস্থা কী ছিল! এটা ছিল সন্তানকে প্রথম নিজ আশ্রয় থেকে একটু ছেড়ে দেওয়া। তারপর একদিন অশ্রুসিক্ত নয়নে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিজ আঙিনা থেকে বিদায় জানিয়েছেন। তখন আরেকটু দূরত্ব বাড়ল। আর সেই মেয়ের যদি দূর পরবাসে থাকার ভাগ্য নির্ধারিত হয়, তাহলে আরও অনেক অনেক দূরে চলে আসা হয়! মেয়েদের ক্ষেত্রে বাবার আঙিনা থেকে দিন দিন শুধু এই দূরত্ব বাড়তেই থাকে। অথচ একসময় বাবার কোলেই ছিল সেই মেয়েটির পরম আশ্রয় ও রাজত্ব। যেখানে সব রকম সম্পর্কের বেড়াজাল ও দায়িত্ব থে‌কে সে ছিল মুক্ত।

আজকাল ফোনালাপে ওপার থেকে প্রায়ই আব্বার স্নেহময় কণ্ঠে প্রশ্ন আসে, ‘মা, তুই কবে আসবি, কত দিন দেখি না?’

এপারে আমি...!?

বাবা দিবসে পৃথিবীর সব ‘বাবা’ মানুষটির প্রতি রইল শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।