চালশের গান
‘বয়স আমার মুখের রেখায় শেখায় আজব ত্রিকোণমিতি,
কমতে থাকা চুলের ফাঁকে মাঝবয়সের সংস্কৃতি’
আমাদের কৈশোরে কবির সুমনের গানটা বহুবার শোনা। তখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি গানের কথাগুলো। তবে কবির সুমনের গান তখনকার দিনে সারাক্ষণই ক্যাসেট প্লেয়ারে বেজে চলত। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও বয়স বেড়ে চলল। আমরা কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে উপনীত হলাম। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে আমরা পা রাখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় সেখানে প্রযুক্তির সব অত্যাধুনিক বিষয়গুলো দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় আগেই এসে হাজির হতো। যদিও আমাদের সেকেলে শিক্ষকেরা সেগুলোকে সহজভাবে গ্রহণ করতে চাইতেন না।
সময়ের হাত ধরে এল ইন্টারনেট এবং ইন্ট্রানেট। সব ছাত্ররা মিলে হলে হলে ইন্ট্রানেট চালু করে ফেলল। এতে সহজেই এক হলের সব কম্পিউটার নিজেদের মধ্যে যুক্ত হয়ে গেল। তখন কারও কাছে ভালো ছবি বা গান থাকলেই সেটা শেয়ার দেওয়া হতো। তখন অন্যরাও সহজেই সেটা উপভোগ করতে পারত। তখনো পেনড্রাইভ নামক বস্তু আবিষ্কৃত হয়নি। তাই অন্যান্য হলের বন্ধুদের কাছ থেকে গান বা ছবি আনতে হলে আমরা কম্পিউটারের সিপিইউ খুলে হার্ডডিস্ক নিয়ে চলে যেতাম। সত্যি কথা বলতে, আমাদের সিপিইউর একটা ঢাকনা সব সময় খোলাই থাকত। কারণ, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আমাদের হার্ডডিস্ক নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হতো।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুয়েটের ছেলেদের আড্ডা দেওয়া এবং তাস খেলা মোটামুটি কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অবশ্য তাস খেলাটা ছিল শুধু বিনোদনের উৎস। আর আড্ডা দিয়ে রাত পার করে দেওয়াটা তো ছিল একেবারে ডালভাতের মতো। আর আড্ডার বিষয়বস্তু ছিল পুরোপুরি বারোয়ারি। আর সেখানে কোনো ছোট-বড় ছিল না, ছিল না কোনো রাজনৈতিক বিভক্তিও। সেই দলে যেমন কিছুদিন পর বুয়েট ছেড়ে চলে যাওয়া ছাত্র থাকত, তেমনি কিছুদিন আগে বুয়েটে ভর্তি হয়েছে, সেই ছেলেও থাকত। সবাই মিলে চলত সেই প্রাণপ্রাচুর্যের আড্ডা।
আড্ডাটা শুরু হতো কে কোন নতুন টিউশনি পেয়েছে, সেটা নিয়ে। আমার মনে আছে, তখন ঢাকা শহরে বুয়েটের ছাত্র বলে টিউশনি করত প্রায় ১৫ হাজার ছেলে। কিন্তু সব ব্যাচ মিলিয়ে তখন বুয়েটের ছাত্রসংখ্যা ছিল মাত্র হাজার পাঁচেক। যা-ই হোক, আমাদের টিউশনি ছিল দুই রকম—ছাত্র ও স্টুডেন্ট। সবাই ছাত্রী না বলে স্টুডেন্ট বলে মেয়ে পড়ানোর বিষয়টা বৃথায় লুকানোর চেষ্টা করত। সেই নতুন ছাত্রী দেখতে কেমন, স্যারের প্রতি তার আচার-আচরণ কেমন, ছাত্রীর মা কেমন খাতির করেন—এসব বিষয় নিয়ে নতুন স্টুডেন্ট টিউশনি পাওয়া ছাত্রকে ছেঁকে ধরা হতো। এরপর আড্ডা বিভিন্ন গলিঘুপচি ঘুরে শেষ হতো বাংলাদেশের রাজনীতিতে। আমার ধারণা, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে এত পরিষ্কার ধারণা বাংলাদেশের অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছেলেদের নেই।
যা-ই হোক, আড্ডা দিতে দিতে আর তাস খেলতে অনেক রাত হয়ে যেত। তখন চানখাঁর পুলের মিতালী হোটেলের ডিম-পরোটা বা ঠাঠারীবাজারের স্টার হোটেলের কাচ্চি, নান আর চিকেন টিক্কা দিয়ে নিজেদের রিচার্জ করে নেওয়া হতো। এরপর আবার জমে উঠত আড্ডা। এ ছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষে অন্যদের খাওয়ানোর রেয়াজ ছিল। নতুন টিউশনির প্রথম বেতন পেলেই খাওয়াতে হতো। কারও জন্মদিন পড়েছে, তাকে খাওয়াতে হতো। দেখা যাচ্ছে, যার জন্মদিন, তার পকেটে টাকা নেই। কোনো সমস্যা নেই, বন্ধুরা মিলে টাকা ধার দেওয়া হতো। কিন্তু খাওয়া কোনোভাবেই মিস করা যাবে না। খাবার শেষ করে রেস্তোরাঁর বয়দের আমরা বড় অঙ্কের টিপস দিতাম। তাই আমরা কোথাও খেতে গেলে কে আমাদের সার্ভিস দেবে, সেটা নিয়ে বয়দের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে যেত।
যা-ই হোক, এভাবেই একটা বর্ণিল তারুণ্য আমরা পার করে এসেছি। এখন আমাদের ব্যাচের সবার বয়সই ৪০-এর কোঠা ছাড়িয়ে গেছে। ৪০ পেরিয়ে এসে আজ পেছন ফিরে তাকালে সবকিছুই স্মৃতির পর্দায় ভেসে ওঠে। আমরা বলি, ৪০ থেকে আসলে বয়স নতুন করে গণনা করা হয়। গতবার দেশে গিয়ে এক বান্ধবীর ৪২তম জন্মদিনের উৎসবের কেকে আমি লিখতে বলেছিলাম শুভ দ্বিতীয় জন্মদিন। সেই হিসাবে আমাদের বয়স এখন এক কিংবা দুই কিংবা তিন। কিন্তু শরীরের বয়স ঠিকই বেড়ে গেছে।
এরপর জীবনের নদী বয়ে চলেছে তার আপন গতিতে। বুয়েটের একটা বিশাল জনগোষ্ঠী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে। আমরাও ছড়িয়ে পড়েছি বিশ্বব্যাপী। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতেও আমরা বেশ কিছু বন্ধু এখনো বুয়েটের সেই আড্ডার পুনর্মঞ্চায়ন করি নিয়মিত বিরতিতে। প্রবাসের জীবন চলে ঘড়ির কাঁটা ধরে। তাই সবাইকে একসঙ্গে করা হয়ে উঠে না। তাই আমরা যারা একই বিষয়ে পড়েছিলাম, মানে ক্লাসমেট ছিলাম, তারা অন্ততপক্ষে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগটা ঠিক রাখার চেষ্টা করি। আমরা সিভিলের কিছু বন্ধু তাই নিয়মিত বিরতিতে এখনো বুয়েটের মতোই আড্ডায় মিলিত হই। অবশ্য অন্য বিষয়ের বন্ধুরাও নিয়মিত যোগ দেয় এতে।
আমাদের এ আড্ডার সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক হচ্ছে এর বিষয়বস্তু। আমরা সবাই সবাইকে মোটামুটি সেই বুয়েটজীবন থেকেই চিনি। আর না চিনলেও একই বিষয়ে পড়াতে সবার মধ্যে একটা আলাদা টান আছে। তাই আমাদের আড্ডার ভাষা কখনোই বইয়ের ভাষায় সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং বুয়েটের সেই আদি এবং অকৃত্রিম ভাষা ফিরে আসে বারবার। সেই ভাষা অবশ্য আমরা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখি। কারণ, বাইরের মানুষদের কাছে আমাদের একটা আলাদা দাম আছে। সপ্তাহান্তে এই আড্ডা দিয়ে আমরা যেন পরবর্তী সপ্তাহের জন্য নিজেদের রিচার্জ করে নিই। তাই এই আড্ডার প্রসঙ্গ এলেই আমরা সবকিছু ফেলে নিজেদের একটু একটু সময় দেওয়ার জন্য মুখিয়ে উঠি।
এখন আমাদের প্রায় সবারই সংসার হয়েছে। আছে সন্তানসন্ততি। পাশাপাশি আমাদের স্ত্রীরাও নিজেদের মধ্যে আলাদাভাবে যোগাযোগ রাখে। ফলে আড্ডা দিতে বের হয়ে যাওয়াটা বেশ সহজ হয়ে গেছে। এভাবেই আমরা আড্ডা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বনভোজন, পিঠা উৎসব, একসঙ্গে ইফতার, ঈদ পুনর্মিলনী করে থাকি। আমরা সবাই একই ব্যাচের হওয়াতে আমাদের সন্তানদের বয়সও মোটামুটি কাছাকাছি। ফলে আমাদের আয়োজনগুলোতে বড়রা যেমন আনন্দ নিয়ে যোগ দেয়, ছোটরাও সমান আনন্দ নিয়ে যোগ দেয়। প্রবাসে বাচ্চাদের একটা খুবই সাধারণ অভ্যাস হলো তারা একটু পরপর বলে ওঠে, ‘আই অ্যাম বোরড।’ আমাদের এই ছোট পরিসরের আয়োজনে বাচ্চাগুলো কখনোই এটা বলে না; বরং আয়োজন শেষ করে আমরা যেতে চাইলেও তারা যেতে চায় না।
শরীরের বয়স ৪০ পেরিয়ে গেলে প্রাকৃতিকভাবেই শরীরে কিছু সমস্যা তৈরি হয়। যেমন এখন আমরা চাইলেই আর সহজে রাত জাগতে পারি না। বা রাত জাগলেও পরের দিন ঘুমিয়ে আবার সেটা পুষিয়ে নিতে হয়। আমরা চাইলেই আর আগের মতো দৌড়ঝাঁপ করতেও পারি না। শরীর হাঁপিয়ে যায়। এ ছাড়া শরীরে ছোটখাটো বিভিন্ন রোগের উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করেছে। আর শরীর মুটিয়ে যাওয়া তো এখন অতি সাধারণ ঘটনা। পাশাপাশি আছে পাকস্থলীর সমস্যা। এখন চাইলেই আর আমরা বুয়েটজীবনের মতো উদরপূর্তি করে গলা পর্যন্ত খেতে পারি না। কারণ, পাকস্থলী সেগুলোকে হজম করতে পারে না। ফলে দেখা দেয় উদরাময়ের মতো অসুখও। এখন সবার চোখেই মোটামুটি সাধারণভাবে চালশের সমস্যা দেখা দিয়েছে। তখন মনের মধ্যে আবারও কবির সুমন যেন গেয়ে ওঠেন—
‘আজকে যে বেপরোয়া বিচ্ছু শান্ত সুবোধ হবে কাল সে
চোখের সঙ্গী হবে চশমা চল্লিশ পেরোলেই চালশে’
আমরা বলি, আমরা হচ্ছি বাংলাদেশের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান প্রজন্ম। কারণ, একদিকে প্রযুক্তি এগিয়েছে আর অন্যদিকে এগিয়েছি আমরা। আমাদের ব্যাচ থেকেই মাধ্যমিকে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নপত্র ৫০০-এর বেড়াজাল ছিন্ন করে সারা বইয়ের পাতায় ছড়িয়ে পড়ল এবং আমাদের নৈর্ব্যক্তিক এবং রচনামূলক প্রশ্নপত্রে আলাদাভাবে পাস করতে হয়েছিল। ফলে বিভিন্ন বোর্ডের মাধ্যমিকের ফলাফল হয়েছিল খুবই খারাপ। এরপর আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, তখন কেবল বাজারে মুঠোফোন আসতে শুরু করেছে। এরপর আমরা যখন বুয়েট থেকে পাস করে বের হলাম, তখন মোবাইল কোম্পানিগুলো তাদের নেটওয়ার্ক বাড়াতে শুরু করেছে। তাদের অনেক ইঞ্জিনিয়ার দরকার। পাস করেই আমরা রাতারাতি বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানিতে একগাদা টাকা বেতনে চাকরিতে যোগ দিলাম। আর বাহন হিসেবে সঙ্গে পেলাম সুন্দর সুন্দর গাড়ি এবং ড্রাইভার।
এরপর এল একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় দুর্যোগ—করোনা মহামারি। কত মানুষ মারা গেল। আমাদের পরিচিত অনেক মানুষই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। এমনকি আমাদের সমসাময়িক বন্ধুদের মধ্যেও অনেকেই চিরতরে হারিয়ে গেল আমাদের মধ্যে থেকে। আমরা সবাই মোটামুটি টিকে গেলাম বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই। চল্লিশের পর যেমন আমাদের পুনর্জন্ম হয়েছিল, ঠিক তেমনি করোনা মহামারি যেন আমাদের পুনর্জন্ম দিল। আমরা আরও কিছু বছর যদি বেঁচে থাকি, তাহলে হয়তোবা আমাদের নাতি-নাতনিদের এই মহামারির ভয়াবহতার গল্প বলতে পারব। আমাদের ছোটবেলায় পড়া ‘সবজান্তা দাদুর আসর’ গল্পের মতো বসবে আমাদের আসর। আর আমরা চোখ বড় বড় করে বলব, ‘জানো দাদুভাইয়েরা, সে ছিল এক কঠিন সময়, পৃথিবীতে হাজির হলো করোনা নামের এক মহাদৈত্য।’