শিক্ষাই শক্তি: অমর্ত্য সেন, আদুরী ও স্যার আবেদ ভাইয়ের মুনিরা

অমর্ত্য সেন ও স্যার ফজলে হাসান আবেদ

সময়টা ২০১৩ সাল, নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন তাঁর সতীর্থ অর্থনীতিবিদ জেন ড্রেজসহ যৌথ উদ্যোগে লিখিত ‘অ্যান আনসারটেইন গ্লোরি’ শিরোনামের বইয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের মেয়েদের উন্নয়ন বা অগ্রগতি ভারতের মেয়েদের চেয়ে বেশি। এই উন্নতির পেছনে বেসরকারি সংস্থার ভূমিকা ও অবদানের উল্লেখ রয়েছে ওই বইয়ে।

অমর্ত্য সেন তখনো নোবেল পুরস্কার পাননি। সময়টা ১৯৮৮ সাল, মাস ছিল এপ্রিল। বিখ্যাত এই অর্থনীতিবিদ ঢাকায় এসেছেন। সব অর্থনৈতিক বিধিশৃঙ্খলার (Economic Discipline) লোকজনের মধ্যে ভীষণ ঔৎসুক্য, আনন্দ উত্তেজনা ছিল দেখার মতো। পরবর্তী সময়ে নিজে যখন উন্নয়ন পরিকল্পনা বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম, সেই সময়ে রিডিং লিস্টে অমর্ত্য সেনের নাম দেখেই মুগ্ধ। সে মুহূর্ত থেকে আরও অনেকের মতো আমিও তাঁর পাণ্ডিত্যের জাদুতে আবিষ্ট। নিজের বিদ্যাবুদ্ধি ও সুযোগ–সুবিধার সীমিত গণ্ডি ছাড়িয়ে সময় পেলেই তাঁর কর্মকাণ্ড বুঝতে ও আত্মস্থ করতে চেষ্টা করেছি, ধারণ করতে চেয়েছি। অমর্ত্য সেনের সব কাজে জেন্ডার বিষয়টি অত্যন্ত সুচারুভাবে উপস্থাপিত, যা আমার নিষ্ঠার সঙ্গে বোঝার, ধারণের ও লালনের বিষয়। তখন অ্যাসাইনমেন্ট-পরীক্ষার জন্য উৎকণ্ঠা নিয়ে অমর্ত্য সেন পড়েছি আর এখন পড়ি প্রশান্ত চিত্তে, ভালোবেসে। সেই পণ্ডিত লোকটি যখন আমাদের বাংলাদেশ সর্ম্পকে তাঁর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন, তা দারুণভাবে আমাদের আন্দোলিত করে, আলোড়িত করে।

মুনিরা ব্র্যাক স্কুলে পড়েছে। মুনিরা সচেতন ও আলোকিত। মুনিরার সঙ্গে বাড়ির শিশুরা, চালকেরা ও অন্য কাজের লোকেরা কেউ তুইতুকারি করে না। একজন আত্মীয় ঠাট্টা করে বলেন ‘বাব্বা, মুনিরা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ছাত্রী ছিল, তাই আলাদা খাতির!’

তাঁর পর্যবেক্ষণের বিষয়ে একজন বলেছিলেন, সাক্ষরতায় বাংলাদেশের মেয়েরা যে এগিয়ে, এর পেছনে গ্রামীণ ব্যাংকের ভূমিকা রয়েছে। তবে আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ বাস্তবতা সাক্ষ্য দেয়, গ্রামীণ ব্যাংক নয়, সাক্ষরতার ক্ষেত্রে ব্র্যাকের ভূমিকা ও অবদান অনেক। ব্র্যাকের নন–ফরমাল প্রাইমারি এডুকেশন প্রোগাম বাংলাদেশে শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিরাট এক সাহায্য। অত্যন্ত সফল ব্র্যাকের নন–ফরমাল প্রাইমারি এডুকেশন প্রোগাম বা অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচির মডেল আফ্রিকা ও এশিয়ার কয়েকটি দেশে চালু করা হয়েছে। এ বিষয়ে অনেক কথা বলা যায়, তবে এই পরিসরে নয়। অমর্ত্য সেনের গবেষণালব্ধ পর্যবেক্ষণ আমাদের আনন্দিত করেছে অবশ্যই। তবে ঠিক তার কিছুদিন পরপরই ঢাকা শহরে ছোট্ট গৃহকর্মী আদুরীর ওপর চালানো নির্যাতনের নিমর্ম ঘটনা আমাদের লজ্জিত করেছে, ব্যথিত করেছে। আদুরীর ওপর অমানবিক অত্যাচার অমর্ত্য সেন পর্যবেক্ষিত আমাদের অর্জনের আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে। ভুখা, নির্যাতিতা আদুরীকে ময়লার গাদায় ফেলে দেওয়া হয়। পরে ওখান থেকে উদ্ধার করে আদুরীকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। আদুরীর নিয়োগকর্ত্রী (এমপ্লয়ার) অবশ্য এর মধ্যেই গ্রেপ্তার হয়ে এখন জেলে রয়েছেন। অতি সম্প্রতি ঢাকার গ্রিন রোডে হেনা নামের সাত বছরের গৃহকর্মী ছোট্ট মেয়েকে চুরি করে খাওয়ার অপরাধে প্রচণ্ড মারধরের একপর্যায়ে মেয়েটির নিয়োগকর্ত্রী তার গলায় পা দিয়ে চেপে ধরেন। শেষ পর্যন্ত মেয়েটি মারা যায়।

হেনা বা আদুরীর মতোই ছোট্ট এক মেয়ের সঙ্গে বছর কয়েক আগে ঢাকায় দেখা, সে–ও গৃহকর্মী। চটপটে, বুদ্ধিমতী দুই বেণি দুলিয়ে ফ্রক পরা মুনিরা ছুটে ছুটে কাজ করে চলেছে। ঘরের ফুটফরমাস পালন করার পাশাপাশি টেলিফোন ধরা, মেহমান এলে সালাম দেওয়ার কায়দাকানুনও মুনিরার জানা। দরজা থেকে খবরের কাগজ আনতে আনতে কিছু লাইন পড়েও ফেলে মুনিরা। সবচেয়ে যা অবাক করার মতো ব্যাপার, তা হলো মুনিরার অবসর কাটে হাতের লেখা লিখে। বাড়ীর কর্ত্রী মুনিরার জন্য খাতা–পেনসিল অনবরতই কিনে আনছেন, সন্ধ্যার পর লেখাগুলো ঠিকমতো হচ্ছে কি না, দেখে দিচ্ছেন, বানান শুদ্ধ করে লিখতে শিখাচ্ছেন। মুনিরার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে জানলাম যে মুনিরার মা বাসায় কাজে দেওয়ার সময়ে অনুরোধ করেছেন তাঁর মেয়েকে একটু লেখাপড়া যেন শেখানো হয়। বাসার কর্ত্রী স্কুলে পাঠাতে পারবেন না বলেছিলেন তবে বাসায় পড়াবেন বলে কথা দিয়েছেন। শুধু ওর মাকে কথা দিয়েছেন বলেই খাতা, বই, পেনসিল কিনে দিয়ে গৃহকর্মী মেয়েটির পড়াশুনার দেখভাল করছেন, তা নয়। কারণ আরও আছে।

মুনিরা ব্র্যাক স্কুলে পড়েছে। মুনিরা সচেতন ও আলোকিত। মুনিরার স্ট্যাটাস অন্য রকম। মুনিরার সঙ্গে বাড়ির শিশুরা, চালকেরা ও অন্য কাজের লোকেরা কেউ তুইতুকারি করে না। একজন আত্মীয় ঠাট্টা করে বলেন ‘বাব্বা, মুনিরা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ছাত্রী ছিল, তাই ওর আলাদা খাতির!’

দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

আসলেই কি ও ব্র্যাক স্কুলে পড়েছে? হ্যাঁ সত্যিই তা–ই। ওর হাতের লেখাই সেই সাক্ষ্য দেয়। মুনিরার হাতের লেখা ছিমছাম। প্রত্যেকটা শব্দের মধ্যে দূরত্ব বা ফাঁক একই রকম। মনে হয়, স্কেল বসিয়ে মেপে মেপে একটির পর একটি শব্দ লিখেছে। ব্র্যাক কর্মসূচি এলাকার যে বাচ্চারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে পারেনি, তারা সাধারণত ব্র্যাক নন–ফরমাল স্কুলে আসত। এই বাচ্চাদের হাতের লেখা এক রকম। আমার অবাক লেগেছিল তা দেখে। মানিকগঞ্জ, জামালপুর, মাধবপুর, উত্তরবঙ্গ—সবখানেই লেখার মাঝে কেমন একধরনের মিল। আমি নন–ফরমাল প্রাইমারি এডুকেশন প্রোগ্রামের (এনএফপিই) প্রধান কানিজ ফাতেমাকে (ব্র্যাকে সবার কানিজ আপা, ওনার আরেক পরিচয় উনি গুণী নাট্যশিল্পী সারা জাকেরের খালা) এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তাঁর কাছ থেকে জানলাম, টিচার্স ট্রেনিং এবং টিচার্স রিফ্রেশার কোর্সগুলোতে শিক্ষকদের তৈরিই করা হয় এমনভাবে, যাতে সব এলাকার বাচ্চাদের তারা একইভাবে শেখাতে পারেন। হাতের লেখা ওদের হিবিজিবি নয়। গোটা গোটা শব্দ, লাইনও সোজা, আঁকাবাঁকা নয় মোটেও। এর পেছনে কারণটা সোজা, তবে বেশ চিন্তাভাবনা করেই সোজা পদ্ধতিটা বের করা হয়েছে। ব্র্যাক স্কুলের বাচ্চারা শিখেছে লেখার সময়ে একটি শব্দের পরে এক পেনসিল জায়গা ছেড়ে আরেকটি শব্দ লিখতে হবে। দুটো লাইনের মধ্যে এক পেনসিলকে শুইয়ে রেখে দূরত্ব রাখতে শেখানো হয়। পেনসিলটা খাড়াভাবে রেখে দুটো শব্দের মধ্যে দূরত্ব মাপা শেখানো হতো। দুটো লাইন ও দুটো শব্দের মধ্যে দূরত্ব রাখার নিয়মটি চমকপ্রদ। কারিগরি যন্ত্রপাতি (স্কেল ইত্যাদিসহ জ্যামিতি বক্স) ছাড়াই অত্যন্ত সোজাসাপটা পদ্ধতি মেনে চলার কারণেই ব্র্যাক স্কুলের বাচ্চাদের হাতের লেখা পরিচ্ছন্ন এবং প্রায় সবার লেখার ধরন মনে হয় এক রকম হতো। এদের শিক্ষা উপকরণ সামান্য তবে শেখানো হতো খুব দরদ দিয়ে।

তখনো মাঝেমধ্যে বাঁকা মন্তব্য কানে এসেছে। যেমন ‘যাদের পেটে ভাত জোটে না, তাদেরকে আবেদ সাহেব লেখাপড়া শেখায়!’ আবার কখনো প্রোগ্রামের মাঠকর্মীরা সমালোচনা নয় সহানুভুতি নিয়ে বলেছেন, ‘এই বাচ্চাদের অনেকেই আধপেটা খেয়ে ব্র্যাক স্কুলে এসেছে, খাবারের ব্যবস্থা করা গেলে ভালো হতো।’

অনেক কিছু করা গেলে ভালো হতো অবশ্যই। তবে শিক্ষাকে বাদ দিয়ে নয়। ওই শিক্ষাই গৃহকর্মী মুনিরার এক স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছে। আবেদ ভাইয়ের (স্যার ফজলে হাসান আবেদ) রিসার্চ আর মনিটরিং সেল ব্র্যাক প্রোগ্রামের বাইরে এসে এখন যেসব মুনিরা রয়েছে, তাদের নিয়ে সমীক্ষা বা জরিপ যদি করত, তবে ভালো হতো মনে হয়?

আদুরীর অত্যাচারের বর্ণনা অনেক জায়গায় অনেকবার বলা হয়েছে, সেই বিবরণ সংবেদনশীল মানুষের মনে রক্ত ঝরিয়েছে। তবে হেনার কথা তেমন আলোচিত হয়নি, পত্রপত্রিকায় হেনার খবর চোখে পড়েনি। এখন অনাদৃতা, হেনা ও আদুরীর অধিকার রক্ষায় মানবাধিকার সংস্থা, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, আরও অনেক সংগঠন কী করেছে, জানতে ইচ্ছা করে?

একই সঙ্গে মুনিরাদের কথাও জানতে হবে ও জানাতে হবে। সামান্য শিক্ষার আলো কীভাবে তাদের অবস্থানে এতটুকু হলেও ছাপ ফেলেছে, তা জানাও জরুরি নয় কি?

অপ্রাসঙ্গিক হবে না উল্লেখ করা যে ব্র্যাকের আচরণ সংস্কৃতিতে স্যার সম্বোধন কখনো ব্যবহার করা হতো না। ব্র্যাকের সবাই আবেদ ভাইকে ভাই ডাকতেন। যুক্তরাজ্য যখন আবেদ ভাইকে সম্মানজনক নাইট উপাধিতে ভূষিত করে, তারপর থেকে লক্ষ করেছি, সবার কাছে উনি স্যার আবেদ (আবেদ স্যার নন) সম্ভাষণে পরিচিতি পেয়েছন। ব্র্যাক প্রতিষ্ঠাতা ও কর্মযজ্ঞের প্রাণপুরুষ স্যার ফজলে হাসান আবেদ শিক্ষায় অবদানে পুরস্কৃত, তাঁর জন্য শ্রদ্ধা।