বৈশাখী ঝড়ে নববর্ষ

১৪৩১ সালের শেষের ৬ দিন গেল ঝড়ের মতো। না সান ডিয়েগো শহরে ঝড় শুরু হয়নি। হয়েছে ব‍্যক্তিগত জীবনে। আমি সাধারণ মানুষ, সব সময় রাডারের নিচে থাকতে চাই। কিন্তু সেলিব্রিটিদের জীবনের ফ‍্যান্সি সমস‍্যা আমার ঘাড়ে এসে পড়ে। এমনই অবস্থা, বন্ধুরা বলেই ফেলে, ফারহানা কিছু একটা কর, পরেরবার যখন দেখা হবে, এত ঝামেলা যেন না শুনি। সেইজ লাগবে তোমার।

তো ৮ তারিখ মঙ্গলবার ঘুম ভাঙল আমার ফোন কোম্পানি টি মোবিলের ফোন পেয়ে। কে নাকি আমার নামে আই ফোন ১৬ প্রো অর্ডার করেছে টেক্সাসে ডেলিভারি দেওয়ার জন‍্য। ওরা জানে, সেটা আমি নই, কয়েকজন অ্যাসোসিয়েটের সঙ্গে কথা বলেছি, একজন জানতে চাইল, তুমি কি তোমার নম্বর অন‍্য ক‍্যারিয়ারে বদলাতে চাইছ? পরিষ্কার বললাম, না, আমার অ্যাকাউন্টে আমি একা, অন‍্য কারও কথা শুনবে না। ওরা থাকতেই অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড বদলালাম সকালে। সেদিন আমার রাতে কাজ, রান্না শেষ করে চারটায় অ্যালার্ম দেব, রেডি হয়ে সাড়ে চারটার মধ‍্যে বের হতে হবে। দেখি ফোনে কোনো সার্ভিস নেই, কোথাও কল করতে পারছি না। কাজের মোবাইল দিয়ে কল করলাম, আমার পার্সোনাল মোবাইলে কোনো কল যায় না।

কাজের মোবাইল থেকে ফোন কোম্পানিকে কল দিলাম, আবার অনেকের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে, ওদের কথা আমার হয়ে কেউ একজন নম্বর রিলিজ করতে বলেছে। ওই কোম্পানিকে ওরা ই–মেইল দেবে, আপডেট জানাবে ইত‍্যাদি। এখানে যেকোনো কিছু ভেরিফাই করতে হয় ফোনে ওটিপি পাঠিয়ে। আমার ব‍্যক্তিগত নম্বর সব ব‍্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে জড়িত। কাজে গেলাম, কাজ শেষ করতে করতে লিগ‍্যাল সিস্টেমে লগইন করলাম। গত মাসে এ রকম কিছুতে সাইনআপ করেছি। সকাল সাড়ে সাতটায় কল করলাম, ওদের অ্যাটর্নি বলল, অমুক অমুক জায়গায় কমপ্লেইন করো, টি মোবিলকে বলো এটা টেক কেয়ার করতে। করলাম, পোস্ট করল ঘুমালাম। কোনো আপডেট নেই। যত হাজার কোটি অ্যাকাউন্ট আছে, সবকিছুর পাসওয়ার্ড বদলালাম।

পরদিন রাত তিনটায় দেখি, আমার ক্রেডিট কার্ড ইউজ করে ফ্রড ৫৫ হাজার ডলার অন‍্য অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছে। আমার ক্রেডিট লিমিট এত নয়, আমার একাউন্টেও এত টাকা নেই। তাহলে এটা কীভাবে সম্ভব? জাতীয় বনে প‍্যানিক অ্যাটাক হলে কী রকম চেস্ট পেইন হয়, শ্বাসকষ্ট হয় আর হার্ট রেট ১২০/১৩০ হয়, সেটা বুঝলাম। আল্লাহ বাঁচিয়েছেন আমার বোন ডাক্তার, দেশে তখন বিকেল পাঁচটা, কল দিলাম। সারা জীবনের মতো আমার অ্যাঞ্জেলেস বলল ব্রিথ কর, বাসায় বাচ্চা আছে, এটা তোকে টেক কেয়ার করতে হবে। ঝড় যত বেশি হোক, এটার শেষ আছে। কোনো দুঃসময় স্থায়ী হয় না।

সকাল পর্যন্ত কথা বললাম এর সঙ্গে। তারপর সাড়ে সাতটায় আবার একজন অ্যাটর্নির সঙ্গে কথা বললাম। সে বলল, টি মোবিল থেকে সার্ভিস ঠিক করে নামেনাবর নাও , তারপর ব‍্যাংকে জানাও। টি মোবিলে কথা বলে আই ওয়াচের নম্বর ফোন নম্বরে বদলালাম, ওদের দোকানে গিয়ে লাইন অ্যাকটিভেট করলাম, ব‍্যাংকে গেলাম, কয়েক ঘণ্টা বসে আইডেনটিটি ভেরিফাই করে নম্বর বদলে অন‍্য ব‍্যাংকে বসে আমার ফাইন‍্যানশিয়ল কাউন্সেলরকে নতুন নম্বর জানালাম।

দুপুরে অন‍্য ব‍্যাংকে বসেই দেখি, ফাইন‍্যানশিয়াল কাউন্সেলর ফোনের পর ফোন করছে, ফারহানা ফোনের। গাড়িতে বসতেই আবার তার কল। বলল, জলদি বাসায় যাও, ফ্রড এত অথেনটিকভাবে কল করছে, বলছে নতুন অ্যাকাউন্ট করতে চায় এবং তোমার নামের সব টাকা অন‍্য অ্যাকাউন্টে শিফট করতে চায়। ফ্রড ডিপার্টমেন্ট কনফিউজড। ফ্রড বলছে, অন‍্য নম্বর নয়, ওই ২১৩ নম্বরই তোমার নম্বর। গাড়ি কীভাবে চালিয়েছি, জানি না। বাসায় গেলাম। ল‍্যাপটপে বসে কোনো অ্যাকাউন্টে লগইন করতে পারিনি। কাজে বলেছি একজনকে কাভার করতে সেদিন, কারণ এভাবে কাজ করতে পারব না আমি। জীবনে প্রথম গত ১৫ বছরে এমন কথা বললাম। ওরা বলল, এটা আইডেনটিটি থেপ্ট। এটা টেক কেয়ার করো। পরের কয়েকটা দিন ছুটি ছিল আমার।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

ফাইন‍্যানশিয়াল কাউন্সেলর বলল, সব অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। কালকে কল করো, আমি তোমাকে ভেরিফাই করব। এ দেশে মানুষ ক‍্যাশ রাখে অল্প। বাচ্চাদের বললাম সব। অতপর বোনকে ফোন, খাবার কাগজের মতো লাগল, হার্ট রেট ১২০, সেই রাতটা কাটল। পরদিন সকালে কয়েক ঘণ্টা ফোনে থেকে কয়েকবার ব‍্যাংকে গিয়ে অ্যাকাউন্ট উদ্ধার করলাম। ব‍্যাংকে ওদের ৫৫ হাজার টাকা ফিরিয়ে আনবে, দুই বিলিং সাইকেল সময় লাগবে জানাল। উইকএন্ডের পর সোমবার, নতুন ক্রেডিট কার্ড পেলাম, অ্যাকটিভেট করলাম। হাজার জায়গায় বদলালাম ইনফো, ক্রেডিট ফ্রিজ করে ফ্রড এলার্ট দিলাম।

মঙ্গলবার কাজে জয়েন করলাম। বেলা তিনটায় টি মোবিলের ফোন (৮ দিন পর)। এরা হাসতে হাসতে জানাল, তোমার ২১৩ নম্বর ফিরিয়ে এনেছি। বললাম, তোমরা নম্বর বদলাবে না। আমি পুরোনো নম্বরে ফিরে যাব না। কী মনে করে শেষ রোগী দেখার আগে কল দিলাম আমার নম্বর থেকে অন‍্য ফোনে। দেখি নম্বর বদলে ২১৩ নম্বর হয়ে গেছে। এবার টি মোবাইলে চলে গেলাম। বললাম, আমি পুরোনো নম্বর চাই না, কপাল আবার ফ্রড নতুন নম্বর নিয়ে হ‍্যাক করবে। ওরা হাসল, তুমি কল করো…বললাম, আমি যাব না এখান থেকে কোথাও। এটা ঠিক করো। ওরা শুনল। পুরোনো নম্বর বদলে নতুন নম্বর দিল। সিম লক করলাম। কাজে ফিরে এলাম। নতুন বছর শুরু হলো, সবাই প্রজাপতি সাজে ঘুরে বেড়াল, আমি কাজ করলাম, লিজেকে গোছালাম।

পরদিন অ্যাটর্নি জানাল, ওরা এটা টেক কেয়ার করেছে, সুতরাং এটা কোনো কেস নয়। ড্রপ করে দিলাম। বুঝলাম, আমার কোম্পানি পয়সা দিয়ে দিয়েছে তাকে। সে আর হেল্প করবে না। তবে শিখলাম, সাইবার ক্রাইমের যুগে নিজের নিরাপত্তা নিজেকে নিশ্চিত করতে হবে, আরও সতর্ক হয়ে। আল্লাহ সব সময় সৎ মানুষের সঙ্গে আছেন। আফটার অল, এত কঠিন পরিশ্রমের টাকা, দুটি ছোট মানুষের ভবিষ‍্যৎ এত সহজে মুছে ফেলা যায় না। সবাই সাবধানে থাকুন, নিরাপদে থাকুন। আপাতত ব্যক্তিগত নম্বরে কোনো ফ্রি রোগী সেবা আমি দিচ্ছি না। ফেবু মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করলে আমি উত্তর দেব। ভালো থাকুন সবাই, আমাদের জন‍্যও দোয়া করবেন।