প্রেম, প্রতিবাদ ও প্যাস্ট্রির শহরে

প্যারিস শব্দটা উচ্চারণ করলেই যেন মনের মধ্যে একধরনের নরম, রোমান্টিক আলোড়ন জন্ম নেয়। কেউ বলে প্রেমের শহর, কেউ বলে বিপ্লবের কেন্দ্র। কেউ খুঁজে পায় সেখানে সাহিত্যের স্বর্গ, কেউবা ফ্যাশনের রাজধানী। কিন্তু প্যারিস কেবল কোনো একটি পরিচয়ে সীমাবদ্ধ নয়—এটি একটি জটিল, বৈচিত্র্যপূর্ণ, সাংস্কৃতিক ও মানবিক অভিজ্ঞতা।

প্যারিসের রাস্তায় হাঁটলে আপনি কেবল স্থাপত্য দেখবেন না, দেখবেন ইতিহাসের ছাপ। আইফেল টাওয়ার, সেন নদী, লুভর মিউজিয়াম, নটরডাম আর মমার্টের সিঁড়িগুলো—সবকিছু যেন আপনাকে নিয়ে যায় এক ভিন্ন সময়ে। বসন্তে যখন গাছপালা ফুলে ভরে যায়, শহরটি যেন এক রঙিন কাব্যে পরিণত হয়। এখানে প্রতিটি পাড়ায় রয়েছে এক নিজস্ব স্বাদ। ল্য মারেই (Le Marais) জেলায় মিলবে মধ্যযুগীয় পাথরের বাড়ি ও জুইস ঐতিহ্যের ছোঁয়া। লাতিন কোয়ার্টার হলো ছাত্রছাত্রীদের প্রাণকেন্দ্র, যেখানে বুকশপ ও কাফেগুলো এখনো বেঁচে আছে সত্তরের দশকের মতোই।

সংস্কৃতি ও শিল্প

প্যারিস মানেই শিল্প আর শিল্প মানেই প্যারিস। লুভরে মোনালিসা থেকে শুরু করে রাস্তার দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি—সবই এই শহরের সংস্কৃতির অংশ। অর্সে মিউজিয়ামে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের ‘স্টারি নাইট’, ক্লদ মনের জলবিলের ছবি, কিংবা রাস্তার এক বেহালাবাদক—সবাই একসঙ্গে গড়ে তোলে এক বিশাল সাংস্কৃতিক ট্যাপেস্ট্রি। এখানে প্রতিটি মানুষ একেকটি গল্প। ছোট্ট ক্যাফেতে বসে থাকা বৃদ্ধ লেখক, রাস্তায় পারফর্ম করা নৃত্যশিল্পী কিংবা মেট্রোর ভেতরে গান গাওয়া তরুণ—সবাই যেন একেকজন জীবন্ত চরিত্র। ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে প্যারিস এক অগ্নিকুণ্ড। বাস্তিল দুর্গের পতন, নেপোলিয়নের উত্থান কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎসি অধিকৃত প্যারিস—এ শহর ইতিহাসে ভরপুর। শহরের রাস্তাগুলোর নামও ইতিহাসের সাক্ষী। Rue de la Rvolution বা Boulevard Voltaire-এ হাঁটলে ইতিহাসের ধ্বনি শোনা যায়।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

এ শহরের মানুষ ভীষণ প্রতিবাদী ‘শার্লি এবদো’ হামলার প্রতিবাদ কিংবা ‘জিলে জোন’(Gilets Jaunes) আন্দোলনও এই শহরের সামাজিক ও রাজনৈতিক গতিপথের অংশ। প্যারিস কেবল শোভা নয়, এটি প্রতিবাদের শহরও।

খাদ্যরসিকদের স্বর্গ বলা হয় কেন

ফরাসি খাবার শুধু খাওয়ার জিনিস নয়, এটি একপ্রকার শিল্প। সকাল শুরু হয় এক কাপ এসপ্রেসো ও একটুকরা ক্রোয়াসাঁ দিয়ে। দুপুরে হয়তো এক প্লেট কঁফিত দ্য কঁর বা কুইশ লোরেইন, আর রাতে এক বোতল ওয়াইন আর এসকার্গ ক্যাফে কালচার প্যারিসের আত্মা। রাস্তায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট কাফেতে বসে আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারেন, এক কাপ কফি, এক বই আর অসংখ্য মুখ চিনে চিনে দেখা।

আইফেল বা লুভর মিউজিয়াম তো সবাই চেনে, কিন্তু প্যারিসের কিছু লুকিয়ে থাকা রত্ন আছে, যেগুলো জানলে আপনার অভিজ্ঞতা আরও গভীর হবে। যেমন ‘Passage des Panoramas’—একটি পুরোনো গ্যালারি, যেখানে দারুণ সব ছোট রেস্তোরাঁ আর দোকান আছে। ‘Parc des Buttes-Chaumont’-এই পার্ক প্যারিসের একেবারে উত্তরপূর্বে, কিন্তু যেন একটুকরা গ্রাম। এখানে বসে সূর্যাস্ত দেখা এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

‘শেক্‌সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি’ নামের বুকশপটি সাহিত্যপ্রেমীদের স্বর্গ। হেমিংওয়ে থেকে শুরু করে জেমস জয়েস পর্যন্ত অনেকে এখানে সময় কাটিয়েছেন। আজও এটি তরুণ লেখকদের আশ্রয়স্থল।

প্যারিসের চকচকে বাইরের দিকের পেছনে রয়েছে কিছু কঠিন বাস্তবতা। গৃহহীন সমস্যা, অভিবাসীদের চ্যালেঞ্জ, তরুণদের বেকারত্ব—এ সবই প্যারিসবাসীদের জীবনের অংশ। শহরের কেন্দ্র ওপ্রান্ত ‘লা সিতে’ বনাম ‘বানলিয়ে’-এর মধ্যকার পার্থক্য চোখে পড়ে। তবে এর মধ্যেও আশা আছে। পরিবেশ আন্দোলন, নারীর অধিকারে সচেতনতা এবং বর্ণবৈষম্যবিরোধী উদ্যোগগুলো শহরটিকে এগিয়ে নিচ্ছে এক নতুন ভবিষ্যতের দিকে। এই শহরের আসল সৌন্দর্য তার মানুষ। রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ সংগীতশিল্পী, বই বিক্রেতা, বৃদ্ধ দম্পতি যাঁরা প্রতিদিন নির্দিষ্ট কাফেতে কফি খেতে আসে, কিংবা সেই তরুণী যে হেঁটে যায়, তার স্কেচবুক হাতে—সবাই মিলে প্যারিসের গল্প তৈরি করে।

একজন স্থানীয় বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘প্যারিসকে জানতে হলে, তার মানুষকে জানো।’ এই শহরের প্রাণ হলো এর মানুষ, তাদের হাসি, তাদের প্রতিদিনের সংগ্রাম, আর তাদের অদম্য ভালোবাসা জীবনের প্রতি।

প্যারিস একবারে বোঝা যায় না। এই শহর এক জীবনে বারবার দেখা যায়, প্রতিবার এক নতুন চোখে। প্রেমের শহর, প্রতিবাদের শহর, কল্পনার শহর—প্যারিস বারবার জন্ম নেয় নিজের ভেতরেই। আপনি যদি হৃদয় খোলা রাখেন, প্যারিস আপনাকে গ্রহণ করবে এক অনন্য ভালোবাসায়।

আপনি যাবেন হয়তো আইফেল দেখতে, কিন্তু ফিরে আসবেন গল্প নিয়ে, অভিজ্ঞতা নিয়ে, আর কিছু অসমাপ্ত প্রশ্ন নিয়ে, যা আপনাকে আবার ফিরিয়ে আনবে এই শহরে। কারণ, প্যারিসকে একবার দেখা যায় না, প্যারিসকে ভালোবাসা যায়।