‘আমি মৃণালিনী নই’ যেন অবরোধবাসিনীর অন্তর্দাহ
শুরুতেই বলে নেওয়া উচিৎ, এটি কোনো আত্মজীবনী নয়। নয় কোনো ইতিহাসের দলিল। এটি শুধু একটি উপন্যাস। জীবনঘনিষ্ঠ লেখক হরিশংকর জলদাস অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে এনেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহধর্মিণীর মনের চিত্র। আদতে উনার মনের চরিত্রের সঙ্গে এ উপন্যাসের বর্ণনা কতখানি সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে তখনকার সময়ের সামাজিক অবস্থা, সেখানে নারীর অবস্থান এসব বিষয়ে এ বইয়ে বিশদ আলোকপাত করা হয়েছে। উপরন্তু ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের বিবরণ উঠে এসেছে অনেক বিস্তারিতভাবে। মৃণালিনী দেবীর বর্ণনায় আমরা আবিষ্কার করি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে। আসলে সৃষ্টিশীল মানুষের অনেকগুলো মাত্রা থাকে। আমরা কখনোই তাঁদের সব মাত্রা একসঙ্গে অনুধাবন করতে পারি না। তাই তাঁদের নিয়ে হয় গবেষণা, আবিষ্কার করা হয় নতুন নতুন মাত্রা এবং মূল্যবোধ। আর এসবের পাশাপাশি সৃষ্টিশীল মানুষেরা আবার এ সমাজেরই একজন। তাই তাঁদের ব্যক্তিত্বের একটা সামাজিক–সাংসারিক দিকও থাকে।
আর সেগুলো জানার জন্য তাঁদের পরিবারের, বিশেষ করে জীবন সঙ্গিনীর বিবরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাঁরা সৃষ্টিশীল ব্যক্তিকে সংসারের প্রতিই মনোযোগ দিতে বলে থাকেন। কিন্তু সৃষ্টিশীল মানুষেরা তো আসলে শুধু একটা সংসার বা সমাজের বা সময়ের প্রতিনিধি না। তাঁরা পুরো মানবজাতির, পুরো সভ্যতার প্রতিনিধি। তাঁদের রচনায় সভ্যতা আলোকিত হয়, এগিয়ে যায়। তাই অবধারিতভাবেই সংসারের মানুষদের সঙ্গে দেখা দেয় বিরোধ, তাঁদের সৃষ্টি হয় ব্যাহত। অবশ্য এসব বিরোধই হয়তোবা তাঁদের আরও প্রত্যয়ী করে তোলে। এমনটাও ভাবা যেতে পারে। আর একটা কথাতো সর্বজনবিদিত সেটা হচ্ছে অভাবই উদ্ভাবনের কারণ। তাই সংসারের, সমাজের বিভিন্ন রকমের অভাব হয়তোবা তাঁদের পুড়িয়ে আরও খাঁটি মানুষ বানায়। এভাবে চলতে চলতে একসময় তাঁদের জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। আমরা আলোকিত হই তাঁদের সৃষ্টিতে। আমরা করি তাঁদের জয়গান কিন্তু তিনি হয়তোবা তাঁর পরিবারের মানুষদের কাছ থেকে সেই পরিমাণ গ্রহণযোগ্যতা পান না। এমন সব ভাবনার মিশেল নিয়ে আমরা এই উপন্যাসের দিকে তাকাই এবার।
উপন্যাসের শুরুটা হয়েছে যে রাতে ভবতারিণী দেবী ঠাকুর বাড়িতে বউ হয়ে আসেন, সেখান থেকে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর ৯ মাস। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ছিল ২২ বছর ৭ মাস। এ বইতে ভবতারিণী দেবী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সবসময় রবিবাবু বলে সম্বোধন করেছেন। তাঁর ভাষায় রবিবাবু ছিলেন অসাধারণ রূপবান। লম্বাটে মুখ, নাকের নিচে সরু গোঁফ, মাথার মাঝখান দিয়ে সিঁথিকাটা। কানের পাশে ঈষৎ বাঁকানো চুল। এসবের মধ্যে মায়াময় দুটো চোখ। এ ছিল রবিবাবুর বাহ্যিক বর্ণনা। এরপর উপন্যাসের কাহিনী এগিয়ে চলেছে। রবিবাবুকে ভবতারিণী দেবীর আন্তরিক মূল্যায়নগুলোর দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ভবতারিণী দেবী কখনোই মন থেকে তাঁর নাম পরিবর্তনের বিষয়টি মেনে নেননি। বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা করলে সেটা সম্ভবও ছিল না। তাঁর ভাষায়, ‘এ কি বলছেন রবিবাবু! ভবতারিণী না মৃণালিনী! এ বাড়িতে আজ থেকে আমার পরিচয় হবে মৃণালিনী নামে! তাহলে আমার মা-বাবার দেওয়া নামের কী হবে? কত আদর করে তারা আমার নাম রেখেছে ভবতারিণী। মা মধুর কন্ঠে ডেকেছে—ভব, ভবতারিণী।’ এ নামকরণের পেছনে ভবতারিণী দেবী একটা ব্যাখ্যাও খুঁজে পেয়েছিলেন। তার ভাষায়, ‘রবিবাবুর জীবনে আনা তড়খড় অন্যরকম একটা মাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। রবিবাবু আনার নাম দিয়েছিলেন—নলিনী। গভীরভাবে এই তরুণীকে ভালোও বেসেছিল রবিবাবু। নইলে কেন এতগুলো বছর পেরিয়ে আসার পরও যখন নতুন নাম রাখার তাগিদ অনুভব করল রবিবাবু, নাম রাখল ওই নলিনীই। মৃণালিনী আর নলিনী তো সমার্থক শব্দ। যা নলিনী, তা-ই মৃণালিনী।’
এরপর নিজেদের দাম্পত্য জীবন নিয়ে লেখার তাগাদা কীভাবে পেয়েছেন, সেটারও বর্ণনা দিয়েছেন। প্রায় উনিশ বছরের দাম্পত্যজীবনের শেষে যখন তিনি তিন কন্যা আর দুই পুত্রের জন্ম দিয়েছেন, তখনই হঠাৎ তাঁর ইচ্ছা হয় লেখার। তাঁর মতে বাইরের মানুষ জানেন, রবিবাবু আর মৃণালিনী দেবীর দাম্পত্যজীবন অনেক সুখের। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কখনোই সেটা ছিল না। রবিবাবু মৃণালিনী দেবিকে তাঁর বউঠান কাদম্বরী দেবীর মতোন ভালোবাসেনি, আনার মতো পছন্দ করেননি আর ইন্দিরার মতো মর্যাদাও দেননি। তাঁর ভাষায়, ‘রবিবাবু কোথায় প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র আর কোথায় আমি ফুলতলি গ্রামের বেণীমাধবের মেয়ে ভবতারিণী! মনমানসিকতা আর দেহসংগঠনের তুল্যমূল্যে অনেক ফারাক আমাদের দুজনের মধ্যে! আমার পিতৃদত্ত নাম পাল্টে দিয়েই রবিবাবু প্রথম জানান দিয়েছিল, আমাকে সে জীবনের শুরুতেই কতটুকু অপছন্দ করে। বিয়ের পর প্রথম রাতেই রবিবাবু আমাকে বলেছিল—আমার কাছে তুমি ভবতারিণী নও, তুমি মৃণালিনী।’ পাশাপাশি তিনি আরেকটি বিষয় খেয়াল করেছিলেন যে রবিবাবুর অন্য ভাইয়েরা তাঁদের বউদের নাম পাল্টাননি। তাঁর মতে তিনি ছিলেন ঠাকুরবাড়ির বউদের মধ্যে সবচাইতে সাধারণ। সাধারণ চেহারায়, সাধারণ বিদ্যায়, সাধারণ আচরণে। রবিবাবুর অন্তরের কেউ তিনি ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাইরের। তিনি ছিলেন ব্যবহারের, তুলে রাখার নয়। তিনি রবিবাবুর কাছে এতোটাই সাধারণ ছিলেন যে তাঁর কাছে তাঁর মনের ভাবনাচিন্তা-আকুলতা প্রকাশ করা যায় না। নিজের অন্তরের কথাগুলো অকুণ্ঠভাবে প্রকাশের জন্য রবিবাবু কখনোই তাঁকে বেছে নেননি। রবিবাবু তার স্বামী ছিলেন, কিন্তু প্রেমিক স্বামী নন।
মৃণালিনী দেবীর ভাষায়, রবিবাবু তো খোঁচা দিয়ে কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন গ্রামের মেয়ে। সেখানকার জীবন তা সহজ–সরল, সেখানকার ভাষা অকৃত্রিম, মানুষের স্বভাবের মধ্যে মেকিপনা ছিল না। সরলতা, সহজাত জীবনাচরণ, মাটির ভাষায় কথা বলা কি দোষের কিছু ছিল? এমনসব প্রশ্ন উদয় হতো তাঁর মনে। এসবের প্রতিবাদ করে একবার তিনি রবিবাবুকে জবাবও দিয়েছিলেন, ‘তোমার বিদ্যার তুলনায় আমি অশিক্ষিত, মানি। কিন্তু জ্ঞানদা বউদি বাদে অন্যান্য বউদের তুলনায়? আর অশিক্ষিত যদি হয়েই থাকি, সে তোমার জন্য। তুমিই আমাকে শিক্ষাগ্রহণ করার সময় দাওনি।’ তিনি রবিবাবুর দিদিমা দিগম্বরী দেবীর প্রসঙ্গ টেনে আরও বলেছিলেন, ‘তোমার দিদিমা দিগম্বরী দেবী ছয় বছর বয়সে প্রিন্স দ্বারকানাথের বউ হয়ে এ বাড়িতে এসেছিলেন। লেখাপড়া জানতেন না তিনি। তোমার ঠাকুরদা কোনো দিন অশিক্ষার খোঁটা দেননি তাঁকে।’
রবিবাবু তাঁর ভালোবাসাকে ঘরের সীমানা থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। রবিবাবু অকপটে কাদম্বরী বউঠানের প্রতি তাঁর দুর্বলতার কথা লিখেছে ‘পুষ্পাঞ্জলি’তে— ‘হে জগতের বিস্মৃত, আমার চির স্মৃত, ...এ-সব লেখা যে আমি তোমার জন্য লিখিতেছি। পাছে তুমি আমার কণ্ঠস্বর ভুলিয়া যাও, অন্তরের পথ চলিতে চলিতে যখন দৈবাৎ তোমাতে আমাতে দেখা হইবে, তখন পাছে তুমি আমাকে চিনিতে না পার, তাই প্রতিদিন তোমাকে স্মরণ করিয়া এই কথাগুলি তোমাকে বলিতেছি, তুমি কি শুনিতেছো না।’ রবিবাবু তাঁকে মৃণালিনী নাম দিয়ে নিত্য দিন আনা তড়খড়কে নিয়েই মানসিক জীবনযাপন করে গেছেন। এরপরও তিনি আজীবন মৃণালিনী হতে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। রবিবাবু ভালোবেসেছেন আনা তড়খড়কে, তাঁর নতুন বউঠানকে। তাঁকে ভালোবাসেননি। রবিবাবু আর নতুন বউঠানের মধ্যে সম্পর্ক ছিল গভীর, ব্যাপক এবং সংস্কারমুক্ত। যে নারীটি অনেকদিন আগে মারা গিয়েছিলেন, সেই তিনি রবিবাবুর হৃদয়ে থেকে গেছেন অবিনশ্বর। বউঠান প্রসঙ্গে রবিবাবু ছিলেন উচ্ছ্বসিত, তাঁর জন্য রবিবাবুর হৃদয় অবারিত। মৃণানিলী দেবি বুঝে গিয়েছিলেন রবিবাবুর কাছে নতুন বউঠানের তুলনায় তিনি অতি নগণ্য।
মৃণালিনী দেবী না চাইলেও একসময় এতবড় ঠাকুর বাড়ির দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। হরেক রকমের ঝুঁটঝামেলা ছিল অন্দরমহলে। ঠাকুরবাড়িতে অনেক বউ ছিল কিন্তু তাঁর শ্বশুরমশায় তাঁকেই সংসারের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। প্রথাগতভাবে ঠাকুরবাড়ি ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল। এ পরিবারে তেজি প্রতিবাদী নারীর দেখা যেমন মিলেছে, তেমনি সর্বংসহা নারীরও অভাব ছিল না। অন্তঃপুরে অবরোধ প্রথা পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান। একই প্রাঙ্গণের এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে যেতে হলে ঘেরাটোপমোড়া পালকির সঙ্গে প্রহরী ছোটে, অনেক অনুনয়ের পর অনুমতি পেলে বেয়ারারা পালকিসুদ্ধ মেয়েদের জলে চুবিয়ে আনেন।
এ বইয়ে দুই বাংলার বিবদমান বৈষম্যও উঠে এসেছে প্রকটভাবে। কলকাতার অধিবাসীরা পূর্ববঙ্গের মানুষদের অত্যন্ত অবহেলার চোখে দেখতেন। নিন্দার্থে ‘বাঙ্গাল’ বলে সম্বোধন করতেন। ভবতারিণী দেবী প্রথম যেদিন শ্বশুরালয়ে গিয়েছিলেন, সেদিন তাই তাঁর মা সাবধান করে দিয়েছিলেন, ‘সবাই শিক্ষিত। কী লেখাপড়া তাঁদের! ওঁদের সামনে তুই কিছুই না, মা। সাবধানে কথা বলিস মা ওঁদের সঙ্গে। কোন সময় আবার কি ভুল ধরে বসেন।’ কলকাতার অবরুদ্ধ পরিবেশে তাই তিনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। তাই তিনি লিখেছেন, ‘আমার খুব ফুলতলি যেতে ইচ্ছে করে। যেখানে আমি জন্মেছি, সে গ্রামটা একবার ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করে আমার। আমার সামনে রবিবাবু হাঁটবে। তার পেছন পেছন আমি। আর আমাকে ঘিরে আমার সন্তানেরা।’
রবি মানে সূর্য। ভোরবেলাকার সূর্যের আলো পদ্মের ওপর পড়লে পদ্ম পূর্ণভাবে বিকশিত হয়। রবি ছাড়া মৃণালিনী যেমন অপ্রস্ফুটিত থাকে, তেমনি মৃণালিনীবিহীন রবিও অপূর্ণ। তার ভাষায়, ‘মানুষের তো দুটো সত্তা—দৈহিক আর মানসিক। আমার দেহ রবিবাবুর কাছে অপরিহার্য ছিল। কিন্তু মন? আমার মন বা হৃদয় বা অন্তরের হদিস রাখেনি সে কখনো।’
বই: ‘আমি মৃণালিনী নই’
লেখক: হরিশংকর জলদাস
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন