চিকেন টিক্কা মাসালা: এক দুর্দান্ত রহস্য

বিলেতে ইন্ডিয়ান তথা বাংলাদেশি রেস্তোরাঁয় সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন ‘চিকেন টিক্কা মাসালা’। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে রেস্তোরাঁগুলোয় অর্ডার করা সর্বাধিক জনপ্রিয় খাবার এটি। কয়েক বছর আগে যুক্তরাজ্য পরিচালিত এক জরিপ অনুসারে, চাইনিজ ফ্রাইয়ের পরে এটি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার। তবে জরিপে বিদেশি বলা হলেও এর আবিষ্কারের কৃতিত্ব হাতছাড়া করতে নারাজ ইংল্যান্ড কিংবা স্কটল্যান্ড। চিকেন টিক্কা মাসালার মালিকানার দাবি নিয়ে তারা রীতিমতো আইনি বিবাদে জড়িয়েছে। ইংল্যান্ড বলছে, বার্মিংহাম থেকে চিকেন টিক্কা মাসালার উৎপত্তি। অন্যদিকে স্কটল্যান্ডের দাবি, গ্লাসগো থেকে আবিষ্কার হয়েছিল এ পদটি। মালিকানা দাবিতে পিছিয়ে নেই ভারত, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ। এক চিকেন টিক্কা মাসালা নিয়ে পাঁচ–পাঁচটি পৃথক দেশের মালিকানার লড়াই খাবারটির ইজ্জত–সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। শুধু কি তাই? চিকেন টিক্কা মাসালা ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, স্কটিশ পার্লামেন্টেও আলোচনার মসলা জুগিয়েছে।

২০০১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারি রবিন কুক ঘোষণা দিয়ে জানিয়েছিলেন, চিকেন টিক্কা মাসালা ব্রিটেনের জাতীয় খাদ্য। পদটি জনপ্রিয় এ কারণে তিনি কথাটি বলেননি, মূলত ব্রিটেন কীভাবে সহজে বাইরের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আত্মস্থ করে নেয় চিকেন টিক্কা মাসালা তার একটি প্রকৃষ্ট নমুনা হয়ে ধরা দেয়।

চিকেন টিক্কা মাসালা তুমি কার, এটি নিয়ে বহুবার প্রশ্ন এসেছে। টেমস-সুরমা গঙ্গায় অনেক জল গড়িয়েছে কিন্তু উত্তর আসেনি আজও।

ডিশটির উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক বেশ পুরোনো। এ বিতর্কের ইতি টানতে বহু পুরোনো অতীতের শরণাপন্ন হয়েছেন অনেক ইতিহাসবিদ। তাঁরা ঢুঁ মেরেছেন মোগল সাম্রাজ্যের রান্নাঘরে। মোগলের হাঁড়ির ঢাকনা খুলে খুঁজে পেয়েছেন টিক্কার ঘ্রাণ।

ওই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন বাবর যুদ্ধজয়ী বীর হলেও নাকি মুরগির হাড়ে ভয় পেতেন খুব। হাড় যদি গলায় বিঁধে যায় তবে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু! আর এ কারণেই নাকি পাঞ্জাবি বাবুর্চিদের আদেশ দিলেন তিনি, হাড় ছাড়া মুরগির মাংস রান্না করতে। সেই আদেশ থেকে জন্ম নিল টিক্কা। আর বাবরের টিক্কার আধুনিক সংস্করণ আজকের চিকেন টিক্কা মাসালা। ভারতীয় মিডিয়া দাবি করে, ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর পাঞ্জাব থেকে যখন লোকেরা ইউরোপে পাড়ি জমাতে শুরু করেন, তখন তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে যায় এই রান্নার রেসিপিও।

চিকেন টিক্কা মাসালার উৎপত্তির ইতিহাসে আরেকটি শক্তিশালী চরিত্র হচ্ছেন পাকিস্তানি শেফ আলী আহমেদ আসলাম। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরের ঐতিহ্যবাহী শিশমহল রেস্তোরাঁর শেফ আলী আসলামকে চিকেন টিক্কা মাসালার জনক বলে অভিহিত করেন কেউ কেউ। তাঁরা বলেন, নিজের শিশমহলে বিশেষ সস তৈরির মাধ্যমে ডিশটি আবিষ্কার করেছিলেন আলী আসলাম।

গল্পটি এ রকম। শিশমহল রেস্তোরাঁয় খাবার খেতে এসে একজন গ্রাহক চিকেন কারিতে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। খাবারটিকে খুব বিস্বাদ ও শুকনো বলে মনে হয়। গিলতে না পেরে ডিশটি বদলে দেওয়ার অনুরোধ করেন। ঘটনাচক্রে সেদিন শেফের দায়িত্বে ছিলেন আলী আসলাম। গ্রাহকের খাবারে তৃপ্তি দিতে তিনি মুরগির টুকরোগুলো টমেটো স্যুপের সঙ্গে একত্র করেন আর এখান থেকেই জন্ম নেয় খাবারের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়। তৈরি হয় চিকেন টিক্কা মাসালা।

ভারতের পাঞ্জাব অথবা পাকিস্তানের শেফ আলী আসলামের ইতিহাসকে তেমন আমলে নেননি এথনিক বা জাতিগত খাবারের খ্যাতিনামা ইতিহাসবিদ, পিটার এবং কলিন গ্রোভ। তাঁরা চিকেন টিক্কা মাসলার এসব উৎস নিয়ে আলোচনা করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত এ উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, ডিশটি অবশ্যই ব্রিটেনে উদ্ভাবিত হয়েছিল এবং এটির উদ্ভাবন করেছিলেন একজন বাংলাদেশি শেফ। চিকেন টিক্কা মাসালার আবিষ্কারের আরেকটি গল্প থেকে জানা যায়, একজন বাংলাদেশি শেফ মুরগির টিক্কায় টমেটো স্যুপ, মসলা এবং দই যোগ করে খাবারটি প্রথম বানিয়েছিলেন।

ভারতীয়, পাকিস্তানি কিংবা বাংলাদেশি যার মাধ্যমেই হোক অথবা যেভাবেই হোক চিকেন টিক্কা মাসালা স্বাদে ভুবন জয় করে। জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। কেবল ব্রিটেন নয়, বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে ভারতীয় উপমহাদেশীয় রেস্টুরেন্ট মানে চিকেন টিক্কা মাসালার জয়জয়কার। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে এ ডিশ প্রবল জনপ্রিয়। পশ্চিমার পাতে অনেক খাবার আসে–যায়, কিন্তু টিক্কা মাসালার আবেদন কখনো ফুরোয় না।

অথচ চিকেন টিক্কা মাসালাকে নিয়ে জল ঘোলা করাও কম হয়নি। এমনকি হয়েছে আইনি লড়াইও। কয়েক বছর আগে গ্লাসগোকে চিকেন টিক্কা মাসালার হোম হিসেবে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য এক প্রচারাভিযান শুরু করা হয়। যাতে সমর্থন দেয় গ্লাসগো সিটি কাউন্সিল এবং লেবার পার্টির এমপি মোহাম্মদ সরওয়ার।

প্রচারকারীদের দাবি ছিল এটি যে, যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বলে দাবি করা ডিশ চিকেন টিক্কা মাসালার উৎসের শহর হিসেবে অবশ্যই গ্লাসগোকে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে। এমপি সরওয়ার বিষয়টি নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে মোশন আনবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। গ্লাসগোর ওই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বার্মিংহাম কাউন্সিল আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা দাবি করে, চিকেন টিক্কা মাসালা সত্তরের দশকে বার্মিংহাম শহরে প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে চিকেন টিক্কা মাসালার প্রস্তাব তোলা হয়নি। মীমাংসা হয়নি উৎসের। চিকেন টিক্কা মাসালা স্বাদে যেমন অতুলনীয়, রহস্যেও তেমন অলঙ্ঘনীয়।

কথায় আছে, যত বেশি রহস্য, তত বেশি কদর। চিকেন টিক্কা মাসালার কদর এ কারণেই বুঝি কখনোই ফুরোয়নি।