‘লিলি পিলির’ সাগর পারে
বছরের শেষ লম্বা সাপ্তাহিক ছুটিতে সমুদ্র দর্শনের সুযোগ কেমন করে ছাড়ি। ক্যানবেরা শহরটা নিউ সাউথ ওয়েলসের ভূমিবেষ্টিত স্বশাসিত এক নগর শহর। একমাত্র কাছের সমুদ্র শহর তাও আবার ১৫০ থেকে ১৭০ কিলোমিটার দূরের বেটম্যান বে। দিনে গিয়ে দিনেই চলে আসা যায়। মধ্যে পরবে ঐতিহাসিক ব্রেইডউড। এই শহরের কথা একটু বলতেই হয়।
ব্রেইডউড তার ১৯শ শতাব্দীর পাথরের ভবনগুলোর জন্য বিখ্যাত, যেগুলো একসময় সোনার খনির শহর ছিল। শহরটি তার সোনালি যুগ থেকে সংরক্ষিত অনেক পুরোনো ভবন ধারণ করে, যা এর ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে তুলে ধরে। এটি মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের একটি অঞ্চলে অবস্থিত, যা প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য একটি চমৎকার স্থান।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
ব্রেইডউড শহরের আরও একটা ইতিহাস হচ্ছে প্রথম মহাযুদ্ধে এই শহরের ৪৫৬ জন পুরুষ ও নারী অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর মধ্যে ৩৭৭ জন বাড়ি ফিরেছিলেন। যে ৮৮ জন আর কখনোই ফেরেননি তাঁদের স্মরণে শহরের ব্যস্ততম চৌরাস্তার সড়কদ্বীপের স্মৃতিস্তম্ভটি ইতিহাসকে মনে করিয়ে দিতে ভোলেনি।
প্রথম মহাযুদ্ধের জীবন দেওয়া ব্রেইডউড শহরের ৮৮ জন সৈনিকের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ।
ঘণ্টা দেড়েক গাড়ি চালিয়ে কিছুটা ঝিমুনি এসে গেছে। ব্রেইডউডের বেকারির দোকানের সুনাম ক্যানবেরা পর্যন্ত। কফিও বেশ উপাদেয়। সয়া দুধ সহযোগে এককাপ ধোঁয়া ওঠা ক্যাপিচিনো শরীরটায় বেশ চনমনে ভাব নিয়ে এলো। বসন্তের শেষের দিকে, ঝলমলে রোদেলা দিনে গাড়ির ঢল নেমেছে সমুদ্রপানে। তারই প্রভাবে ব্রেইডউডের কফির দোকানে বিশাল লাইন, কফি হাতে, আন্ডা বাচ্চাসহযোগে লোকাল পার্কটা ব্যাপক সরব হয়ে উঠেছে।
ক্যানবেরা টু ব্রেইডউড রাস্তা বেশ উপভোগ্য। আশপাশ সমতল ভূমি, মূল রাস্তা থেকে কিছুদূর পরপর ছোট চিকন রাস্তাগুলো খামারবাড়ির পথে চলেছে। রাস্তার ওপর এখানে–সেখানে দুয়েকটা মৃত ক্যাঙ্গারুর দেহ চোখে পড়বেই। রাতের আঁধারে গাড়ির হেডলাইটকে ভালোবেসে কিছু ক্যাঙ্গারু আত্মাহুতি দেয়, ওদের দেহই পড়ে থাকে এখানে–সেখানে। ক্যাঙ্গারু আত্মাহুতি শুধু ওদের বিসর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, কখনো কখনো চালক ও যাত্রীর জীবন সংশয়ের কারণ হয়ে যায়।
ব্রেইডউড থেকে বেটম্যান বে অসম্ভব রোমাঞ্চকর পাহাড়ি পথ। ঘন সবুজ পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ। গাড়ির গতিসীমা কোথাও ১০০ কিমি, পরক্ষণেই ২৫ কিমির খাড়া পাহাড়ি বাঁক, চোখ পাশে গেলেই রক্ত শীতল হয়ে আসতে পারে গভীর পাহাড়ের খাদে।
পাহাড়জুড়ে অসংখ্য বড় বড় বৃক্ষের নিচে শত শত ঘন সবুজ ফার্নের সমারোহ। দুই–চারটা ফার্ন তুলে নেওয়ার লোভটা বড় কষ্টে সংবরণ করে গাড়ি চালাতে হলো।
শহরের প্রবেশমুখেই বড়সড় ব্রিজটা পার হলেই নয়ন মোহন করা সমুদ্রের নীল জলরাশি চোখে পড়বে। সাগর মোহনায় বিশাল জেটির পাশেই ফিশ অ্যান্ড চিপস–এর দোকানে বিশাল লাইন। সাগরপারে এসে ফিশ অ্যান্ড চিপস হবে না, এই সংস্কৃতিতে অকল্পনীয়। বইমেলায় এসে ফুচকা না খাওয়ার মতোই।
শহরের কোলাহল ছেড়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের ড্রাইভিং আপনাকে নিয়ে আসবে ‘লিলি পিলির’ নীল জলরাশির পারে। নয়নজুড়ানো অসম্ভব সুন্দর জলরাশি।
প্রশান্ত মহাসাগরের জলরাশির গর্জন, পাশের পাহাড় আর ঘনসবুজ বৃক্ষ শোভা আপনাকে মোহিত করবেই।
প্রকৃতির এক অপার রহস্য যেন চারদিকে ছড়ানো। গত জুলাইয় শ্রীলঙ্কায় দেখা সমুদ্র উপকূলের জলের প্রেমকে চোখ রাঙিয়ে ‘লিলি পিলির’ জল যেন বলে—‘ওহে আমার রূপের কমতি কোথায় হে।’