আমার মা ও আমি
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ধেয়ে আসছে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা। চট্টগ্রামে বসবাসরত আমার মাকে বারবার ফোন দিচ্ছি ও বাংলা নিউজ চ্যানেলে চোখ রাখছি প্রতি মুহূর্তের খবর জানতে। আজ রোববার দুপুর নাগাদ উপকূলে আঘাত হানতে পারে ঝড়টি, আবহাওয়ার পূর্বাভাস তাই বলছে।
মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে মা দিবস পালিত হয়। মাকে নিয়ে কিছু ভাবতে গেলেই ফিরে যাই আমার ছোটবেলায়, কিশোরীবেলায় বা সদ্য যুবতী হওয়া দিনগুলোয়। আম্মার শাসনের স্মৃতিগুলোই বেশি দৃশ্যপটে ভেসে উঠে। সে সময়কার কিছু কথা না হয় বলি...
ছোটবেলার অসংখ্য স্মৃতির মধ্যে যে স্মৃতিটি সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে তা হলো, সারা বিকেল খেলাধুলা শেষ করে মাগরিবের ওয়াক্ত হলেই হাতমুখ ভালোভাবে ধুয়ে আমরা সহোদরেরা লাইন দিয়ে বসে পড়তাম। আর মা গরম গরম এক কাপ দুধের সঙ্গে মালটোভা বা ওভালটিন গুলিয়ে দিত আর সঙ্গে দুটি করে বেলা বিস্কুট। কী যে মজা লাগত!
খাওয়া শেষ হওয়া মাত্রই মা শাসনের গলায় বলত, ‘এবার পড়ার টেবিলে যাও, ঠিকমতো পড়াশোনা করবে, কোনো হইচই শুনতে চাই না।’
আদেশ মতো, যেই কথা সেই কাজ। আমরা সবাই কাঠপুতুলের মতো পড়ার টেবিলে ফিরে যাই।
স্কুলের সময় হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে স্কুলব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি। মা তখন সকালের নাস্তার আয়োজনে মহাব্যস্ত।
অনুরোধ মাখা সুরে মায়ের কাছে আবদার করলাম, ‘মা, শ খানেক টাকা লাগবে। দিতে পারবে?
মায়ের তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন, কেন? টাকা দিয়ে আবার কী হবে?’
সেদিন যে স্কুল থেকে শিক্ষাসফরে গেলাম, সেখানে ছবি তুলেছি, পরে আমরা বান্ধবীরা মিলে একই রকম কাপড় পরে আরও কিছু ছবি তুলেছি, সে ছবিগুলো প্রিন্ট করব।
এত ছবি কেন তুলতে হবে? কতদিন বলেছি আমাদের ধর্মে ছবি তোলা নিষেধ, গুনাহ হয় (মনে হয় আমাকে জব্দ করার জন্য কথাটা বলত!)। আর তোমাকেই কেন সবকিছু করতে হবে।
আমি একা কিছু করছি না তো মা! আমরা বান্ধবীরা মিলে ৩০ টাকা দিয়ে নেগেটিভ ডেভেলপ করিয়েছি। এখন সবাই টাকা শেয়ার করে নেগেটিভের ৩৫টি ছবি প্রিন্ট করব। প্লিজ দাও।
মা নিরুপায় হয়ে গজ গজ করে তার রুমে গেল। স্টিলের আলমারি খোলার আওয়াজেই বোঝা গেল টাকাটা পাচ্ছি। আমি খুশিতে ডগমগ।
টাকা আমার হাতে তুলে দিয়ে শাসিয়ে বলল, ‘শোনো, তোমার ছবি তোলা কমাও আর পড়াশোনায় মনোযোগ দাও। অঙ্কের নম্বর ভালো নয়। উফ অঙ্ক, আমার জানের দুশমন।’
আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে পড়লেই বাঁচি। আচ্ছা মা, আমি আসি-আল্লাহ হাফেজ।
আরেকটু যখন বয়স হলো তখন ছবি তোলার সঙ্গে নতুন অত্যাচার যোগ হলো চুলকাটা।
পাঁচলাইশে ক্যাডেট কোচিং সেন্টারে ছোট ভাইকে নামিয়ে দিয়ে আমি লুসি পারলারে সোজা চলে গেলাম চুল কাটতে। তারপর মনে ভয় নিয়ে গুটি গুটি পায়ে ভাইকে সঙ্গে করে বাসায় ফিরলাম। চুলগুলো ছোট খোঁপা করে এমন করে বেঁধেছি, যেন মা বুঝতে না পারে আমি চুল কেটেছি। কলবেল চাপতেই মা এসে যথারীতি দরজা খুলে দিল। সেদিন আর মায়ের চোখে পড়ল না আমার চুলকাটা। কিন্তু বিপত্তি বাধল পরের দিন সকালে কলেজে যাওয়ার সময়।
মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে দরজা দিয়ে বের হচ্ছি সেই মুহূর্তেই তার চোখে পড়ল আমার নিচু করে বেঁধে রাখা ছোট পনিটেলে।
তুই আবার চুল কেটেছিস? কিছুদিন আগেই না চুল কাটলি। বললাম, চুলগুলো একটু বড় হতে দে। ভালো লাগবে।
একগাল হেসে বললাম, আর কাটব না।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! কালের হাওয়া লেগেছে। মাধুরী দীক্ষিতের প্রেমে পড়েছিলাম, সে কীভাবে চুল কাটে ও বাঁধে, তা হুবহু অনুসরণ করতাম। আর সঙ্গী হতো আমার আম্মার টক-ঝাল-মিষ্টি বকুনি।
কয়েক পা এগিয়ে গিয়েই মনে পড়ল, মা একদম ভুলে গিয়েছি বলতে আজ কলেজ শেষে এক বান্ধবীর বাসায় যাব। কিছু কাজ আছে।
হুম যাও, তবে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবে। সন্ধ্যার আগেই।
জি মা, তাড়াতাড়ি ফিরব।
এই আদেশটাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। যেখানেই যেতাম সন্ধ্যার আগেই ফিরতাম। সূর্যের আলো ছিল আমাদের ঘরে ফেরার ঘড়ির কাঁটা।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যাওয়া নিয়ে আমাদের ছেলে বন্ধুরা কত ঠাট্টা করত। আমরা মেয়েরা নাকি মুরগি! সন্ধ্যা নামলেই মুরগিরা যেমন খোঁয়াড়ে ফিরে যায়, আমরাও নাকি তাই করি। যাই বলুক, নিয়মটা মন্দ ছিল না।
আরও বেশ কয়েক বছর গড়িয়ে মাস্টার্স শেষ করে চাকরিতে যোগ দিলাম। মাস শেষে যখন টাকা হাতে আসত, তখন সোজা রওনা দিতাম শপিংয়ে, নয়তো কাউকে সাহায্য করা, কিংবা একে–ওকে উপহার কিনে দেওয়া। দেখা যেত সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সব টাকা শেষ। থাকা-খাওয়া-পরার কোনো চিন্তা নেই; সংসারেও আমার টাকার কোনো প্রয়োজন ছিল না। দায়িত্বহীন সে এক অন্য জীবন।
মা বুঝতে পেরেছিল আমি মোটেও সঞ্চয়ী গোছের না। তাই একদিন আমাকে ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে মোটামুটি ভালো অঙ্কের একটা ফিক্সড ডিপোজিট একাউন্ট খুলে দিয়েছিল, যাতে আমি অপচয় না করি। ছোট থেকেই মাকে দেখতাম এদিক-ওদিক করে টাকা জমিয়ে সোনার গহনা গড়তে দিত। মা বলত, ওটাই সম্পদ, বিপদে কাজে লাগবে।
আমার মা সাদাসিধে গোছের স্বল্পভাষী একজন মানুষ; ভীষণ পরিশ্রমী, সঞ্চয়ী ও দূরদর্শী। কখনো সাজতে দেখিনি! মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন মা যেমন করে হিসাব করে ও শক্তহাতে সংসারটা গুছিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়, সে শিক্ষার বীজ অবচেতনভাবেই আজও সুপ্ত আছে আমার আপন সংসারে।
এতটা বয়স হয়ে গেছে আমার স্বভাবগুলো আজও পাল্টায়নি। এখনো বিরামহীন ছবি তুলছি, চুলগুলো একটু কাঁধ ছেড়ে নেমে যাওয়া মাত্রই সেলুনে হাজির হচ্ছি; আর হাতে যতটুকু টাকা আসে, তা শপিং নয়তো কাউকে সাহায্য করা বা উপহার দেওয়ার মাধ্যমেই শেষ করে ফেলি।
ফেসবুকে এখন মা প্রতিনিয়ত আমার ছবিগুলো দেখতে পায়, কিন্তু আগের মতো আর বকুনি দেয় না।
সপ্তাহখানেক আগে হাওয়াই দ্বীপের মাউইতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার মায়ের দেওয়া একটি আকাশি রঙের জামদানি শাড়ি পরে সকালবেলা সমুদ্রসৈকতে ছবি তুলেছিলাম। ছবি দেখে মা আমাকে ফোনে বলল, ‘তোর ওই ছবিগুলো সুন্দর হয়েছে। আমি দূর হতে কান পেতে শুনি, আর একাল ও সেকাল মেলাই। হয়তো সাতসমুদ্র আর তেরো নদীর ওপারে আছি বলেই এই পরিবর্তন বা সময়ের পরিবর্তন। এখন তো আমাদের কাছে ছবি ও ভিডিও কলই সব দেখা আর কাছে পাওয়ার জায়গা।
এখন আমার ছোট চুলগুলো দেখে মাঝেমধ্যে মা বলে, ‘তুই চুলগুলো আর লম্বা করলি না, ছোটই রাখলি। আমি একটু করে হাসি।’
আর সঞ্চয়, এই জিনিস আমাকে দ্বারা কখনো হবে না। সে ভার আমার কর্তাবাবুর ওপরই ন্যস্ত। যিনি আমার মায়ের মতোই এই বিষয়ে পটু। তবে আমি অযথা বা মাত্রাতিরিক্ত কিছু করি না, তা তারা দুজনই ভালো জানে। সেটা আমার নিজেরই অপছন্দ।
হয়তো একদিন আমার সবকিছুর পরিবর্তন ঘটবে, বা না–ও ঘটতে পারে। কারণ, আমার কর্তাবাবুকে বলে রেখেছি, আমি ষাট-সত্তর বছরের বুড়ি হলেও আমার ছবি তুলে দিতে! আর সে বয়সে চুলটা হয়তো ববকাট করে ফেলব!! . . . কিন্তু সেদিন পর্যন্ত আমার মা কিছু মন্তব্য করার জন্য এই পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকবে কি না, নাকি আমিই ছবি হয়ে যাব, সেটাই বড় প্রশ্ন। সব প্রবীণ মায়েরা ভালো ও সুস্থ থাকুক।
পৃথিবীর সব মায়েদের প্রতি রইল মা দিবসের শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
লেখক: সুরাইয়া সিদ্দিকী, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র।