জীবনে সংযম এবং ধৈর্য শেখা জরুরি কেন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রতিবছর বহুভাবে আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ থাকি, এ মাসটা দেওয়ার জন্য। তবে এ বছর এ মাসটা আসার আগেই ধৈর্য ও সংযম জীবনে কতটা জরুরি, আবার শিখলাম।

রেসিডেন্সি এবং প্রথম চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরের টাকা দিয়ে চট্টগ্রামে একটা অ্যাপার্টমেন্ট কেনা হয়েছিল। ডিভোর্স পেপারে আমেরিকায় ওই অ্যাপার্টমেন্টের মালিক আমি। কিন্তু দেশে যৌথ মালিকানা রয়ে গেছে। গত বছর গেলাম, বন্ধুর ভাইয়া আমার আইনজীবী জানালেন মূল দলিল বা খতিয়ান না থাকলে অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করা যাবে না।

আমি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পাবনা বা হেবাও করা যাবে না আমার নামে। চট্টগ্রামে কিছু বন্ধু ছাড়া আমার কেউ নেই। চলে এলাম আমেরিকা, এ বছর খতিয়ান হলে আবার যাব। চট্টগ্রামের ওই বাড়ির ডিপ টিউবওয়েল বসানো, ট্যাক্সসহ খরচ লেগেই আছে। সিঙ্গেল মা হিসেবে সেটা আমি আর টানতে চাইছিলাম না। সেটা ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারির কথা।

এই বছর ফেব্রুয়ারি আসার ছয় মাস আগে থেকে ছুটি চাইলাম, ওরা ১০ দিন পিছিয়ে ছুটি দিল ৮ তারিখ। হাসপাতালের কাজ, মোট তিন সপ্তাহ পেলাম বরাবরের মতো। দেশে রওনা হওয়ার ঠিক দুই সপ্তাহ আগে বাচ্চাদের বাবা জানাল দেশে ডেঙ্গু বেশি, সে যাবে না। বন্ধুকে জানালাম তুই ভাইয়ার কাছ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নির কাগজ পাঠিয়ে দে। সে বলল, দোস্ত এটা এত সহজে হবে না, বেশ কয়েক জায়গায়, আমেরিকা, ঢাকা, চট্টগ্রামের দুই জায়গায় এই কাগজ ভেরিফাই করা লাগবে। বললাম তুই পাঠিয়ে দে, বাসাটা একজন কিনবেন বলেছেন (দুই বছরে বহুজনকে বলেছি কিন্তু কিনতে চান এমন একজন যিনি শুধু শুনেছেন লোকমুখে বাসাটা বিক্রি হবে)। পাঁচ দিনের মাথায় কাগজগুলো এল। এর মধ্যে কয়েক দিন ফোন করে লস অ্যাঞ্জেলেস বাংলাদেশ কনস্যুলেটকে ফোন করে জানালাম আমি আসব, কাজটা জরুরি। তাঁরা বললেন, আসুন, সমস্যা নেই।

সার্টিফায়েড চেক ছাড়া কনস্যুলেট অন্য কোনোভাবে ফি নেন না। এক তুমুল বৃষ্টির দিনে কাজ থেকে মিনিট ১৫ আগে ভিজে ভিজে ব্যাংকে গেলাম, হাসিখুশি একটা ছেলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে দিয়ে দিল চেক। আট দিন কাজ শেষে ন্যাশনাল আইডি কার্ড, পাসপোর্টসহ আড়াই ঘণ্টা ড্রাইভ করে গেলাম বাংলাদেশ কনস্যুলেট। গিয়ে দেখি বাচ্চাদের বাবা তাঁর নতুন বউয়ের ভিসার আবেদন করছে, আমার পেপারে সাইন করতে আধা ঘণ্টা লাগল। তারপর কনস্যুলেট ভেরিফাই করবেন, কাগজ জমা দিয়ে খালার বাসায় লাঞ্চ করে টেক্সট পেলাম কনস্যুলেটের সাইন হয়ে গেছে। কাগজগুলো নিয়ে কন্যাকে একনজর দেখে (সে থাকে কলেজ ক্যাম্পাসে) বাসায় এলাম। একদিন পর রওনা হলাম দেশের পথে লস অ্যাঞ্জেলেস থেকেই এক দিন পর।

লেখক

আমার খুব কাছের বন্ধুকে আগে ফটো তুলে পাঠিয়েছিলাম পাওয়ার অব অ্যাটর্নির কাগজ। সে মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সে আগেই জমা দিয়ে রেখেছিল। ২৩ ঘণ্টা জার্নি করে দেশে পৌঁছালাম ১২ ফেব্রুয়ারি। ১৩ তারিখে বন্ধু নিয়ে গেল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। দুপুরের মধ্যে তারা ভেরিফাই করে সাইন দিলেন। দুপুরে খেয়ে বাসায় চলে এলাম। পরদিন ভোরে আমি, আমার বোন আর বন্ধুসহ চট্টগ্রামে পৌঁছালাম ৪৫ মিনিটে। পতেঙ্গা সৈকতের পাশ ঘেঁষে অপূর্ব রাস্তা দিয়ে চট্টগ্রামের পথে চলেছি, শঙ্কা মনে। ও হ্যাঁ বিমানবন্দরে দুলাভাই আগেই গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন গতবারের মতো। আমি আমেরিকা থেকেই হোটেল র‌্যাডিসনের দুইটা রুম বুক করেছিলাম।

১৪ ফেব্রুয়ারি র‌্যাডিসন হোটেলে পৌঁছে শুনি তাঁরা আমার বুকিং রেফারেন্সে কোনো রুম বুকিং খুঁজে পাচ্ছেন না। বিপিএলের খেলা আর ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে কোনো রুম খালি নেই। বসে থেকে থেকে আল্লাহর অশেষ রহমতে পেনিনসুলায় দুইটা রুম পাওয়া গেল। আমাদের চট্টগ্রাম ডিসি অফিসে যেতে হবে। সময় লাগবে কাজগুলো করতে। কোনো রকম লাগেজ রেখে, রুমের টাকা দিয়ে পেনিনসুলা থেকে আমরা রওনা হলাম কোর্টের কাছে, ডিসি অফিসে। চট্টগ্রামের বন্ধু ফোন করছে ততক্ষণে তুই কি হোটেলে এসেছিস? বললাম, দোস্ত পেনিনসুলাতে থাকছি, কেন পরে ব্যাখ্যা করব। বলে দে ড্রাইভারকে কই যাব।

কোর্ট বিল্ডিং পার হয়ে পাহাড়ের মাথায় ডিসি অফিস। সিঁড়ি বেয়ে গোলকধাঁধায় পৌঁছে গেলাম। কিছুতেই বুঝতে পারছি না কোথায় যাব। ঘুরে ঘুরে আমার ঢাকার বন্ধু আমাদের একটা রুমে নিয়ে পৌঁছালেন। বহু কথা বিনিময়ে পর হবে না হবে না করতে করতে তিন হাজার টাকার সিলসহ ভেরিফিকেশন হয়ে গেল সম্ভবত বেলা দুইটার দিকে।

এরপর হেঁটে গেলাম ভূমি অফিসে। তাঁরা সাফ বলে দিলেন, দুই দিনের আগে হবে না কাজ এবং কেন গ্যারান্টি নেই কিছুর। ঢাকার বন্ধু একজন লোককে ধরে বহু কিছু কপি করিয়ে কাজটা শুরু করাল। তারপর বলল, চল লাঞ্চ খেয়ে আসি। কিন্তু আমাকে এ গোলকধাঁধা থেকে চিরজীবনের জন্য বের হতে হবে। বললাম, তুমি যাও। ততক্ষণে ভাইয়ার কাছ থেকে ভূমি ট্যাক্সের রসিদ, দলিল ইত্যাদি আনা-নেওয়া চলছে, আমি আর আপু বসেছি এক জায়গায়। আমি আসা-যাওয়া করছি ভাইয়ার অফিস আর ভূমি অফিস। মোটামুটি পাঁচটা নাগাদ ভূমি অফিস বন্ধুকে জানালেন পরদিন নম্বর আর সার্টিফায়েড কপি হয়ে যাবে। বন্ধু বলল, ও ঢাকা চলে যাবে পরদিন ভোরে। চট্টগ্রামের বন্ধু এল তখন ভাইয়ার অফিসে নিয়ে যেতে। যাঁরা কিনবেন, তাঁরা আসবেন, রেজিস্ট্রেশনের কাগজ রেডি করতে হবে।

ভাইয়া এত বড় আইনজীবী অথচ কত অমায়িক। যাঁরা বাসাটা কিনবেন, তাঁরা এলেন। বললেন, আমার ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন ভেরিফাই করা লাগবে। কাজটা পরদিনের জন্য রেখে আমরা হোটেলে ফিরলাম রাত নয়টায়। চট্টগ্রামের বন্ধু আর বন্ধুপত্নী এল। কথা ছিল সব বন্ধুকে নিয়ে আমরা রাতে কোথাও বসব কিন্তু ততক্ষণে জেটল্যাগ আর ক্লান্তি পেয়ে বসেছে আমাকে।

ভ্যালেন্টাইনস ডে ডিনারে গেলাম তিনজন। বোন ওর হাবি আর বাচ্চা ছাড়া, বন্ধু ও ওর বউ আর বাচ্চা ছাড়া আর আমি বাচ্চাদের কয়েক হাজার মাইল দূরে রেখে প্রায় অচেনা এক শহরে। ইংরেজি গান গাইছেন গায়ক, আমার মনে বাজছে:
Don’t stop, never give up
Hold your head high and reach the top
Let the world show what you have got
Bring it back to you.

রাত তিনটা থেকে অনেক চেষ্টা করেও ট্যাক্স আইডি অনলাইনে ভেরিফাই করতে পারলাম না। সকালে নাশতা খেয়ে চেকআউট করলাম আমরা। লাগেজ গাড়িতে তুলে চট্টগ্রামের বন্ধুর সঙ্গে ট্যাক্স অফিসে গিয়ে চার বছরের বকেয়া ট্যাক্স দিলাম। যাঁরা কিনবেন, তাঁদের সঙ্গে বহু ফোনকল বিনিময়ে ট্যাক্স আইডি ভেরিফিকেশন হলো। এমন সময় ভাইয়ার লোক জানালেন ভূমি অফিস কাগজ দিচ্ছে না। ঢাকার বন্ধুকে আবার কল দিলাম। চরম উৎকণ্ঠার কয়েক ঘণ্টা হেল, শেষমেশ ও কল করে তিনটার সময় বলল, তুমি কাগজ তোলার লোক পাঠাও। কাজ হয়ে গেছে।

আমি, আপু আর চট্টগ্রামের দুই বন্ধুসহ গেলাম আইনজীবী ভাইয়ের অফিসে। যাঁরা বাড়ি কিনবেন, ওনারা ১৫ মিনিট দেরি করে এসেছেন, হেঁটে গেলাম রেজিস্ট্রি অফিসে। তারা জানালেন, রেজিস্ট্রার সাহেব চলে গেছেন আজকে দিনের মতো। বৃহস্পতিবার এটা, অনেক মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় রেজিস্ট্রার সাহেবকে আবার কমিশন করে আনা হলো। আমি পুরো সময় ঠায় দাঁড়িয়ে কাজগুলো করে পে-অর্ডার হাতে নিয়ে ছয়টায় ভাইয়ার অফিসে বসলাম সবাইকে নিয়ে। দেখি মাথা একটু একটু ঘুরে।

বাইরে হাঁটতে গিয়ে রেস্টরুমের সামনে একটা চেয়ারে আবার বসলাম। কেউ আছেন ভেতরে কিন্তু মাথা ঘুরেই চলেছে। একজন ভদ্রমহিলা ছিলেন কাছে। ওনাকে বললাম, আমি হাঁটি যদি একটু ভালো লাগে। এরপর আর জানি না, জেগে উঠলাম মাথায় যখন অনেক পানি ঢালা হচ্ছে তখন। আপু পালস দেখছে। তিন-চার মিনিট পর চোখের অন্ধকার কাটল, গেলাম ভাইয়ার অফিসে, কাগজ, পে-অর্ডার নিয়ে বোন আর বন্ধুসহ বঙ্গবন্ধু টানেল দেখে বিমানবন্দরে পৌঁছালাম রাত আটটায়। বিমানবন্দরে দেখি বাঁ পাশে রিবসে তীব্র ব্যথা, ভাবলাম মাসল পুল হয়েছে। ওষুধ খেলাম।

অতঃপর আবার ৪৫ মিনিটের বিমানভ্রমণ। লাগেজ এল, আব্বু আম্মির বাসায় পৌঁছে শাওয়ার নিলাম রাত সাড়ে ১১টায়। আমি ঢাকায় ঘুমাই বাঁ দিকে ফিরে মায়ের পেটে হাত গিয়ে। কিন্তু এবার আর তা পারিনি। বুঝলাম রিব ভেঙেছে। পরের ১০ দিন তীব্র ব্যথা, ওষুধ, বন্ধুদের সঙ্গে বাসায় একটু গল্প করে ব্যথা ৭০ শতাংশ কমল। ১০ দিন পর প্রায় ২৩ ঘণ্টা জার্নি করে লস অ্যাঞ্জেলেস পৌঁছালাম। পথে অচেনা পিচ্চি কাপল ফ্যামিলির মতো দুবাই বিমানবন্দর পর্যন্ত সঙ্গে থাকল। সব জায়গায় পোর্টার পেলাম। বাসায় এসে বাবু বলল, মা চল হাসপাতালে। বললাম, বাবা আজকে পারব না।

দুই দিন পর গেলাম, এক্স-রে করে তাঁরা বললেন, চার থেকে ছয় সপ্তাহ লাগবে হিল হতে। হাঁটাহাঁটি ছাড়া কিচ্ছু করা যাবে না। শুনলাম, ব্যথা ৯০ শতাংশ কমে গেল মাসখানেকের মধ্যে। ধৈর্য আর সংযম যা সিয়াম সাধনা আমারে এত বছরে শিখিয়েছে, তার ফল পেলাম। জীবনের নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে কিন্তু আমি তৈরি। (পরী কন্যাকে দেখতে গিয়ে টোল রোডে ফাইন খেয়েছি, একটা পার্কিংয়ে পাঁচ মিনিটের জন্য দাঁড়িয়ে পার্কিং টিকিট খেয়েছি, ট্যাক্স সিজন আসছে, কোটি কোটি কাগজ তৈরি করতে হচ্ছে)।

আজকে সাদি মহম্মদের (বরেণ্য রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ ১৪ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় মারা গেছেন)) অকালপ্রয়াণে মন ভীষণ খারাপ হয়েছে। তাঁর ভরা কণ্ঠের গান আর কখনো শুনব না। যাঁরা বিষণ্নতার মাঝে আছেন, তাঁদের জন্য এ লেখা। সুখ বা দুঃখ কিছুই জীবনে চিরস্থায়ী না। চিকিৎসা করে হোক, থেরাপি করে হোক (আমার জন্য লেখালেখি, গান, নামাজ আর রোজা থেরাপি), মেডিটেশন করে হোক ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠুন। ছোট্ট জীবন অনেক সুন্দর।

  • দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]