বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে চীনের যুগান্তকারী ৮ অর্জন
২০২১ ছিল গোটা বিশ্বের জন্যই একটি কঠিন বছর। সে বছরও বিশ্ববাসীকে কোভিড মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। মহামারির বিরুদ্ধে মানবজাতির লড়াইটা শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের শেষ দিকে। বলতে গেলে গোটা ২০২০ সালটা গেছে কোভিডের আক্রমণ সামলাতেই। এ সময় বিশ্বের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে; মহামারির বিভিন্ন ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছে কোটি কোটি আদমসন্তান, মারা গেছেন লাখ লাখ মানুষ।
মহামারির প্রথম শিকার হয় চীন। কিন্তু চীনা বিজ্ঞানী, জনগন ও সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টায় দেশটি সে আঘাত অবিশ্বাস্য কম সময়ে সামলে নেয়। ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকটা মহামারির বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াইয়ে কেটেছে চীনের; চীনা জনগণকে সহ্য করতে হয়েছে কঠিন লকডাউন, মেনে চলতে হয়েছে মহামারি-প্রতিরোধক কঠোর বিধিনিষেধ। কিন্তু তার ফল পেয়েছে তারা হাতে হাতে। মাত্র কয়েক মাসে ১৪০ কোটি মানুষের দেশ চীনে মহামারি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আর তাই এখন পর্যন্ত, মহামারি শুরুর প্রায় আড়াই বছর পরে এসে, চীনে কোভিডে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়ায়নি; মৃতের সংখ্যাও ছাড়ায়নি পাঁচ হাজারের কোঠা!
২০২১ সালেও বাকি বিশ্বের মতো চীনকে মহামারি-প্রতিরোধক লড়াই অব্যাহত রাখতে হয়েছে। এ লড়াইয়ে চীনা জাতিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। ২০২১ সালে কোভিডের একাধিক নতুন ধরন বিশ্বে তাণ্ডব চালায় (এবং এখনো চালাচ্ছে)। কিন্তু সেসব ধরন চীনে সুবিধা করতে পারেনি। মহামারির মধ্যেই চীন, এক বছর আগে, সম্পূর্ণভাবে হতদারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে; মহামারির মধ্যেই চীন ২০২১ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে অর্জন করেছে যুগান্তকারী বেশ কয়েকটি সাফল্য। এর মধ্যে ১০টি অর্জন নিয়ে আমি এখানে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করব।
১.
গভীর সমুদ্রে বিশ্বের প্রথম এক লাখ টন ওজনের অর্ধডুবন্ত তেল-গ্যাস উত্পাদন ও সংরক্ষণ প্ল্যাটফর্মটির নাম ‘শেনহাই ইহাও’, যার বাংলা অর্থ ‘গভীর সমুদ্র ১ নম্বর’। চীনের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি এই প্ল্যাটফর্ম আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে ২০২১ সালের ২৫ জুন। ‘শেহাই ইহাও’-এর অবস্থান চীনের হাইনান দ্বীপের ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে, দক্ষিণ চীন সাগরে। প্ল্যাটফর্মটি ২০১৪ সালের আগস্টে আবিষ্কৃত চীনের নতুন সামুদ্রিক গ্যাসক্ষেত্র ‘লিংশুই ১৭-২’ থেকে গ্যাস উত্তোলন করবে। সেই লক্ষ্যে ওই ২৫ জুন ড্রিলিং শুরু হয়। এই গ্যাসক্ষেত্রে শত শত কোটি ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত আছে। আর বছরে ‘শেনহাই ইহাও’ আনুমানিক ৩০০ কোটি ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনের ক্ষমতা রাখে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০৬০ সালের মধ্যে চীনকে কার্বন-নিরপেক্ষতা (কার্বন নিউট্রালিটি) অর্জনে ব্যাপকভাবে সাহায্য করবে ‘শেনহাই ইহাও’।
২.
২০২১ সালেই বিশ্ব রেকর্ড গড়ে চীনের মানববাহী ডুবো-গবেষণাগার ‘ফেনতৌচ্য’(Fendouzhe)। বাংলায় এই ডুবো-গবেষণাগারের নামের অর্থ দাঁড়াবে ‘সংগ্রামী’। ২০২১ সালের ৫ ডিসেম্বর এটি গভীর সমুদ্রে ৫৩ দিনের মিশন শেষে হাইনান প্রদেশের সানইয়া সমুদ্রবন্দরে ফিরে আসে। এই ৫৩ দিনে ফেনতৌচ্য সমুদ্রের গভীরে ২১ বার ডাইভ দিয়েছে; বহন করে নিয়ে গেছে মোট ২৭ জন বিজ্ঞানীকে। প্রতিটি মিশনে ডুবো-গবেষণাগারটি সমুদ্রের ১০ হাজার মিটারের বেশি গভীরে ডুব দিয়েছে, যা একটি বিশ্ব রেকর্ড। সমুদ্রের গভীরে যাওয়া বিজ্ঞানীর সংখ্যাও বিশ্বের সর্বোচ্চ। বলা বাহুল্য, ফেনতৌচ্য সমুদ্রের সবচেয়ে গভীরে ডুব দিতে সক্ষম মানববাহী ডুবো-গবেষণাগার। এটি একসঙ্গে তিনজন বিজ্ঞানী বহন করতে এবং প্রতিটি মিশনে টানা ১০ ঘণ্টা সচল থাকতে পারে।
৩.
সবাই জানেন, দ্রুতগতির রেলপথ ও দ্রুতগতির ট্রেনের জন্য চীন বিখ্যাত। বিশ্বে যত দ্রুতগতির রেলপথ রয়েছে, তার প্রায় তিন-চতুর্থাংশই চীনে অবস্থিত। চীনের দ্রুতগতির ট্রেনগুলো ঘণ্টায় ৩৫০ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারে। তবে এই গতি বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। ২০২১ সালের ২০ জুন চীন সফল পরীক্ষা চালায় ঘণ্টায় ৬০০ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম ম্যাগলেভ (maglev) ট্রেনের। চীনের শানতুং প্রদেশের ছিংতাও-এ নতুন ‘ম্যাগলেভ পরিবহনব্যবস্থা’ পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়। চীনের নিজস্ব প্রযুক্তিতে গড়ে তোলা এই ব্যবস্থা দেশটির রেল-যোগাযোগ খাতে একটি যুগান্তকারী অর্জন। ভবিষ্যতে এই ব্যবস্থার ব্যাপক ব্যবহার চীনের তথা বিশ্বের পরিবহন খাতে নতুন বিপ্লব সৃষ্টি করবে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এই মুহূর্তে পৃথিবীর স্থলপথে চলাচলকারী সবচেয়ে দ্রুতগতির যান হচ্ছে চীনের এই ম্যাগলেভ ট্রেন।
৪.
মহাকাশ-গবেষণায় চীনা বিজ্ঞানীদের সাফল্য এখন আর নতুন কোনো বিষয় নয়। চীন চাঁদ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনেছে; নিজস্ব প্রযুক্তিতে এককভাবে প্রায় সম্পূর্ণ করে এনেছে মহাকাশকেন্দ্র নির্মাণের কাজ। পাশাপাশি চীন মঙ্গল গ্রহেও পাঠিয়েছে মহাকাশযান। ২০২১ সালের ১৫ মে চীনের মঙ্গলযান মঙ্গল গ্রহের মাটি স্পর্শ করে। মঙ্গলে এর আগেও অন্য দেশের মহাকাশযান গিয়েছে। তবে একটি মিশনে মঙ্গল গ্রহকে প্রদক্ষিণ করা ও পরে গ্রহটিতে মঙ্গলযানের অবতরণ ঘটিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে চীন। থিয়ানওয়েন-১ নামক চীনা মঙ্গলযানটি পৃথিবী থেকে যাত্রা শুরু করেছিল ২০২০ সালের ২৩ জুলাই।
৫.
আগেই বলেছি, চীনের নিজস্ব মহাকাশ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ বর্তমানে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ কাজের অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ১৭ জুন চীনের মানববাহী মহাকাশযান শেনচৌ-১২ উৎক্ষেপণ করা হয়। ওই দিনই মহাকাশযানের তিন নভোচারী চীনের নির্মাণাধীন মহাকাশকেন্দ্র থিয়ানকংয়ের মূল অংশ থিয়েনহ্য-তে প্রবেশ করেন। তাঁরাই ছিলেন চীনের মহাকাশ কেন্দ্রের প্রথম বাসিন্দা। নভোচারীরা সেখানে ৯২ দিন অবস্থান করে ১৭ সেপ্টেম্বর নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। মহাকাশ কেন্দ্রে অবস্থানকালে তাঁরা দুইবার মহাশূন্যে পদচারণ করেন ও বিভিন্ন কাজ সফলভাবে শেষ করেন। তাঁরা ফিরে আসার পর, পরিকল্পনা অনুসারে, ২০২১ সালের ১৬ অক্টোবর শেনচৌ-১৩ মানববাহী মহাকাশযান উত্ক্ষেপণ করে চীন। এবার নভোচারীদের মধ্যে আছেন একজন নারীও। তাঁর নাম ওয়াং ইয়াফিং। ৪১ বছর বয়সী ওয়াং ৮ নভেম্বর চীনের প্রথম নারী নভোচারী হিসেবে মহাশূন্যে পদচারণ করেন। পরে চীনা নভোচারীরা ২৭ ডিসেম্বর দ্বিতীয়বার মহাকাশে পদচারণ করেন এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কাজ আঞ্জাম দেন। এই তিন নভোচারী মহাকাশ কেন্দ্রে অবস্থান করবেন ছয় মাস।
৬.
২০২১ সালে চীনা বিজ্ঞানীরা, বিশ্বে প্রথমবারের মতো, কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস থেকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে শ্বেতসার সংশ্লেষণ (synthesizing starch) করার উপায় আবিষ্কার করেন। সংশ্লিষ্ট গবেষণাটি পরিচালনা করেন চীনের থিয়েনচিন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল বায়োটেকনোলজি এবং চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের বিজ্ঞানীরা। পরে তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফল ‘সায়েন্স’ নামক বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান জার্নালের অনলাইনে সংস্করণে প্রকাশিত হয় ২৪ সেপ্টেম্বর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এ কৌশল শিল্পের স্তরে কাজে লাগানো যায়, তবে শ্বেতসারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি-উপাদান ও শিল্প-উপাদানের উত্পাদনের ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হবে। তখন শ্বেতসার উত্পাদনের জন্য বিপুল পরিমাণ মিষ্টি আলু ও ভুট্টার মতো শস্যের চাষ ও প্রক্রিয়াকরণ প্রয়োজন হবে না। এতে বিপুল পরিমাণ পানি, সার ও আবাদি জমি সাশ্রয় হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, তখন পৃথিবীর পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর অন্যতম গ্রিনহাউস গ্যাস ও শিল্পবর্জ্য কার্বন ডাই-অক্সাইডকে পুনর্ব্যবহার করা যাবে এবং একে ভোগ্যপণ্যে রূপান্তর করা সম্ভব হবে।
৭.
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গোটা বিশ্ব একজোট। তারই ফল প্যারিস জলবায়ু চুক্তি। এ ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই চীন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় চীনের সরকার গ্রহণ করেছে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। পরিকল্পনা অনুসারে, ২০৩০ সালের পর থেকে দেশটি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ক্রমাগত কমিয়ে যাবে এবং ২০৬০ সালের মধ্যে পুরোপুরি কার্বন-নিরপেক্ষতা অর্জন করবে। দেশটি এ লক্ষ্য অর্জনে অনেক আগেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। চীনে নতুন ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নতুন ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানিচালিত গাড়ি এখন চীনের রাস্তায় চলাচল করে। পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উত্পাদনের জন্য চীন বিশ্বের বৃহত্তম পানিবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে। ২০২১ সালের ২৮ জুন এ কেন্দ্রের প্রথম দুটি ইউনিট বিদ্যুৎ উত্পাদন শুরু করে। চীনের এ পানিবিদ্যুৎকেন্দ্রের নাম পাইহ্যথান (Baihetan) পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটি দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের চিনশা নদীর ওপর নির্মিত হচ্ছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৩ হাজার ৪০৭ কোটি মার্কিন ডলার। এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। চীনের কার্বন-নিরপেক্ষতা অর্জনের লক্ষ্য পূরণে এই প্রকল্প তাত্পর্যপূর্ণ অবদান রাখবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
৮.
নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পথে লংমার্চ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। গৃহযুদ্ধের সময় চেয়ারম্যান মাও সে–তুংয়ের নির্দেশে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির রেড আর্মি এ লংমার্চে অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধজয়ের কৌশল হিসেবে রেড আর্মির অনেক দল ভিন্ন ভিন্ন রুটে লংমার্চে অংশ নেয়। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত রুটটি হচ্ছে চিয়াংসি প্রদেশ থেকে শাআনসি প্রদেশ পর্যন্ত। এ রুটে লংমার্চ শুরু হয় ১৯৩৪ সালের অক্টোবরে এবং শেষ হয় ১৯৩৫ সালের অক্টোবরে। লংমার্চের এ কৌশল কাজে লেগেছিল এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তত্কালীন ক্ষমতাসীন দল কুওমিংথাংয়ের আর্মিকে পরাজিত করে নয়া চীন প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। সেই ঐতিহাসিক লংমার্চের নামানুসারেই চীনের পরিবাহক-রকেটের নাম রাখা হয় ‘লংমার্চ’। ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর ছিল চীনের লংমার্চ পরিবাহক-রকেট সিরিজের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিন। এদিন সকালে এ রকেটের ৪০০তম উৎক্ষেপণ সম্পন্ন হয়। ২০২১ সালে লংমার্চ রকেট সিরিজের ৪৮টি সফল মিশন সম্পন্ন হয়, যা একটি বিশ্ব রেকর্ড। আবার ২০২১ সালে চীন সব মিলিয়ে মহাকাশে ৫৫টি রকেট উৎক্ষেপণ করেছে। এ ক্ষেত্রে ৪৫টি রকেট উৎক্ষেপণ করে দ্বিতীয় স্থানে ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি), বেইজিং