শুধু বয়স বা সার্টিফিকেট না দেখে বরং যোগ্যতা দেখুন

প্রতীকী ছবি: প্রথম আলো

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ৭ মে ১৮৬১ সালে হলেও বিশ্ববাসীর কাছে তাঁর পরিচয় ফুটে ওঠে ১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিসেবে। তিনি ছিলেন বাঙালি ও অবিভক্ত ভারতবাসী। বাংলা ভাষায় তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে এবং নোবেল পুরস্কার পান ১৯১৩ সালে। শিক্ষার আলোতে আলোকিত হয়েছিল একজন ব্যক্তি, একটি ভাষা, একটি জাতি, একটি দেশ ও একটি উপমহাদেশ।

বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়। এখন সেই ফল খেতে কেমন বা তার গুনাগুণ কেমন, তা নির্ভর করছে যে বা যারা এই ফল খাবে, তাদের ওপর। গাছের কৃতিত্ব খুব কমই শুনেছি জীবনে। তবে ফলের প্রশংসা শুনেছি অনেক। এটা প্রকৃতির একটি বিশেষ নিয়ম।

যোগ্যতা ঠিক তেমনই একটি বিষয়, যার মাধ্যমে ব্যক্তি, সমাজ, দেশ, এমনকি মহাদেশের গুণাগুণ ফুটে ওঠে।

মানবজাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হলো প্রত্যেকেই তার নিজ ব্যক্তিত্বে অসাধারণ। একটু সাহায্য ও সহানুভূতি পেলে তারা তাদের মেধার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম। তবে তার জন্য দরকার ব্যক্তির আগ্রহ এবং চেষ্টা। এখন যদি সেই চেষ্টাই না থাকে, তাহলে হবে না কিছু করা। এখন প্রশ্ন, কীভাবে নিজেকে বিক্রি করা সম্ভব? আমার ভাবনা থেকে কিছু তথ্য এখানে শেয়ার করছি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু লেখালেখি করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি তাঁর লেখাকে ইংরেজদের সাহায্যে অনুবাদ করেন। পরে গীতাঞ্জলির ওপর নোবেল পুরস্কার এবং বিশ্বদরবারে তাঁকে বিশ্বকবি হিসেবে বিক্রি করেন।

আমরা নিজেরাও কিন্তু প্রতিদিন আমাদের বিক্রি করতে চেষ্টা করছি জানা বা অজানা অবস্থায়। এখন বিক্রি করতে গিয়ে যেন ভারসাম্য হারিয়ে না ফেলি, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেমন বাংলাদেশে বয়স ৩০ সীমা পার হলে সরকারি চাকরি করা যাবে না। এটা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। এটার কোনো মানে হয় না। দেশকে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর মধ্য দিয়ে গড়তে হলে জনগণের বয়স নয় বরং নজর দিতে হবে তাদের দক্ষতা এবং তারা যে কাজের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে, সেটা আছে কি না। চাকরিতে মেয়াদ নির্ধারিত শুধু সেখানেই প্রয়োজন, যেখানে শারীরিক দক্ষতা দরকার একটি সুনির্দিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে। বাকি সব ক্ষেত্রে বয়সের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে বরং দক্ষতার দিকে নজর দিতে হবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেমন সুইডেনে ৬৫ বছর পর্যন্ত যে কেউ যেকোনো কাজে যোগ দিতে পারেন যোগ্যতানুসারে। সেটা সরকারি বা বেসরকারি বলে কথা নেই। এখন যদি শিক্ষার আলো বিবেককে সঠিক পথে পরিচালিত করতে না পারে, তখন বিবেক ভালো-মন্দের পার্থক্য হারিয়ে ফেলবে। হারিয়ে ফেলবে তার ভারসাম্যতা। তখন মানবজাতি দানবে পরিণত হবে। কারণ শিক্ষা যখন আলোময় না হয়ে কালো রূপ ধারণ করে, তখন তা আর সুশিক্ষা দিতে পারে না, দেয় কুশিক্ষা। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

আজ তুলে ধরব বেচাকেনার ওপর জীবনের অভিজ্ঞতা। তার আগে জানি একজন গুণী লোকের কিছু মূল্যবান তথ্য। ওয়ারেন অ্যাডওয়ার্ড বাফেট একজন মার্কিন ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী এবং জনহিতৈষী ব্যক্তি। জীবনে সফলতা পেতে ওয়ারেন বাফেটের অসাধারণ কিছু পরামর্শ রয়েছে। যেমন ‘সততা খুবই দামি একটি উপহার, তা কখনোই সস্তা লোকের নিকট থেকে আশা করা ঠিক হবে না। কখনোই সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখা উচিত নয়। পা পানিতে ডুবিয়ে কখনোই নদীর গভীরতা মাপা ঠিক নয়, যা প্রয়োজন নেই তা ক্রয় করলে শিগগিরই যা প্রয়োজন তা বিক্রি করতে হবে। কখনোই আয়ের একমাত্র উৎসের ওপর নির্ভর করা ঠিক হবে না। বিনিয়োগের মাধ্যমে আরেকটি উৎস তৈরি করা ভালো এবং খরচের পর যা অবশিষ্ট থাকে তা সঞ্চয় না করে বরং সঞ্চয়ের পর যা অবশিষ্ট থাকে তা খরচ করা শিখো’। শেয়ারবাজার এমন একটি ব্যবসা, যেখানে নানা মত রয়েছে। ধর্মীয় দিক দিয়ে অনেকে অনেক রকম ধারণা দিয়ে থাকেন। আমার মত বা দ্বিমত নিয়ে আলোচনা করতে এ লেখা নয়। মূলত বর্তমান বিশ্বের সবকিছুই শেয়ারবাজারে বেচাকেনা হচ্ছে, যা ভালো তার চাহিদা যেমন বেশি, বেচাকেনাও হচ্ছে ভালো। যার কারণে কোটি কোটি লোক প্রতিদিন বিনিয়োগ করছেন তাঁদের পুঁজি।

আজ লাঞ্চ মিটিংয়ে অধ্যাপক মান্নান মৃধার সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। যেহেতু আমি বাংলাদেশের শিক্ষার ওপর লিখি। তাই কথা হতেই তিনি বললেন, দেশে ভূরি ভূরি বেকার ছেলেমেয়ে রয়েছে, যাদের কর্মের কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ বিশ্বে অনেক দেশ কর্মীর অভাবে শিল্প, কলকারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে।

টিভিতে খবর দেখার সময় শেয়ারবাজারের কিছু খবর নজরে পড়ে গেল। তখন মনে পড়ে গেল মান্নান মৃধার কথা। মনে পড়ে গেল বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার কথা। বাংলাদেশের জনসংখ্যার কথা, বেকারত্বের কথা। একই সঙ্গে ভাবনাতে এল বাংলাদেশ কী করতে পারে, এমন একটি সময়ে যখন পৃথিবীর কিছু দেশ খুঁজছে দক্ষ কর্মী। অথচ রয়েছে আমাদের দেশে লাখ লাখ বেকার যুবক। তাদের হয়তো নেই সেই যোগ্যতা, যা খুঁজছে পৃথিবী! তাই বলে কি সম্ভব নয় প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা? অবশ্যই তা সম্ভব। বর্তমানে সুইডেনের দক্ষিণাঞ্চলে খনিজ খননে বিশ্বের অন্যান্য দেশে অটো মোবাইল, এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ইন্ডাস্ট্রিতে লোক নিয়োগের জন্য তারা উঠেপড়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ কর্মীর অভাবে তারা ইন্ডাস্ট্রি চালাতে পারছে না। সেন্ট্রাল ইউরোপের অনেক দেশের মতো যেমন চেক রিপাবলিক একটি দেশ। এর চারপাশের দেশগুলো হলো অস্ট্রিয়া, জার্মানি, পোল্যান্ড ও স্লোভাকিয়া। দেশটি ২০০৪ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অধিভুক্ত হয় এবং ২০০৭ সালে সেনজেন স্টেটে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক মহোদয়গণ বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে পারেন যেমন সুইডেন বা চেক রিপাবলিকের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। পৃথিবীর অনেক দেশে বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী কর্মীর অভাব দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশের উচিত চাহিদাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে এ ধরনের সুযোগ নেওয়া। বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি এবং বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা বের করে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিতে পারে। দেশের বেকার শিক্ষার্থীদের চাহিদাভিত্তিক এবং অন দ্য জব ট্রেনিংয়ের মধ্য দিয়ে প্রশিক্ষণের সুব্যবস্থা করে সুইডেন চেক রিপাবলিকের মতো দেশের সঙ্গে ব্যবসায়ের সমন্বয় ঘটানো মিরাকেল কিছু নয়। যারা দেশের দায়িত্বে রয়েছে, তারা যদি সত্যিকারের চেষ্টা করে। আমার বিশ্বাস তারা পারবে পরিবর্তন আনতে এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশিদের বিক্রি করা শিখতে হবে সু এবং সঠিক শিক্ষাসহ চাহিদাভিত্তিক প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে।

মডেল: নুসরাত, হাদী ও ইয়াসফি
ছবি: খালেদ সরকার

আমি আমাকে বিক্রি করেছিলাম আমার মতো করে ১৯৮৫ সালে। যেদিন বিদেশে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলাম সুইডেনে, সেদিন। তখন থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম পৃথিবীটা একটা বেচাকেনার জায়গা। দরকারে কেনা, প্রয়োজনে বেচা। সেই থেকে লেগে আছি বেচাকেনার ওপর। দরকারে কেনা, আর প্রয়োজনে বেচা, সঙ্গে যোগ্যতা, সুশিক্ষার সমন্বয় ঘটিয়ে নিজেকে বিক্রি করতে শেখা হোক আগামী প্রজন্মের প্রশিক্ষণ।

আমি প্রশিক্ষণকে এভাবে দেখছি, সময়ের সঙ্গে কিছু কিছু পেশা হারিয়ে যাবে কিংবা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু এখনকার শ্রমবাজার যে দ্রুত রূপান্তরের মুখোমুখি হচ্ছে, তা হয়তো আমাদের ধারণার চেয়েও বেশি এবং তা রূপান্তরিত হয়েই যাচ্ছে দিন দিন। ভবিষ্যতের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স একটি চাকরির প্রকৃত অর্থ কী, তা পুনরায় সংজ্ঞায়িত করতে পারবে। আপনি নিশ্চয়ই টেক্সট রোবট চ্যাট জিপিটি সম্পর্কে শুনেছেন, যেটি তাৎক্ষণিকভাবে যেকোনো প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারে। AI প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে এবং এটি সবার মুখে মুখে একটি বিষয় হয়ে উঠেছে এবং এটি শ্রমবাজারকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। অন্যান্য বিষয় হলো এটি ঐতিহাসিকভাবে দ্রুত চলছে, জ্ঞান এবং তথ্য-নিবিড় কাজগুলো AI-এর কাছে উন্মুক্ত করা হয়েছে। AI-এর গতি বাড়ছে, মানুষকে আরও সতর্ক হতে হবে। এআই প্রযুক্তি কল্যাণের দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিবাচক, কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি নেতিবাচক আর্থসামাজিক পরিস্থিতির কারণ হতে পারে। নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান এবং মজুরি আরও খারাপ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এটি শিক্ষার স্তরের ওপর নির্ভর করবে। মানুষকে সাহায্য করার জন্য তৈরি করা প্রযুক্তি সমাজকে এমনভাবে পরিবর্তন করবে যে কিছুই একই রকম থাকবে না আর। এটা দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে সময়ের মাঝে, আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে প্রযুক্তি মানুষকে সাহায্য করার জন্য তৈরি করা হয়েছে এবং আমাদের আরও ভালোভাবে এটি উপলব্ধি করতে হবে। বাংলা ভাষাকে সঠিকভাবে অনুবাদ এবং ব্যবহার করতে AI এখনই কাজে লাগাতে হবে। ব্যয়বহুল এ পাঠ্যপুস্তকে, অর্থ, সময় অপচয় করা বন্ধ করে AI-এর ওপর গুরুত্ব দিন।

প্রতিদিন আমি আমার মনের মধ্যে একটি সহজ চিন্তা নিয়ে আমার দিন শুরু করি যে আজ আমি যেখানেই যাই না কেন এবং যা–ই করি না কেন, আমি নিজের এবং অন্যদের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ, প্রেমময় এবং আনন্দময় জীবন তৈরি করব। আমি যদি দিনে শতবার এই কাজটি করতে ব্যর্থ হই, তাতে কি আসে যায়? একজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মানুষের জন্য ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। আমি শতবার ব্যর্থ হলেও এই ব্যর্থতার মাঝে শত শত নতুন কিছু শিখব। আমি সত্যিই যদি প্রতিজ্ঞা করি এবং যত্নশীল হই, সেটা পূর্ণ করতে এবং আমি নিজেকে যদি এইভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করি, তাহলে আমার মন সংগঠিত হবে, একবার আমার মন সংগঠিত হলে, আমার চিন্তাভাবনা এবং আবেগগুলোও সংগঠিত হবে। আমার শক্তিও একই দিকে সংগঠিত হবে। একবার আমার মন, মস্তিষ্ক, আবেগ, শক্তি সংগঠিত হলে আমাকে কোনো কিছুই ঠেকাতে বা বাধা দিতে পারবে না, আমার ফোকাস করার ক্ষমতা এত শক্তিশালী হবে যে আমি আমার মনকে শতভাগ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হব। এটা অভূতপূর্ব।


লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

**প্রবাস থেকে দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected] এ।