মাছে-ভাতে বাঙালি ও মাশরুম
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ১২ অক্টোবর দিনটাকে জাতীয় কৃষক দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। আজকাল প্রতিদিন কোনো না কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক দিবসের ভিড়ে সব সময়ে তা খেয়ালও থাকে না। কিন্তু সকালে টিভিতে দেখে আমার ভালো লাগল এ ভেবে যে কৃষকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের খাবার টেবিলে খাবার যোগান দেন।
তাঁদের ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য একটা দিন নির্দিষ্ট আছে। ভারতে ২৩ ডিসেম্বর কিষান দিবস হিসাবে পালিত হয়। বাংলাদেশে এ রকম কোনো নির্দিষ্ট দিন আছে বলে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনো তথ্য পেলাম না। আমার অজ্ঞানতা মাফ করে দেবেন।
এ দেশে এসে আমি কৃষক পরিবারে গেছি, দেখে অভিভূত হয়ে গেছি। আমাদের মতো উন্নতশীল দেশে কৃষক বলতে আমরা দরিদ্র জনজাতির একটা মলিন মুখ দেখতে পাই, তা এখানে দেখলাম না।
আমেরিকাতে প্রতি একরে একটি চাষি পরিবার প্রতি মাসে গড়ে ৮০০ ডলার উপার্জন করে থাকেন। ডলার আর ভারতীয় রুপির বিনিময় মূল্যের হিসাবে তা দাঁড়ায় ৬৫,৬০০ রুপি, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা দাঁড়াবে ৮৮,২০০ টাকা। আমেরিকার কৃষকদের হালহকিকত দেখে মনে হলো, তাঁদের গড় ক্রয়ক্ষমতা, ভারত বা বাংলাদেশের গড় ক্রয়ক্ষমতার থেকে অনেক বেশি। ভারতে একজন কৃষক গড়ে মাসে ১০ হাজার ২১৮ ভারতীয় রুপি উপার্জন করেন, যেখানে বাংলাদেশে একজন কৃষক গড়পড়তা মাসে ৮ হাজার ৫৩৮ টাকা উপার্জন করে থাকেন। কাজেই আমেরিকান কৃষকদের ক্রয়ক্ষমতা অনেক বেশি।
ক্রয়ক্ষমতা হলো একটি দেশের এক একক মুদ্রা দিয়ে কতগুলো পণ্য বা পরিষেবা কেনা যেতে পারে। আর ক্রয়ক্ষমতা সমতা Purchasing Power Parity (PPP) হলো বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বিনিময় মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে একই জিনিস বিভিন্ন দেশে কে কতগুলো কিনতে পারে। ধরে নিন আমেরিকাতে একটি আই-ফোনের মূল্য ১০০০ ডলার। আর ধরে নিন ১ মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য ভারতীয় মুদ্রাতে ৮২ রুপি আর বাংলাদেশি মুদ্রাতে ১১০.২০ টাকা।
তাহলে এই আইফোনটি ভারতে কিনতে গেলে ৮২,০০০ ভারতীয় রুপি, আর বাংলাদেশে কিনতে গেলে ১১০,২০০.০০ টাকা দিয়ে কিনতে হবে। ভারত বা বাংলাদেশের কৃষকদের পক্ষে কিছুতেই তা সম্ভব নয়। অথচ এখানে আমেরিকার কৃষকদের ঘরে ঘরে প্রত্যেকের হাতে হাতে আইফোন আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারত বা বাংলাদেশে যদি সমসংখ্যক লোক এই পণ্যটি কিনতে পারত, তাহলে বলতাম দেশগুলোর মধ্যে ক্রয়ক্ষমতা সমতা (PPP) সমান সমান। বাস্তব তা বলে না। যত দুই দেশের মধ্যে মূল্য স্তরের এ পার্থক্য কমবে, সমতা তত বাড়বে। কবে তা হবে, আমি জানি না।
আমাদের দেশে মুদ্রাস্ফীতি এত লাগামছাড়া যে টাকার দ্রুত এবং ক্রমশ অবমূল্যায়ন হতে থাকে। একটা উদাহরণ দিই। আমেরিকাতে ১৮০০ সালে মার্কিন ডলারের গড় মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ১.৪৪ শতাংশ। শ্রম পরিসংখ্যান ভোক্তা মূল্যসূচক ব্যুরোর তথ্য অনুসারে আজকে পণ্যগুলোর গড় দাম ১৮০০ সালের গড় দামের তুলনায় মোটামুটি ২৫ গুণ বেশি।
এ দিকে ১৯১৩ সালে এক ভারতীয় রুপি ছিল ০.০৯ মার্কিন ডলার আর আজ তা ৮২ মার্কিন ডলার। মানে ৯১১ ভাগ অবমূল্যায়ন হয়েছে। মানে ১৯১৩ সালে একটা পণ্য কিনতে যা ভারতীয় মুদ্রা লাগত তার ৯১১ গুণ মুদ্রা এখন খরচা করতে হবে। বাংলাদেশও এর থেকে কিছু ব্যতিক্রমী নয়। তার ওপরে এ দেশে চাষাবাদে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ভারত ও বাংলাদেশে সেক্ষেত্রে এখনো অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। কাজেই তারা প্রতি একরে যে পরিমাণ ফসল ঘরে তোলে, আমরা তা পারি না।
এমন সব ভাবতে ভাবতে একদিন চলে গেলাম এই ফিলাডেলফিয়ার শহরতলির কাছে কেনেট স্কোয়ার বলে এক জায়গাতে। সেই ১৯৮৬ সাল থেকে এখানে মাশরুম উৎসব (mushroom Festival) হয়ে আসছে। কোভিড-১৯–এর কারণে ২০২০–এ অবশ্য তা বন্ধ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে মে দিবস পালন করা হয় না, তারা সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবারে শ্রমিক দিবস বা লেবার ডে পালন করে থাকে। প্রতিবছর লেবার ডের ঠিক পরের সপ্তাহান্তে সাধারণত এই মাশরুম উৎসব (mushroom Festival) হয়ে থাকে। এ দেশে আসার আগে এ রকম মাশরুম উৎসব আমি দেখিনি। প্রথমবার গেলে একেবারে অভিভূত হয়ে যেতে হয়।
নিজের তোলা ছবি এখানে দিলাম, মনে হয় আপনাদের ভালো লাগবে । উৎসবের প্রশিক্ষণ, সেমিনার শুনে মনে হলো, ভারত বা বাংলাদেশেও এই মাশরুম চাষ করে যথেষ্ট বিকল্প আয়ের সংস্থান করা যায়।
মাশরুম বা ছত্রাক তো আর আজকে নয়, সেই ১ বিলিয়ন বছর ধরে এই পৃথিবীতে আছে। কাজেই তার অস্তিত্ব উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। সবচেয়ে পুরানো যে ফসিল পাওয়া গেছে, তার বয়স মাত্র ২,৪০০ মিলিয়ন বছর আগের। পৃথিবীতে ১৪ হাজার রকমের মাশরুম প্রজাতি আছে, যার মধ্যে কেবলমাত্র ২১৮৯ প্রজাতির মাশরুম মানুষে খেতে পারে। অবশ্য এর মধ্যে ২০০৬ রকমের প্রজাতি সরাসরি খাওয়া যায় আর বাকিদের কাটাকুটি করে পরিষ্কার করে নিয়ে খেতে হবে।
কোনো প্রজাতির মাশরুম এক দিন বাঁচে তো অন্য কোনো প্রজাতি কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। মাশরুমের মধ্যে রঙের বাহার প্রচুর, তবে মাশরুম যত রঙিন, তত বিষাক্ত। আমার বাবা মাটিতে গজিয়ে ওঠা মাশরুম দেখে, কোনটা খাবার আর কোনটা খাবার নয়, তা চিহ্নিত করতে পারতেন। জিনগত সংস্কারে কারণে এই গুণটি আমার নেই!
পৃথিবীতে যত খাওয়ার উপযোগী ছত্রাক বা মাশরুম উৎপন্ন হয়, তার ৯৪ শতাংশই আসে চীন থেকে, বাকি যা ৬ শতাংশ পড়ে থাকল তার উৎপাদনে যথাক্রমে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে। প্রথম দশের মধ্যে ভারত দশম স্থানে। বাংলাদেশের স্থান আমার জানা নেই। তাই এই উৎসবে দাঁড়িয়ে মনে হলো, মাশরুম চাষকে ব্যাঙের ছাতা বলে উড়িয়ে না দিয়ে উদ্যোগ নিলে অর্থ উপার্জনের একটা বিকল্প দিক উন্মোচিত হতে পারে।
খাদ্যগুণ হিসাবে এটি খুব উপকারী, রান্না করা খুব সোজা। এতে প্রচুর পরিমাণে সেলেনিয়াম আছে, যা অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট হিসাবে কাজ করে, কোষকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে, ভিটামিন ডি, বি৬–এ ভরপুর। দামেও সাধারণ লোকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়। কাজেই খাদ্যগুণের বিচারে, এটি বিজ্ঞানসম্মতভাবে চাষ করে বিকল্প উপার্জনের উপায় বাতলে দেওয়া যেতে পারে। শুধু সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগ, বিনিয়োগ, সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দরকার।
আমি নিজে ব্যাঙের ছাতা বা মাশরুম খেতে খুব ভালোবাসি। আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে, আমরা ভেতো বাঙালিরাও সারা পৃথিবীর নানা খাবারের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছি। দৈনন্দিনভাবে মাছে-ভাতে বাঙালির পাতে মাশরুম আসা এখন শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা।
লেখক: ড. অতীশ চক্রবর্তী, প্রাবন্ধিক ও গবেষক, ফিলাডেলফিয়া, যুক্তরাষ্ট্র