ম্যানিটোবায় একখণ্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

গত ২৬ আগস্ট, ২০২৩ শনিবার ছিল ম্যানিটোবায় বসবাসরত ঢাবিয়ানদের জন্য একটা বিশেষ দিন। এদিন ম্যানিটোবার ছোট ছিমছাম শহর নিভারভিলের হেসপেলার পার্কে একত্র হয়েছিলেন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের সাবেক শিক্ষার্থীরা। কমবেশি সব অনুষদের শিক্ষার্থীদেরই ছিল সরব উপস্থিতি। আমরা যেখানেই থাকি না কেন, শিকড় আমাদের টানবেই! এবারের গেটটুগেদারে এসেছিলেন ১৫০ জনের মতো অ্যালামনাই এবং তাঁদের পরিবার। আরও অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নানান ব্যস্ততায় আসতে পারেননি। বেলা ১১টায় রেজিস্ট্রেশন আর নাশতা দিয়ে শুরু হয় দিনের আয়োজন। এরপর ছোট বাচ্চাদের দৌড় দিয়ে শুরু হয় খেলাধুলা, যা শেষ হয় ছেলেদের ডার্ট থ্রুর মধ্য দিয়ে। এবারের আয়োজনের দুপুরের খাবারটা ছিল অতুলনীয়। কারণ, খাবারটা রান্না হয়েছিল আমাদের সিনিয়র অ্যালামনাই সেলিম ভাইয়ের বাসায়। ভাবি এমনভাবে রান্না করেছেন যে মনে হচ্ছিল, আমরা ভাইয়ের বাসায় বসে খাচ্ছি।

দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ হতেই শুরু হয় অ্যালামনাইদের পরিচয়পর্ব এবং স্মরণীয় সব স্মৃতি রোমন্থন! অঞ্জন দা হলেন হাতে গোনা দু-তিনজন সিনিয়র অ্যালামনাইদের একজন। ওনার মানসপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্মৃতির কোনো শেষ নেই, সেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। অ্যালামনাইদের কেউ কেউ পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হিসেবে সরাসরি ম্যানিটোবায় চলে এসেছেন, কেউবা পড়াশোনা শেষ করে এখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, আবার কেউবা আমার মতো পড়াশোনা করছেন। ও হ্যাঁ, আমার পরিচয়ই তো দেওয়া হয়নি! আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১-১২ সেশনে ফলিত পরিসংখ্যানে ভর্তি হয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করি এবং ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক (পরিসংখ্যান) হিসেবে যোগদান করি। পরবর্তী সময়ে উপপরিচালক (পরিসংখ্যান) হিসেবে পদোন্নতি পাই এবং ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শিক্ষা ছুটি নিয়ে বায়োস্ট্যাটিস্টিকসে মাস্টার্স করতে ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবায় আসি।

সত্তা নামের আমাদের ছোট্ট মামণির গান দিয়ে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সত্তাকে সঙ্গ দেয় তার মা মৌসুমী বউদি—মা-মেয়ে মিলে জমিয়ে ফেলে অনুষ্ঠানটাকে। আমাদের উদাস করে দেয় মনির ভাইয়ের গান, আর আমরা হারিয়ে গিয়েছিলাম অনন্তা দিদির গানে। ইসমাইল ভাইয়ের খালি গলায় গাওয়া ‘বাংলায় গান গাই’ গানটা ছিল অসাধারণ আর মনির আবৃত্তি আমাদের আবেগাপ্লুত করে তোলে। মিতা আপার উপস্থাপনা ছিল অসাধারণ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে পুরস্কার বিতরণ করা হয় খেলাধুলায় বিজয়ীদের মধ্যে। তবে এখানকার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ছোট বাচ্চা সবাইকে পুরস্কার দেওয়া, কেউ যাতে নিরাস না হয়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট হলো র‍্যাফেল ড্র। পুরস্কারের চেয়ে র‍্যাফেল ড্রয়ের প্রতিটা ড্রয়ে যে উত্তেজনা, তা অবর্ণনীয়, আর রাসেল ভাই যোগ্য ব্যক্তি, যিনি উত্তেজনা ছড়িয়ে দেন কয়েক গুণ। সবশেষে ছিল প্রীতি ফুটবল ম্যাচ, সিনিয়র বনাম জুনিয়র!

হাসিঠাট্টা আর আড্ডায় কখন যে দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা নামল, টেরই পেলাম না! একটাবারের জন্যও মনে হয়নি, আমরা বাংলাদেশ থেকে সহস্র মাইল দূরে কানাডার ম্যানিটোবায়; মনে হয়েছে, আমরা যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছি। আমরা ভাগ্যবান যে দেশ ছেড়ে এত দূরে এসেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এতগুলো বড় ভাই-আপু, বন্ধুবান্ধব এবং জুনিয়র পেয়েছি। ম্যানিটোবায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিলনমেলা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মিলনমেলা! এই বছরের মতো ঢাবিয়ানদের এই বিশাল মিলনমেলার সমাপ্তি হলো বটে, সিনিয়র-জুনিয়রের যে বন্ধন রয়ে গেল, তা আজীবন অটুট থাকুক। সবশেষে এমন সুন্দর এবং সফল একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য যাঁরা শ্রম দিয়েছেন, তাঁদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
*লেখক: মো: মনিরুজ্জামান মনি, গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট, ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা, উইনিপেগ, ম্যানিটোবা, কানাডা