কত সচেতনতারে

মাতৃভাষায় কথা বলা প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার। আর সেই অধিকার রক্ষার জন্য পৃথিবীতে একমাত্র বাঙালি জাতিই বুকের তাজা রক্ত বিসর্জন দিয়ে রাজপথ রাঙিয়ে ছিল। মহান এ আত্মত্যাগ কখনো ভোলার নয়। শুধু বাঙালি জাতিই নয়, তাদের এ আত্মত্যাগের কথা বিশ্ববাসী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের মাধ্যমে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি ২১ ফেব্রুয়ারি, যা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ করেছে। তাই আমরা বাঙালিরা বাংলা ভাষা নিয়ে যতটা গর্ব করতে পারি, পৃথিবীর অন্য কোনো জাতি তা পারে না।

কিন্তু সালাম, রফিক, জব্বারসহ শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষা শিক্ষাদানে আমাদের শিক্ষকেরা কতটা সচেতন? যদিও শিক্ষক প্রশিক্ষণে শিক্ষাদানে শিক্ষককে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আসুন, কয়েকটা উদাহরণের মাধ্যমে বাংলা ভাষা শিক্ষাদানে আমাদের শিক্ষকদের সচেতনতা পর্যবেক্ষণ করি।

কেস ১

বন্ধুদের আড্ডায় এমন কোনো বিষয় নেই, যা অবতারণা হয় না। তেমনি এক আড্ডায় আমার এক বন্ধু তার হাইস্কুলজীবনের বাংলা ক্লাসের অভিজ্ঞতা শেয়ার করল। সে তখন হাইস্কুলে পড়ে। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পটি তাদের পাঠ্য ছিল। সেখানে একটি বাক্য আছে:
তর্করত্ন বলিলেন, সকালে যাবার সময় দেখে গেছি বাঁধা, দুপুরে ফেরবার পথে দেখছি ঠায় বাঁধা।

এখানে ‘বাঁধা’ শব্দটা হলো মহেশকে বেঁধে রাখা হয়েছে। গফুরের গায়ে জ্বর, তাই সে মহেশকে ঘাস খাওয়ানোর জন্য মাঠে নিয়ে যেতে পারছে না। এটা বোঝার জন্য খুব একটা পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই নিশ্চয়ই!

যা-ই হোক, যিনি তাদের পড়াচ্ছিলেন তিনি এই ‘বাঁধা’কে বোঝালেন, ‘যাত্রাপথে মাঝেমধ্যে ব্যাঘাত ঘটে না, সেটাই আরকি! তখন আমরা কী করি? একটু বসে তারপর আবার রওনা দেই। তর্করত্ন যাওয়ার পথেও বাধা পেয়েছে, ফেরবার পথেও বাধা পেয়েছে। এ জন্য সে একটু বিরক্ত।’

তার শিক্ষক যখন পরের লাইনটা পড়লেন, ‘গোহত্যা হলে যে কর্তা তোকে জ্যান্ত কবর দেবে। সে যে-সে বামুন নয়! কি কোরব বাবাঠাকুর, বড় লাচারে পড়ে গেছি। ক’দিন থেকে গায়ে জ্বর, দড়ি ধরে যে দু-খুঁটো খাইয়ে আনব—তা মাথা ঘুরে পড়ে যাই।’
এইটুকু পড়ার পর তার স্যারের কি মনে হলো কে জানে, শিক্ষক আর তাদের শুধরে দেননি। কিছুটা আমতা-আমতা করে সামনের দিকে এগোতে লাগলেন। তাদের তখন একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
এ তো গেল গল্পের কথা। আসুন, এবার কবিতার কথা বলি।

কেস ২

কোনো এক বাংলার শিক্ষক কবিতা পড়াচ্ছেন। কবিতার লাইনটি এই রকম: কপোল ভিজিয়া গেল দুই নয়নের জলে।

এটা শোনার পর একজন ছাত্র জিজ্ঞেস করল: স্যার, কপোল মানে কী?
শিক্ষক বললেন: গাধা নাকি! কপোল মানে জানো না! কপোল অর্থ হলো কপাল..কপাল!

ছাত্রটি একটু ভেবে বলল: স্যার, তাহলে নয়নের জলে কপোল ভেজে কী করে? কারণ চোখের জল তো আর উল্টো দিকে গড়ায় না!

এবার শিক্ষক পড়ে গেলেন বেকায়দায়। মোদ্দাকথা হলো, শিক্ষক নিজেও কপোলের অর্থ জানেন না। ছাত্রদের কাছে নিজের না জানার ব্যাপারটা প্রকাশ করা মোটেও ঠিক হবে না। তাই তিনি খানিকক্ষণ ভেবে বললেন, পরের লাইনটি না বলতেই তোমাদের এত প্রশ্ন কেন? শিক্ষক রেগে গেলেন! অর্থাৎ কোনো কিছু সঠিকভাবে না জানলে বা সদুত্তর না থাকলে রেগে যাওয়াই মহৌষধ!

এবার তিনি সহাস্যে বললেন, পরের লাইন হলো: পা দুটি বাঁধা ছিল কদমের ডালে।
স্যার এইটা পড়েন আর হাসেন। স্যারের ভাবটা এমন যে, ‘এইবার বুজসছ ব্যাটা, কেন চোখের পানি উল্টো দিকে গড়ায়?’

সেই ছাত্র বেচারার আর কোনো প্রশ্ন রইল না। পা ওপরে বাঁধা থাকলে কপাল তো ভিজবেই!

আসল কথা হলো, কপোল মানে চিবুক বা গাল। আর কপোল মানে যে চিবুক বা গাল, সেটা শিক্ষক নিজেও জানতেন না! তাই রেগেমেগে অস্থির হওয়াই হলো সহজ, কেউ ধারেকাছেও ভিড়তে পারবে না, প্রশ্ন করার তো প্রশ্নই আসে না!
আসলে আমরা অনেকেই গল্পের সেই শিক্ষকদের মতো অনেক কিছুরই মানে জানি না, মাহাত্ম্য বুঝি না। কিন্তু সমস্যা না বোঝার মধ্যে নয়, সমস্যা হলো আমি যে বুঝি না, আমি সেটাই বুঝি না। এই বিষয়েও একটা ছোট কৌতুক আছে। কৌতুকটা বলেই ফেলি, কি বলেন?

এক ছেলে একটি অফিসে নতুন চাকরি নিয়েছে। জুনিয়র কর্মকর্তা। তার বস তাকে যে কাজই দেয়, সে সেই কাজই ভুল করে। ব্যাপক ভুল করে। তার বস তো এগুলো ঠিক করতে করতে প্রতিদিনই হাঁপিয়ে যায়। তো একদিন বস জুনিয়র ছেলেটিকে বিগত বছরের একটি নোটবুক দিয়ে বললেন, ‘কোন কাজটা কীভাবে করতে হবে, এখানে তার বিশদ বিবরণ দেওয়া আছে। যখনই তোমার কোথাও খটকা মনে হবে, তখনই তুমি এই নোটবুকের সাহায্য নেবে এবং সব ঠিকঠাক করে আমার কাছে নিয়ে আসবে।’ কিন্তু জুনিয়র ছেলেটি পরদিনও তার কাজে অনেক ভুল করেছে। ঠিকঠাক না করেই তার বসের কাছে দিয়েছে। তার বস দেখে বললেন, ‘আমি তোমাকে নোটবুক দেখে সব ঠিকঠাক করে আনতে বললাম। তুমি নোটবুক দেখে ঠিক করে আনোনি কেন?’ জুনিয়র ছেলেটি বলল, ‘কাজ করার সময় আমার তো কোথাও খটকা লাগেনি। তাই আমি নোটবুকও দেখিনি।’ এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে তাকে সংশোধন করে দেওয়ার সাধ্য কার!

আজকাল কারও ভুল ধরিয়ে দিলে সে খুশি তো হয়ই না, উল্টো আরও রাগ করে। অনেকে ভুল করাকেই নিজের ‘অধিকার’ ও ‘স্বাধীনতা’ মনে করে থাকে। তাদের মধ্যে একধরনের গোঁয়ার্তুমি ভাব দেখা যায়। এই গোঁয়ার্তুমি ভাব দূর না হলে সে নিজেও কিছু শিখতে পারবে না, অন্যকেও কিছু শেখাতে পারবে না। বিশেষ করে শিক্ষকদের। শিক্ষকেরা এমন হলে ছাত্রদের অবস্থা তথৈবচ!

শেষ কথা বলে কিছু নেই। তারপরও লেখা শেষ করার জন্য বলতে হয়, শেখার কোনো শেষ নেই। অনেকেই আবার মনে করেন, না শিখেই যেহেতু চলা যায়, তখন এত শিখে কী হবে? কিন্তু শিক্ষকদের (সবাই নন) হাবভাব দেখলে মনে হয়, তিনি যেন সব শিখে বসে আছেন! কজন শিক্ষক আছেন, যাঁরা ছাত্রদের পড়ানোর আগে নিজে পড়েন? সংখ্যাটা নেহাত কম। বেশির ভাগই আছেন রাজনীতি, ব্যবসা আর লেজুড়বৃত্তি নিয়ে ব্যস্ত। তাঁর পড়ার সময় কোথায়?