বর্ম

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ছোট বোন তানিশার ফোনালাপ জায়েদ নিজের ঘরে বসেই শুনতে পাচ্ছে। আসলে দুই দিনের জন্য বেড়াতে এসেছে। আব্বু ঢাকায় আসার আগে জায়েদকে বললেন, ‘তুই কাজের ওখানে এক দিন যদি ছুটি নিতে পারিস, তাহলে বাসায় চলে আয়, পেনশনের কাজে ঢাকায় যেতেই হচ্ছে, কি আর করি!’ কাজের শেষে বাসায় পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে গেল।

তানিশা মনে হয় তার রেজাল্ট নিয়ে কথা বলছে বান্ধবীর সঙ্গে, জায়েদ শুনতে পেল, মেয়ে হয়ে পুলিশ হওয়ার চিন্তা বাদ দিয়েছি, আমার বিয়ে নিয়ে আব্বু ব্যস্ত। তারপর শুনতে পেল, ‘ছোট ছোট বাচ্চাদের কি সব শেখানো হচ্ছে, কীভাবে শরীরে স্পর্শ করলে তার অর্থ ভালো না খারাপ। এটা ঠিক যে অভিভাবকদেরই দায়িত্ব এটা বাচ্চাদের শেখানো। আচ্ছা বল, বড়রা নিজেরাই কি জানেন? আবার বাচ্চারা অনেক সময় পার্থক্য করতে পারে না, এতটুকু বোঝা তাদের জন‍্য সম্ভব না, বাচ্চাদের পক্ষে কি ভালো মন্দের পার্থক্য করা সম্ভব? আমি তমার—তুই দেখেছিস একবার, এখন চারে পড়েছে—হাতের ওপর হাত রাখলে, ঝটকা মেরে আপুর কাছে চলে গেল, জানিস না, কি রকম মনটা খারাপ লেগেছিল।

জায়েদ নিজের ঠিক একই ঘটনা তমার সঙ্গে ঘটেছিল! তারপর থেকে তমার কাছেই যায় না, আপু ওর থেকে মাত্র এক বছরের বড়, বিয়ের পর অন্য শহরে থাকে, কম আসে নিজেদের বাসায়, আবার একটা ব্যাংকে কাজ করে, ছোট মেয়ের দেখাশোনার জন্য আয়া আছে। একমাত্র ভাগনি তমার জন্ম হলে কী খুশি হয়েছিল! চিন্তা করে দেখল, আসলে বাচ্চাদের এই ভালোবাসার মানুষগুলোর থেকে দূরে রাখা আর ছোট্ট বয়সে এসব খারাপ জিনিস বোঝার বয়স না। তবু তানিশার কথাগুলো শোনার পর মন কিছুটা হালকা হলো।

তানিশা সকাল বেলা ভাইয়াকে নাশতার টেবিলে দেখে খুব খুশি, আম্মু মাঝরাতে দরজা খুলে দিয়েছিল বলে ও জানতে পারে নাই। পরীক্ষা শেষ, এখন কিছু দিন বাসায় থাকে। জায়েদ জিগ্যেস করল, ‘আপুর মতো কমার্সে পড়বি?’, ‘বুঝতে পারছি না, কোনো টেকনোলজি শেখার অনেক ইচ্ছা করে, কম্পিউটারের কাজ শেখা যায়, যেটা থেকে তাড়াতাড়ি টাকা রোজগার করা সম্ভব।’ জায়েদ আর একটা ঘুম দেয়ার জন্য নিজের ঘরে চলে গেল।

দরজা টোকা দিল কেউ যেন। তানিশা ছোট্ট করে খুলে দেখল, প্রতিবেশী ছবির মিয়া। উনি মাঝেমধ্যে আব্বুর কাছে আসেন, টাকা ধার নেন, আবার ফেরত দেন, অনেক ছোট বেলা থেকে দেখে আসছে। ‘চাচা, আসসালামু আলাইকুম! আসুন, এখানে বসেন।’

ছবির না বসে, একটু কাছে চলে এসে দাঁড়ায়; সে বলল, ‘তোমাকে সেই ছোটবেলা থেকে দেখি, তোমাদের কথা অনেক ভাবি, তোমাকে একটু কোলে বসায়ে চুমু খাই?’ তানিশার একটু বুঝতে সময় লাগলো, ‘ঠিক বুঝিনি, কি বললেন?’ ছবিরের চোখ পড়ল হঠাৎ তানিশার পিছনে এসে দাঁড়ানো জায়েদের ওপর। ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে যাবে, জায়েদ সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ‘এখানে এসেছেন কেন?’ ‘ভাইসাহেবকে টাকা দিতে, এই যে।’ টাকা হাতে নিয়ে এবার জায়েদ ছবিরের ঘাড়ে হাত রেখে বলল, ‘আপনি আমার বোনকে যা বললেন, আপনার মেয়েকে যদি ঠিক সেটাই বলি, তখন কি সেটা অন্যায়? জবাব দেন!’

ছবির বললো, ‘আমি তো কিছুই বলিনি, টাকা দিতে আসলাম শুধু।’

তানিশা দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আর ভাবতে লাগলো। শুনলো, ভাইয়া বলছে, ‘ভেবেছিলেন, বাসায় কোন পুরুষ নেই, আপনার শাস্তি অনেক বড়।’ তারপর পেটানোর শব্দ। আম্মুর কথা শুনতে পেল, ‘কি হয়েছে? আমাকে বল।’

তানিশা নিজের কাছে প্রশ্ন, আচ্ছা, আমি দরজা কেন খুলে দিলাম? লোকটা পাশাপাশি থাকে, সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। একটা মসজিদের খাদেম। ছোটবেলায় তানিশা সন্ধ্যার সময় শুনতো, বাচ্চা ঘাড়ে নিয়ে চিৎকার করে গান গাইতো, গানটা নিয়ে দুই বোনে নিজেদের মধ্যে অনেক হাসত। ..আলুভাতে বেগুনপোড়া, শুধু ডাঁটার চচ্চড়ি আর খেতে পারি না বাবা, ফাসতা ফাসাং তরকারি। কিভাবে রং পাল্টায়, ভাগ্যিস ভাইয়া ছিল বাসায়। আর এই ছবির আব্বুর সঙ্গে সব সময়ে ধর্ম আর হাদিস নিয়ে কথা বলে। কীভাবে খারাপ উদ্দেশ্য বুঝবো!

ভাইয়া জোরে ডাকলো, ‘তুই ঘরে ঢুকে বসে আছিস আর আমি কালকে আবার চলে যাব।’ তানিশা বের হয়ে ভাইয়াকে বলল, ‘ভাগ্যিস তুমি সময় মতো এসে সব শুনতে পেয়েছিলে। আমি কি এসব কাউকে বলতে পারতাম? বলতে হবে মনে করলে নিজেকেই ছোট মনে হচ্ছে।’ জায়েদ বলল, ‘আরে ভুলে যা, বদমাইশ অনেক আছে কিন্তু ছবিরের বদমাইশি এর থেকেও অনেক বড়ো, ধর্মকে বর্ম হিসাবে ব্যবহার করে। এর শাস্তি শুধু পিটানোতে কাজ হবে না। আব্বুকে না বললে তো আবার আসতে পারে, প্রতিশোধ নিতে পারে।

‘তুমি বোলো আব্বুকে।’

জায়েদ আব্বুকে নিয়ে পরদিনই মসজিদের ইমামকে ঘটনাটি জানাল। খাদেমের চাকরি থেকে ছবিরকে বরখাস্ত করবেন বলে আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘এ ধরনের সাপ আমাদের মধ্যে আছে, বড় সাজা না দেয়ায় ঝাঁপি খুলে গেছে।’

জায়েদ বিদায় নেওয়ার সময় তানিশা বললো, ‘পুলিশ হওয়ার চিন্তা করছি, একাডেমিতে আবেদন করতে চাই, কী বলো ভাইয়া?’ জায়েদ হেসে বলল, ‘দেশে এত ভাই থাকতে চিন্তা করবি না। সবার ভাই থাকে না। তবে, তুই একাই যথেষ্ট।’