ভাবিয়া নিয়ো সুবিধা, সুবিধা নিয়া ভাবিও না
অত্যন্ত উৎকণ্ঠার মধ্যে গত কয়েক সপ্তাহ অতিবাহিত করলাম। প্রবাসীদের অধিকাংশই এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ না করতে পারলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সক্রিয় ছিল। নিজ নিজ অবস্থান থেকে ফেসবুক, ইউটিউব ভিডিওর মাধ্যমে নিজেদের মতামত এবং সমর্থন প্রকাশ করেছে। প্রবাসীদের সর্বোচ্চ সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ইউটিউবের ভিডিওগুলো দেখে বোঝা যায়।
প্রবাসী শিক্ষিত সমাজের অনেকেই লেখালেখির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে পেরেছে, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয় এবং বর্তমান কর্মস্থল, ইউনিভার্সিটি অব মিজোরি, কলাম্বিয়ার বাংলাদেশি ছাত্র সংস্থা দুবার একাত্মতা ঘোষণা করে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ সভা আয়োজনের পাশাপাশি লিখিত বিবৃতি দিয়েছে। যেখানেই বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী রয়েছে, সেখানেই দেশে ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে। আবেগ–উৎকণ্ঠায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন প্রবাসীরা।
পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার চলে যাওয়া বেশির ভাগ মানুষকে যতটা আনন্দিত করেছে, নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ গ্রহণের আগপর্যন্ত আটকে থাকা নেতা–কর্মী আর সুবিধাভোগীদের লুটতরাজ সবাইকে ব্যথিত করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনী এবং বিভিন্ন এলাকাবাসীর সহায়তায় বহু এলাকায় আক্রমণ রোধ করা গেলেও অনেক জায়গায় এসব আক্রমণ ঠেকানো যায়নি, যা স্বাধীনতার আন্দোলনকে ম্লান করে দিচ্ছে।
যখন লেখাটি লিখছি নতুন সরকারের কয়েকটি দিন পেরিয়ে গেছে। খবরে দেখছি যে শহীদের রক্ত না শুকানো আগের বিএনপি সমাবেশ করেছে। একটা দল কীভাবে ১৫ বছর পরে কি ন্যক্কারজনকভাবে নিজের অবস্থান জানান দিল। এতই যখন তাদের জনসমাবেশের শখ, তাহলে এত দিন কেন তারা আন্দোলন করে এই স্বৈরাচার সরকারকে তাড়ায়নি? শত শত শহীদের প্রাণ আর রক্তের ওপর ভর করে আনা এই স্বাধীনতা কি ছাত্ররা এ জন্যই এনেছিল? তাদের কি আরেকটু অপেক্ষা করা উচিত ছিল না?
গত কয়েক দিনে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী আর সুবিধাভোগীরা ছাত্রজনতার হাতে মার খেয়েছে, কারও কারও বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে, কারও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়া হয়েছে। আমার প্রশ্ন, কেন জনগণের এত ক্ষোভ থাকবে।
একাত্তরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাত থেকে স্বাধীনতা আনতে সর্বস্তরের জনগণ এক কাতারে থেকে যুদ্ধ করেছিল। তখন মানুষের মধ্যে এত বিভাজন ছিল না, তাহলে এখন এত বিভাজন কেন? রাজনীতিবিদেরাই কি তাহলে জনগণের মধ্যে বিভাজন করে রাখেন? আজকের এ ছাত্ররা কি তাহলে রাজনীতিবিদের এই ফাঁদ ধরে ফেলেছে? কর্মীরা যখন নেতার আদেশে ছাত্রদের ধরে ধরে মেরেছে, নেতারা অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন। তাহলে আপনি কর্মী হিসেবে কার আদেশে কী করছেন, তা কি একবার ভাবা উচিত না?
শিক্ষিত সমাজের অনেকেই আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে একটা স্বৈরাচার তৈরি হতে সাহায্য করেছেন। তাই প্রবাসেও এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অনেককেই ছিলেন অনুপস্থিত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছিলেন নিশ্চুপ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সমর্থনকারী অনেকে আবার অনেক স্বৈরাচার সমর্থকদের কাছ থেকে প্রবাসেও হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। তাই বলি কারও কাছে থেকে সুবিধা নেওয়ার আগে ভাবুন এই সুবিধাভোগের কারণে আপনাকে কোনো অন্যায় কাজে সহযোগিতা করতে হবে কি না, দেশের আনন্দের কোনো দিনে পলাতক বা চুপ থাকতে হবে কি না?
সবশেষে ছাত্র আন্দোলনে আবু সাইদ, তন্ময় বড়ুয়া, মুগ্ধসহ নাম না জানা শহীদদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। শেখ হাসিনা সরকারের মতো যেন আর কোনো সরকার তৈরি না হয়। মানুষের মাঝে কারও কাছে সুবিধা নেওয়ার পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা করার মতো শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
*লেখক: রেজাউল হক নাঈম, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ইউনিভার্সিটি অব মিজোরি, কলাম্বিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]