আদ্দিস আবাবায় ভ্রমণ অভিজ্ঞতা-১, কোনো বাড়িতেই নেই এসি

ছবি: লেখকের সৌজন্য

২০২৩ সাল আমার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। কারণ, আমার কর্মজীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয় ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায়। সুযোগটি খুব সহজে পাওয়া যায় না এবং এ জন্য আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই, আমার আগের সহকর্মী ও বড় ভাই কামরুল আজিমকে, যিনি আমাকে এ সুযোগ এনে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি আমি জসীম ভাইকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই। যাঁদের সহযোগিতা ছাড়া এখানে আসা সম্ভব হতো না। এ ভ্রমণ অভিজ্ঞতার লেখাটি আদ্দিস আবাবায় আমার নতুন জীবনের সূচনায় তাদের প্রতি একটি ছোট্ট উৎসর্গ।

ইথিওপিয়া সম্পর্কে সাধারণ ধারণা

ইথিওপিয়া পূর্ব আফ্রিকার একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। একে ‘দ্য ল্যান্ড অব অরিজিন’ বলা হয়, যা ‘আফ্রিকার শিং’ তথা সোমালি উপদ্বীপ অঞ্চলের অন্তর্গত। দেশটির উত্তরে ইরিত্রিয়া, উত্তর-পূর্বে জিবুতি, পূর্বে সোমালিয়া, দক্ষিণে কেনিয়া এবং পশ্চিমে দক্ষিণ সুদান ও সুদান। ইথিওপিয়ার আয়তন প্রায় ১১ লাখ ২৭ হাজার ১২৭ বর্গকিলোমিটার, যা বাংলাদেশের আকারের প্রায় আট গুণ। দেশটিতে প্রায় ১৭ কোটি লোকের বাস। ফলে এটি আফ্রিকা মহাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনবহুল দেশ।

রাজধানী আদ্দিস আবাবা শহর ও প্রদেশ উভয় দায়িত্ব পালন করে। এ শহরে আফ্রিকান ইউনিয়নের সদর দপ্তর। তাই দেশটি আফ্রিকার রাজধানী হিসেবে পরিচিত। আদ্দিস আবাবা ১৮৮৬ সালে সম্রাট মেনেলিক টু দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্য গুরুত্বপূর্ণ শহরের মধ্যে রয়েছে দিরে দাওয়া, নাজরেত, গোন্দের, দেসে, হাওয়াসা ও মেকেলে। আদ্দিসে সারা বছরই ঠান্ডা আবহাওয়া, তাই এখানে বসবাস করা আরামদায়ক। কোনো বাড়িতেই এসি দেখতে পাবেন না।

ছবি: লেখক

ইথিওপিয়ার ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এটি একমাত্র আফ্রিকান দেশ, যেটি কখনো উপনিবেশিত হয়নি। আধুনিক ইথিওপিয়া রাষ্ট্র ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানকার সরকারব্যবস্থা হলো একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবস্থা। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান, প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান। ২০১৯ সালের হিসাবে, ইথিওপিয়ার জনসংখ্যার ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ৩৫ দশমিক ৯ শতাংশ মুসলমান, যা খ্রিষ্টধর্মের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। এখানে প্রায় ৮০টি ভিন্ন জাতির লোক বসবাস করছে এবং তারা ৯০টি স্বতন্ত্র ভাষায় কথা বলে। ওরোমো ও আমহারা জাতি এখানে উল্লেখযোগ্য, যেখানে আমহারীয় ও ওরোমো ভাষা সবচেয়ে বেশি প্রচলিত।

আদ্দিস আবাবা এসে আমি একটি নতুন সাংস্কৃতিক পরিবেশের মুখোমুখি হই। শহরের উন্নয়ন, মানুষের অতিথিপরায়ণতা ও স্থানীয় সংস্কৃতি আমাকে মুগ্ধ করে। এখানে কাজ করার অভিজ্ঞতা সত্যিই সোনালি মুহূর্তগুলোর মধ্যে একটি। বিদ্যমান বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মধ্যে কাজ করার সুযোগ পেয়ে মনে হলো, আমি একটি আন্তসাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্মে আছি।

ইথিওপিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবস্থান

ইথিওপিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা তুলনামূলক কম (প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০)। তবে যাঁরা এখানে আছেন, তাঁরা অত্যন্ত দক্ষ পেশাজীবী। তাঁদের মধ্যে পোশাক ও টেক্সটাইল বিশেষজ্ঞরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন, যা আমাদের দেশের জন্য গৌরবের বিষয়। তাঁদের তথ্য ও অভিজ্ঞতা দেশের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

নতুন এই জীবনের মধ্য দিয়ে আশা করি আমি আমার কাজের মাধ্যমে এখানকার সংস্কৃতি ও মানুষের সঙ্গে আরও গভীরভাবে যুক্ত হতে পারব এবং এ দেশে আমার অবদান রাখতে পারব।

ছবি: লেখক

  আরবামিঞ্ছ টেক্সটাইল শেয়ার কোম্পানি

আমি আরবামিঞ্ছ টেক্সটাইল শেয়ার কোম্পানিতে ২০২৩ সালের ২২ অগাস্ট হেড অব মার্চেন্ডাইজিং অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন হিসেবে যোগ দিই। এটি আমার জন্য একদিকে চ্যালেঞ্জিং অন্যদিকে বৈচিত্র্যময়। আমার কোম্পানির ব্যবসা কাপড়ের এবং তারা ইথিওপিয়ান মিলিটারিদের জন্য ইউনিফর্ম সরবরাহের কাজ শুরু করেছে, যার ব্যবস্থাপনার জন্য আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর আগে আমার জায়গায় দুজন শ্রীলঙ্কান কাজ করেছেন, কিন্তু তাঁরা কেউই বেশি দিন থাকেননি। সবার দোয়া ও আমার প্রচেষ্টায় এক বছর পূর্ণ করেছি এবং কোম্পানির মালিকও সন্তুষ্ট। এখানে কাজ করা আমার জন্য একটি গর্বের বিষয়। কারণ, একজন বাঙালি হিসেবে বিদেশে সে দেশের মিলিটারিদের পোশাক সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছি এবং মিলিটারি ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি।

ইথিওপিয়ায় কাজ করার মধ্য দিয়ে আমি বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মেলামেশা ও যোগাযোগের দক্ষতা উন্নত করেছি, যা আমার পেশাদার জীবনে অত্যন্ত মূল্যবান। আমি মনে করি, বৈশ্বিক পরিবেশে ব্যবসা পরিচালনা করতে হলে বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি সমঝোতা ও শ্রদ্ধা প্রয়োজন। একই সঙ্গে ইউনিফর্ম তৈরির কাজের মাধ্যমে আমি স্থানীয় শ্রমপ্রবাহ ও উৎপাদনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। এ সংযোগ আমাকে ইথিওপিয়ার বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি জোনের কারখানার সঙ্গে পরিচিত হতে সাহায্য করেছে। যার ফলে আমি স্থানীয় বাজারের প্রয়োজন বুঝতে পেরেছি এবং আমার কর্মদক্ষতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আরবামিঞ্ছ কোম্পানির সঙ্গে আমার কাজ একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। আমি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছি এবং নতুন প্রকল্পের জন্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি। আমার দলের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক এবং কাজের পরিবেশে সহযোগিতার মধ্য দিয়ে আমি তাঁদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সর্বাধিক উপকার নিতে চেষ্টা করছি। বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে আমরা একটি দলের মতো কাজ করছি, যা কোম্পানির লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক।

বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আশা করছি আমার কাজের মধ্য দিয়ে যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, তা ভবিষ্যতে আমাকে নতুন সুযোগের দিকে নিয়ে যাবে। আমি ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক বাড়ানো, নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও কোম্পানির গুণগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাব। সর্বোপরি, আমি বিশ্বাস করি, এক বছরের অভিজ্ঞতা কেবল শুরু। আমার প্রত্যাশা, ভবিষ্যতে আরও বড় প্রকল্প ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা, যা আমাকে আরও উন্নতি এবং সাফল্যের পথে নিয়ে যাবে।

ছবি: লেখক

আদ্দিস আবাবার দর্শনীয় স্থান

আদ্দিস আবাবা ইথিওপিয়ার রাজধানী। এখানকার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত। নিচে আদ্দিস আবাবার কিছু দর্শনীয় স্থানের কথা উল্লেখ করা হলো-

ন্যাশনাল মিউজিয়াম ও জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, আদ্দিস আবাবা: জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর (Ethnological Museum), ইথিওপিয়ার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এটি আদ্দিস আবাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে অবস্থিত এবং এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে বিস্তৃত প্রদর্শনীর জন্য পরিচিত।

জাদুঘরের কিছু মূল বৈশিষ্ট্য

সংগ্রহালয়: আফ্রিকার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শিল্পকলা, ঐতিহ্যবাহী পোশাক, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক নিদর্শন প্রদর্শিত হয়। এটি দর্শকদের আফ্রিকান জীবনযাত্রা, সংগীত, নৃত্য ও সমাজের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে।

ইথিওপিয়ান ইতিহাস: জাদুঘরে ইথিওপিয়ার প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতির ওপর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। প্রাচীন সভ্যতা, ধর্ম ও রাজনীতি এই জাদুঘরে বিশদভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

লুসি (ডিকিন পিতা): জাদুঘরে ‘লুসি’ নামে পরিচিত ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন বছরের পুরোনো মানবমূর্তি সংরক্ষিত রয়েছে, যা মানব বিবর্তনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী: বিভিন্ন জাতির ও অসংখ্য স্থানীয় সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য–সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায়। স্থানীয় কারুশিল্প, মৃৎশিল্প, ঐতিহ্যবাহী সংগীত এবং নৃত্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ রয়েছে। জাদুঘরের চারপাশের পরিবেশ খুব শান্ত ও মনোরম। দর্শনার্থীদের জন্য একটি আদর্শ স্থান, যেখানে তাঁরা ইথিওপিয়ান সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীরভাবে জানার সুযোগ পান।

ছবি: লেখক

ভ্রমণ তথ্য

সময়: জাদুঘর সাধারণত সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে, তবে সপ্তাহে বিশেষ দিনগুলোয় সময় পরিবর্তিত হতে পারে।

টিকিট: প্রবেশের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা রয়েছে, যা স্থানীয় ও বিদেশি দর্শকদের জন্য আলাদা।

আদ্দিস আবাবা জাদুঘর সত্যিই ইথিওপিয়ার অতীত ও বর্তমানের একটি মেলবন্ধন, যা দর্শকদের জন্য একটি শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা প্রদান করে। ইথিওপিয়া সম্পর্কে জানতে ও অনন্য সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের উপলব্ধির জন্য এটি এক বিশেষ স্থান। চলবে...

দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]