ব্রাগানসা ও অতৃপ্ত হৃদয়ের অসম্পূর্ণ ভালোবাসার গল্প-৪
২০২২ সালে শত বেদনার মধ্যেও এদিন ছিল আমার জন্য বিশেষ। যদিও পলিনা ও ভেরোনিকাকে খুব বেশি সময়ের জন্য কাছে পাইনি। তারপরও তাদের সঙ্গে হাঁটার সুযোগ পেয়েছি, তাদের সাও বেন্তো রেলস্টেশনের ভেতরটা ঘুরে দেখিয়েছি। সাও বেন্তো পর্তুগালের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন রেলস্টেশনগুলোর মধ্যে একটা। তাই সেখানে পা রাখামাত্র পুরোনো দিনে ফিরে যাওয়ার অনুভূতি খুঁজে পেলাম। স্টেশনের ভেতরের হলুদ বা রঙের দেয়ালের ওপর টাইলস বসানো ইন্টেরিয়রকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে অনেক দর্শনার্থী ছবি তোলেন। একবিংশ শতাব্দীর এ যুগে কয়লা বা বাষ্পচালিত রেল ইঞ্জিনের ব্যবহার সে অর্থে দেখা যায় না, তবে এ স্টেশনের ভেতর এখনো সেই মান্ধাতার আমলের বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ভেরোনিকাকে স্টেশনের ভেতর থেকে কয়েকটি ছবি তুলে দিলাম, পলিনাও সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলল।
নিউ ইয়ারের কয়েক দিন আগে পলিনার ইনস্টাগ্রামের একটা স্টোরি আমার নজরে আসে। একবার পলিনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে কোনো ধরনের মিম পছন্দ করে কি না। পলিনার উত্তর ছিল, সে মিম পছন্দ করে, তবে সেটা হাতে তৈরি মিম এবং বেশির ভাগ সময় তার বন্ধু ভেরোনিকা এ ধরনের মিম বানায়। পলিনা আমার এ প্রশ্ন আর ভেরোনিকার হাতে তৈরি মিমকে জড়িয়ে একটা ইনস্টাগ্রাম স্টোরি আপলোড করছিল। এ ইনস্টাগ্রাম স্টোরি, পলিনাকে আমার করা টেক্সটের স্ক্রিনশট আর আমার হাতের লেখা একটি নোট—এ তিনটিকে একত্র করে তার জন্য নিউ ইয়ারের গিফট সাজিয়েছিলাম। এক্সম্যান ইউনিভার্সের একটি ক্যারেক্টারের নাম ডেডপুল। কেউ বলেন, ডেডপুল হচ্ছে একজন সুপারহিরো। কেউ আবার দাবি করেন, ডেডপুল হচ্ছে একজন অ্যান্টিহিরো। একদিন হোয়াটস অ্যাপে চ্যাট চলাকালীন পলিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ডেডপুল ক্যারেক্টারটি তার কাছে কেমন লাগে। পলিনা উত্তর দিল, খারাপ না। ডেডপুলের ওপর এখন পর্যন্ত দুটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। সেখানে অভিনয় করেছেন কানাডার বিখ্যাত ফিল্মস্টার রায়ান রেনোল্ডস। পলিনা রায়ান রেনোল্ডসের একজন গুণগ্রাহী। তাই পলিনার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ইংরেজি নতুন বছর উপলক্ষে তাঁকে ডেডপুলের একটা ছোট রেপ্লিকা ও চকলেট উপহার দিয়েছিলাম। রেপ্লিকাটি অ্যামাজন থেকে অর্ডার করেছিলাম।
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর আমার জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় দিনগুলোর মধ্যে একটি। পলিনা ওই দিন সবচেয়ে সুন্দর রূপে আমার সামনে ধরা দেয়। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তার বাসার নিচে গিয়ে তাঁকে আমি হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট করি। এর ঠিক কিছুক্ষণ পর পলিনা তার বিল্ডিংয়ের গেট থেকে বেরিয়ে আসে। সেদিন তার পরনে ছিল না চশমা, এমনকি ওই দিন সে চুলও বাঁধেনি। কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে কালো রঙের জ্যাকেটে খোলা চুলে সে যখন দৃপ্ত পায়ে আমার দিকে একটু একটু এগিয়ে আসছিল, তখন যেন আমি বারবার তার মাঝে অ্যাপোলোনিয়াকে খুঁজে পাচ্ছিলাম। একটি প্রশ্ন বারবার মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল—ভাগ্য কী সত্যি এবার আমার ওপর সদয় হলো? প্রাচীন গ্রিসে অ্যাপোলোনিয়া নামের এক যুবতী বসবাস করতেন। রূপ–লাবণ্য ও সৌন্দর্যের দিক থেকে তিনি যেমন ছিলেন অনন্যসাধারণ, ঠিক তেমনি রন্ধনশিল্পী হিসেবেও তাঁর খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। দেবরাজ জিউস পর্যন্ত তাঁকে দেখামাত্র তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন, তাঁর হাতের রান্না জিউসকে বিশেষভাবে অভিভূত করেছিল। জিউস তাই তাঁকে তাঁর সঙ্গে মাউন্ট অলিম্পাসে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে সব দেবতার সঙ্গে ঠাঁই দিয়েছিলেন। সেদিন যেন অ্যাপোলোনিয়া আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য মাউন্ট অলিম্পাস থেকে সরাসরি মর্ত্যলোকে নেমে এসেছিলেন। সেদিনের রাত ছিল ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন। চারপাশে যেদিকে চোখ পড়ছিল, কুয়াশা ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবু এর মধ্যে তার সোনালি চুলগুলো সোডিয়াম বাতির মতো জ্বলজ্বল করছিল। বাতাসে তার চুল উড়ছিল। সেই সঙ্গে তার পারফিউমের ঘ্রাণ আমার নাককে অবশ করে দিচ্ছিল। অনেকটা সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তার হাতে উপহারগুলো তুলে দিলাম। পলিনা হাসিমুখে আমার দেওয়া উপহারগুলো গ্রহণ করল। কী বলব সেটা ভেবে পাচ্ছিলাম না, শুধু জিজ্ঞেস করলাম, ‘রাতে খাবার খেয়েছ?’ পলিনা মিষ্টি স্বরে উত্তর দিল, ‘এই তো, এইমাত্র ডিনার শেষ করলাম।’ পলিনাকে বললাম, ‘চলো, পাশে থাকা বার থেকে ওয়াইন অর্ডার করি।’ পলিনা বলল, ‘আমি এখন ওয়াইন পান করার মতো অবস্থায় নেই।’
পলিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার বান্ধবী ভেরোনিকা কবে বেলারুশ থেকে ফিরবে?’ পলিনা উত্তর দিল, ‘কয়েক দিন হলো ভেরোনিকার সাথে কথা হয়নি, হয়তো সে আরও এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ বেলারুশে থাকবে।’
সত্যি সেদিন তার ওই লুক আমাকে এতটা পাগল করে দিয়েছিল যে কী বলব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আগেরবারের মতো সেদিনও তাঁকে আলিঙ্গন করে বললাম, ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার ইন অ্যাডভান্স! চাই নতুন বছরে তুমি আরও ভালো থাকো এবং তোমার সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও আরও গাঢ় হয়ে উঠুক।’ তার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম, চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল।
নতুন বছরে আমার প্রথম লক্ষ্য ছিল ব্যাচেলরের থিসিস যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করা। যেকোনো মূল্যে স্লোভেনিয়ায় ফিরে ২০২৩ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে চাই। এ কারণে পড়াশোনার প্রতি অধিক মনোযোগী হয়ে উঠি। বাইরে যাতায়াতও কমিয়ে দিই। তারপরও জানুয়ারিতে মাত্র দুই দিন তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ১২ জানুয়ারি শেষবারের মতো ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাসে অংশ নিয়েছিলাম। সেদিন পলিনার সঙ্গে সেভাবে কথা হয়নি, আমার লেখা একটা কবিতা ওই দিন তাকে উপহার দিয়েছিলাম। এরপর ১৬ জানুয়ারি আমাদের শিক্ষক মার্তা একটা ক্লাস পার্টির আয়োজন করছিলেন। সেখানেও পলিনার সঙ্গে দেখা হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত ওই দিনও সেভাবে তার সঙ্গে প্রাণখুলে কথা বলতে পারিনি।
এরপর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে হঠাৎ পোস্ট অফিস থেকে আমার আগের বাসার ঠিকানায় একটা নোটিফিকেশন লেটার আসে, আমার সাবেক ফ্ল্যাটমেট লুয়ান সেটিকে রিসিভ করে আমাকে ম্যাসেজ পাঠায়।
লুয়ান ব্রাজিলের নাগরিক। ব্রাগানসায় থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে লুয়ান আমাকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে। তার প্রতি আমি সব সময় কৃতজ্ঞ। আমার মনে আছে, ব্রাগানসায় আসার পর প্রথম দেড় মাস পায়ের ব্যথায় ভীষণভাবে কাতরাচ্ছিলাম। লুয়ান নিজ দায়িত্বে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে, চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে।
লুয়ানের থেকে নোটিফিকেশন লেটারটি নিতে যাব, এমন সময় হঠাৎ এসটিগের মূল গেটের সামনে পলিনার সঙ্গে আমার দেখা হয়। কালো কোর্টের মাঝে নীল রঙের শার্ট পরা পলিনাকে দেখে সেদিন কিংবদন্তি অস্কারজয়ী নায়িকা জেনিফার লরেন্সের মতো লাগছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার সেই ভালোবাসার ১০৮টি নীল পদ্মের প্রতিটি আলাদাভাবে পলিনার শার্টের প্রতিটি সুতায় নিখুঁত ছাঁচ কেটেছিল।
চিত্রশিল্পীদের মতে, আকাশের রং নীল। কারণ, আকাশ আমাদের সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে।
যেসব জিনিস মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে, সেসব জিনিসকে চিত্রশিল্পীরা নীল রঙে রঞ্জিত করেন। বলা হয়, নীল রং নাকি আমাদের স্বপ্নের সমার্থক। শিল্পবিপ্লবের আগপর্যন্ত নীল রং ছিল অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য। তখন মূলত দুই উপায়ে নীল রং সংগ্রহ করা হতো। প্রথমত, ইনডিগো নামের একপ্রকার গাছের ফল থেকে নীল রং পাওয়া যেত, যেটা চিত্রকর ও শিল্প-কারখানার শ্রমিকেরা ব্যবহার করতেন। অথবা আফগানিস্তানের বিভিন্ন খনিতে লাপিজ লাজুলি নামের একধরনের রত্নপাথর পাওয়া যায়। এ পাথরের মাধ্যমেও নীল রং সংগ্রহ করা যেত। পলিনা সেদিন আমার স্বপ্ন হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আকাশও সেদিন ছিল শান্ত, তাই আকাশের গাঢ় নীল রং সেদিন পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছিল।
পলিনাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘হাই! হাউ আর ইউ? হ্যাভ ইউ জাস্ট কাম ফ্রম দ্য এক্সাম?’
পলিনা উত্তরে জানাল, ‘হাই! আই অ্যাম গুড। আই হ্যাড নো এক্সাম টুডে।’
পলিনা আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এদিকে কোথায় যাচ্ছ এখন?’
আমার হোয়াটসঅ্যাপে লুয়ান নোটিফিকেশন লেটারের একটা ছবি পাঠিয়েছিল। পলিনাকে ছবিটি দেখিয়ে বললাম, ‘খুব সম্ভব সেইফ থেকে আমার কাছে চিঠি এসেছে। আমি রেসিডেন্স কার্ড পেয়েছি। আমার ব্রাজিলিয়ান ওই বন্ধুর থেকে লেটারটি নিয়ে সিটিটিতে গিয়ে দেখতে হবে।’
পলিনা জিজ্ঞেস করল, ‘রেসিডেন্স কার্ড পর্তুগালের নাকি স্লোভেনিয়ার?’
আমি বললাম, ‘অবশ্যই পর্তুগালের। মনে হয়, এবার আমার চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। এ সপ্তাহের পর আমাকে তুমি ব্রাগানসায় আর দেখতে পাবে না। চলে যাওয়ার আগে তোমাকে আর ভেরোনিকাকে নিয়ে একসঙ্গে একটা রেস্তোরাঁয় ডিনার করতে চাই। তোমরা কি আমার দাওয়াত গ্রহণ করবে?’
পলিনা বলল, ‘এখনই জোর দিয়ে কিছু বলতে পারছি না।’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে! আমি তোমাকে হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট দেব।’
লুয়ানের থেকে চিঠিটি নিয়ে সরাসরি পোস্ট অফিসে চলে যাই। পর্তুগালে পোস্ট অফিস সিটিটি হিসেবে পরিচিত। সিটিটির ভেতরে প্রবেশের পর নোটিফিকেশন লেটারটি জমা দেওয়ার পর আমাকে মূল লেটারটি দেওয়া হয়। খুলে দেখি—রেসিডেন্স পারমিট ইস্যু হয়েছে; সেইফের পক্ষ থেকে আমাকে একেবারে তিন বছরের টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট কার্ড দেওয়া হয়েছে। রেসিডেন্ট কার্ড হাতে পাওয়ামাত্র কার্ডের ছবি তুলে পলিনার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালাম। বাসার কাউকে তখনো এ বিষয়ে কিছু জানাইনি। পলিনা আমার মেসেজ দেখল ঠিকই, কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। কয়েক দিন পর পলিনা অবশ্য আমাকে টেক্সট দেয় এবং সেইফের জন্য কী কী ডকুমেন্ট জমা দিতে হয়, সে বিষয়ে জানতে চায়। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে তাকে সহায়তা করার জন্য আমি চেষ্টা করেছি।
পলিনার সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছে এ বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি, ব্রাগানসা ছেড়ে চলে আসার ঠিক দুই দিন আগে। ওই দিন আমি সত্যি আবেগে কেঁদে দিয়েছিলাম। এর আগেও আমি কয়েকজনের প্রেমে পড়েছি, তবে পলিনার মতো এভাবে কাউকে এত ভালোবাসতে পারিনি। কাছের একটা গিফট শপ থেকে পলিনার জন্য ছোট সাইজের একটা টেডি বিয়ার কিনেছিলাম। সঙ্গে ছিল প্রায় ৩২ পৃষ্ঠার একটি নোট ও এক প্যাকেট চকলেট। এবারের নোটটি ইংরেজি ও রুশ—এ দুই ভাষার সংমিশ্রণে লিখেছি। বলাবাহুল্য, আমি আমার জীবনে কোনো দিন এত বড় কোনো কিছু লিখিনি। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা চলাকালীন বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষার খাতায় যে রচনা লিখেছিলাম, সেটি ছিল মাত্র ১৪ পৃষ্ঠার, ব্যাচেলরের জন্য যে থিসিস জমা দিয়েছি, সেটি শেষ করতেও মাত্র ১৪ পৃষ্ঠা লেগেছে। আর ওই দিন পলিনাকে দেওয়া নোটটি ছিল ৩২ পৃষ্ঠার, যার পুরোটি আমার নিজ হাতের লেখা। নোটটি দেখামাত্র পলিনা হেসে উঠল। আমি বললাম, তোমার জন্য রুশ ভাষায় কিছু লিখেছি। পলিনা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি তো ভিনদেশি, রুশ ভাষার সঙ্গে তোমার দেশের তেমন সম্পর্ক নেই। তারপরও তোমার রুশ লিখতে কষ্ট হয়নি?’
আমি বললাম, ‘আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে এ নোট লিখেছি। তাই আমার কাছে তেমন কোনো কষ্ট লাগেনি।’
পলিনা কিছু বলল না। তার সঙ্গে ছবি তুলতে চাইলাম, কিন্তু সে অনুমতি দিল না। অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি তাকে বললাম, ‘হতে পারে এটি তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আমি চাই, তুমি সুখে থাকো এবং ভালো থাকো। হতে পারে আমি দূরে চলে যাচ্ছি, তবু সব সময় আমি তোমাকে সব দিক থেকে সহায়তা করার চেষ্টা করব। আমার জীবনে প্রাপ্তি বলে কিছু নেই, যদি তুমি তোমার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারো, তবে তোমার আনন্দের মধ্যে আমি নিজের প্রাপ্তি খুঁজে নেব।’
পলিনা কিছু না বলে কেবল হাসছিল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তুমি যখন হাসো, আমার চোখে সেটি এ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়। আমি চাই, তোমার সুন্দর হাসিটি সব সময় অমলিন থাকুক।’
পলিনা আমাকে বলল, ‘আমিও চাই তুমি ভালো থাকো।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার তরী’ কবিতার কয়েকটি চরণ বারবার কানে ভাসছিল:
‘যেতে নাহি দিব হায়,
তবু যেতে দিতে হয়,
তবু চলে যায়।’
কোনোভাবে তাকে বিদায় জানাতে ইচ্ছা করছিল না, বুকটা ভারী হয়ে আসছিল। তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘সারা জীবন তোমাকে আমি এই বুকের মধ্যে রেখে দেব।’
চোখ বেয়ে টলটল করে জল নামছিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একটু একটু করে মেঘ জমছে। পলিনা জিজ্ঞেস করল, ‘স্লোভেনিয়ায় ফেরত যাবে কীভাবে?’
আমি বললাম, ‘অ্যারোপ্লেনে। ১৩ তারিখ সকাল সাড়ে ছয়টায় আমার ফ্লাইট। তবে ব্রাগানসা থেকে রোববারের মধ্যে চলে যেতে হবে।’
পলিনা জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা! তোমার ফ্লাইট কি লিসবন থেকে?’
আমি বললাম, ‘লিসবন না, মাদ্রিদ থেকে। মাদ্রিদের এয়ারপোর্ট অনেক বড় এবং সেখান থেকে ফ্লাইটের টিকিটের দামও তুলনামূলকভাবে বেশ সস্তা। আমি মাত্র ৪০ ইউরোর বিনিময়ে মাদ্রিদের বারাখাস এয়ারপোর্ট থেকে ইতালির ভেনিসের মার্কো পলো এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর টিকিট পেয়েছি।’
পলিনা জিজ্ঞেস করে, ‘ভেনিস কেন আবার?’
আমি বললাম, ‘স্লোভেনিয়ায় ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট মাত্র একটা এবং এই এয়ারপোর্টের আয়তনও খুবই ছোট। এখান থেকে ফ্লাইটের সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা। তাই আমি মাদ্রিদ থেকে প্রথমে ভেনিসে যাব এবং ভেনিস থেকে বাসে বা মোটরগাড়িতে মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে নোভা গোরিসায় পৌঁছানো যায়।’
পলিনা জিজ্ঞেস করল, ‘বুঝলাম! ব্রাগানসা থেকে মাদ্রিদ যাবে কীভাবে?’
আমি বললাম, ‘ব্রাগানসা থেকে প্রথমে পোর্তো যাব বাসে। এরপর ব্লা ব্লা কারের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, যিনি আমাকে পোর্তোর ত্রিনিদাদ মেট্রো স্টেশন থেকে মাদ্রিদের লাভাপিয়েস পর্যন্ত পৌঁছে দিতে রাজি হয়েছেন। লাভাপিয়েস পৌঁছাতে প্রায় রাত সাড়ে ১০টা বা ১১টা বাজবে। পরের দিন ভোরে ফ্লাইট, তাই রাতটা এয়ারপোর্টে কাটাব।’
পলিনা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার শরীর এত লম্বা জার্নি নিতে পারে?’
আমি বললাম, ‘আমি জার্নিতে অভ্যস্ত।’
পলিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা! সামনের মাসের ১৪ তারিখে তোমার ২০তম জন্মদিন। ২০ একটা বিশেষ সংখ্যা। ভেরোনিকাকে নিয়ে স্লোভেনিয়ায় আসবে? এখান থেকে স্লোভেনিয়ায় আসা এবং একই সঙ্গে ফেরত যাওয়া পর্যন্ত যা যা খরচ সব আমার, তোমাদের থাকা ও খাওয়া উভয়ের খরচ সব আমি দেব। তোমার জন্মদিন উদ্যাপন করতে আমরা ভেনিসে যাব।’
পলিনা বলল, ‘মনে হয় না এবারের জন্মদিন ব্রাগানসার বাইরে অন্য কোথাও উদ্যাপন করতে পারব। কয়েক দিন পর নতুন সেমিস্টার শুরু হবে।’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে! আমি যদি স্লোভেনিয়া থেকে ব্যাচেলর শেষ করতে পারি, তাহলে আমাদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তোমাকে দেখতে চাই। স্লোভেনিয়ায় অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়। যাঁরা গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেন, তাঁদের মা–বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে তাঁদের প্রিয়জনকে গাউন পরিয়ে দেন, একসঙ্গে ছবি তোলেন। প্রায় তিন বছর হতে চলেছে, আমি আমার মা–বাবাকে দেখি না। আমাদের পাসপোর্ট খুবই দুর্বল, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কোনো দেশের ভিসা পেতে হলে আমাদের অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। আমার মা–বাবার বয়স হয়েছে। তাঁদের পক্ষে এত প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়া সম্ভব নয়। আমার মায়ের আর্থ্রাইটিসের সমস্যা রয়েছে। তাঁর পক্ষে বাংলাদেশ থেকে স্লোভেনিয়া—এত লম্বা জার্নি বেশ কষ্টসাধ্য। আমি চাই, আমার মা–বাবার পরিবর্তে তুমি সেদিন আমার ইউনিভার্সিটিতে থাকবে। ব্রাগানসা থেকে স্লোভেনিয়ায় যাওয়া-আসা এবং থাকা–খাওয়ার সব খরচ আমি তোমাকে পাঠিয়ে দেব। তোমাকে স্লোভেনিয়া ও এর প্রতিবেশী দেশ ইতালি, অস্ট্রিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও হাঙ্গেরি ঘুরে দেখাব। চাইলে তুমি সঙ্গে ভেরোনিকা ও তোমার অন্য দুই বান্ধবী এমিলিয়া ও মারিয়াকে নিয়ে আসতে পারো। তাদের যাবতীয় খরচও আমি পরিশোধ করে দেব।’
পলিনা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনি কবে?’
আমি বললাম, ‘সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের দিকে হবে। যদি আমি এ বছর সফলতার সাথে ব্যাচেলর শেষ করতে পারি।’
পলিনা বলল, ‘ঠিক আছে। দেখা যাবে, এখন কোনো কথা দিতে পারছি না।’ চলবে...
*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিসা, স্লোভেনিয়া