মুসলিম প্রধান দেশ বাহরাইনে রমজান মাসকে অত্যন্ত গুরুত্ব ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালন করা হয়। এখানকার মুসলমানরা রোজা রেখে সূর্যাস্তের পর ঐতিহ্যবাহী ও সুস্বাদু খাবার দিয়ে ইফতার করেন। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশের মতো বাহরাইনেও রমজান বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এবং সরকারিভাবে বিভিন্ন আয়োজন করা হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশের মতোই জনজীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। দিনের বেলায় কর্মচাঞ্চল্য কিছুটা কম হলেও সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শহরজুড়ে ব্যস্ততা বেড়ে যায়। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা হয়, যাতে রোজাদারেরা স্বাচ্ছন্দ্যে ইবাদত করতে পারেন। বেশির ভাগ অফিস সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত খোলা থাকে, যা সাধারণ সময়ের তুলনায় সংক্ষিপ্ত।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
দিনের বেলায় বাজার ও দোকানে তুলনামূলক ভিড় কম থাকে, তবে বিকেল থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত দোকানপাট খোলা থাকে। ইফতারের আগে খাবারের দোকান ও সুপারমার্কেটগুলোতে মানুষের ভিড় বেড়ে যায়। বিশেষ করে খেজুর, শরবত, মাংস, মসলা এবং অন্য ইফতারসামগ্রী কিনতে অনেকেই বিকেলে বাজারে আসেন।
রমজানের সময় বাহরাইনের রাস্তাগুলোতে দুপুরের দিকে যানবাহনের সংখ্যা কম থাকে, কারণ অনেকে কর্মস্থল থেকে সরাসরি বাসায় চলে যান। তবে ইফতারের আগে বাজার ও রেস্তোরাঁমুখী মানুষের কারণে কিছু এলাকায় যানজট দেখা যায়। ইফতারের সময় রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা হয়ে যায়, কারণ সবাই ইফতার আয়োজনে ব্যস্ত থাকেন।
ইফতার ও মাগরিবের নামাজের পর শহরজুড়ে আবার প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যায়। শপিং মল, ক্যাফে, রেস্তোরাঁ এবং বাজারগুলোতে মানুষের আনাগোনা বাড়ে। অনেকেই তারাবির নামাজ আদায় করে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে আড্ডা দিতে বের হন। অনেকে রাতে কাজ করেন। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ থাকায় রাতে কাজ করতে কোনো অসুবিধা হয় না।
ইফতার: ঐতিহ্যের মেলবন্ধন
বাহরাইনে ইফতারের জন্য ঐতিহ্যবাহী আরবীয় খাবারের পাশাপাশি উপমহাদেশীয় খাবারও বেশ জনপ্রিয়। খেজুর ও ঠান্ডা শরবত দিয়ে ইফতার শুরু করা হয়, এরপর হুমুস, সাম্বুসা, লাবান (দই জাতীয় পানীয়), মাচবুস (একধরনের বিরিয়ানি) এবং বিভিন্ন গ্রিল আইটেম খাওয়া হয়। বিভিন্ন মসজিদ ও দাতব্য সংস্থাগুলো সাধারণ মানুষের জন্য ইফতারের আয়োজন করে।
বাহরাইনে প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশি প্রবাসী বসবাস করেন, যাঁরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। প্রবাসী বাংলাদেশিরা সাধারণত কর্মস্থলে কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে ইফতার করেন। কেউ কেউ মসজিদে গিয়ে ইফতার করেন, আবার কেউ বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিলিত হয়ে ইফতারের আয়োজন করেন। প্রবাসী বাংলাদেশি বিভিন্ন সংগঠন ইফতার মাহফিল আয়োজন করে থাকে এবং ইফতার বিতরণ করে থাকে।
বাংলাদেশি প্রবাসীদের ইফতারিতে ভাত, খিচুড়ি, বেগুনি, পেঁয়াজু, ছোলা, জিলাপি ও হালিমের মতো দেশীয় খাবার দেখা যায়। অনেকে বাহরাইনের স্থানীয় খাবারের সঙ্গে বাংলাদেশি খাবারের সংমিশ্রণ করে ইফতার করেন।
রাতের ইবাদত ও সাহ্রি
রমজান মাসে বাহরাইনের জনজীবন দিনের বেলা কিছুটা ধীরগতির হলেও রাতের বেলায় ব্যস্ত ও উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। মসজিদগুলোতে তারাবিহর নামাজের বিশেষ ব্যবস্থা থাকে, যেখানে স্থানীয়দের পাশাপাশি বাংলাদেশি প্রবাসীরাও অংশ নেন। অনেক মসজিদে পুরো রমজান মাসে কোরআন খতম করা হয়। রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকান সাহ্রির জন্য রাতভর খোলা থাকে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা সাধারণত বাসায় দেশীয় খাবার রান্না করেন, কেউ কেউ রেস্তোরাঁ থেকেও খাবার আনেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা পরিবার থেকে দূরে থাকলেও রমজানের আনন্দ একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন। কেউ কেউ ভিডিও কলে পরিবারের সঙ্গে সংযোগ রেখে ইফতার করেন, যা তাঁদের জন্য একধরনের মানসিক শান্তি বয়ে আনে।
বাহরাইনে রমজান মাস ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের পাশাপাশি সামাজিক ঐক্যেরও প্রতীক। প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশীয় ঐতিহ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির সমন্বয়ে রমজান মাসকে উপভোগ করেন।
বাহরাইন থেকে: নাজির আহমদ